প্রতীম দে
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি, প্রতি নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে সরকারের পক্ষ থেকে। দশ বছরেও পূরণ হয়নি প্রতিশ্রুতি।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে বেকারত্বের হার এখন সর্বোচ্চ। নরেন্দ্র মোদীর ভাষায় ‘অমৃতকাল’ চলছে। সত্যি কি তাই?
দেশের যুবকরা কাজ পাচ্ছেন না। কাজ করলেও মজুরি কম, সংসার চালাতে নাজেহাল হতে হচ্ছে। চাল, ডাল, তেল, নুন, ওষুধ, সবজি সব কিছুর দিন বেড়েছে। রান্নার গ্যাসের কথা নয় বাদই দেওয়া গেলো।
যে মিনিকেট চাল দশ বছর আগে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কিলো পাওয়া যেত আজ তা হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫। ডাল সবই ১০০ টাকার ওপরে।
এক সপ্তাহে ছাতুর দাম বেড়েছে প্রায় ৩.৫ টাকা। ১৭ টাকার ছাতুর ছোট প্যাকেটের দাম হয়েছে ২০ টাকা।
জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ কোথায়? সাধারণের বাজারে খাদ্যে মূল্যবৃদ্ধির সূচক ১০ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে মাসের পর মাস। মোদী সরকারের সময়ে ডাল এবং ভোজ্য তেলের দাম একশো পার করেছে। একশোর কোঠায় পেট্রোল, ডিজেল। ৪০০ টাকার গ্যাস ১২০০ হয়েছে। বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ গড়ে ওঠার চাপে মাত্র ২০০ টাকা কমিয়েছে কেন্দ্র।
সামনে লোকসভা নির্বাচন। কাজ, রোজগার আর জিনিসের দাম- তিন দিকেই ক্ষোভ রয়েছে বিজেপি’র ওপর। তার ওপর রেলে, ব্যাঙ্কে, বিমায় স্থায়ী পদে নিয়োগ নামমাত্র। ২০১৯’র রেলের যে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, তার নিয়োগও অসম্পূর্ণ। কলকাতাতেই চাকরিপ্রার্থীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।
বিক্ষোভের আওতা বাড়ছে। সংসদে পাশ হয়েছে তিন ‘সংহিতা’। আইন পাশের পরই পরিবহণ কর্মীরা দেশজুড়ে নেমেছেন ধর্মঘটে। আপাতত সংশ্লিষ্ট ধারার প্রয়োগ স্থগিত রাখার ঘোষণা করতে হয়েছে কেন্দ্রকে।
২৬ জানুয়ারি ৭৫ তম প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন গোটা দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি নীতির বিরুদ্ধে ট্র্যাক্টর মিছিল করেছেন কৃষকরা। ১৬ ফেব্রুয়ারি গোটা দেশে হবে আইন অমান্য কর্মসূচি। কৃষিবিজ্ঞানী এমএস স্বামীনাথনকে ভারতরত্ন দিলে কী হবে, ফসলের ন্যূনতম দাম নিশ্চিত করার আইন পাশ হয়নি!
পুরানো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনার দাবিতে দিল্লি সহ গোটা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ দেখিছেন অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মীরা। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী, কেন্দ্রীয় সংস্থার পাশাপাশি বিক্ষোভ রাজ্যে রাজ্যে।
মোদী সরকারের নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি বাতিল এবং এনআরসি-সিএএ’র বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে গোটা দেশ। দিল্লিতে দফায় দফায় বিক্ষোভ, সমাবেশের ডাক দেওয়া হচ্ছে এসএফআই সহ ১৬টি ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে। হিন্দু ভোটের দিকে তাকিয়ে মেরুকরণের চেষ্টা চলছে।
আবার ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দাবিতে জোরালো স্বর কম নয়। ৩৭০ ধারা বাতিলে সাফল্যের দাবি করছেন মোদী। সেই সঙ্গে পূর্ণরাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাঙা হয়েছে। কাশ্মীরে বিক্ষোভ ছিলই। বেনজির প্রতিবাদ হয়েছে লাদাখেও।
এই সব কিছুর পরেও প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় দাঁড়িয়ে দাবি করেছেন তার দল ৩৭০ আসন পাবে লোকসভা নির্বাচনে। মুখে বললেও নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহরা কি সত্যি এতই আত্মবিশ্বাসী !
প্রশ্ন উঠছে, কারণ সাফল্যের লম্বা দাবি করলেও সব সমীক্ষা বন্ধ করে রেখেছে মোদী সরকারই। এমনকি জনগণনা পর্যন্ত করায়নি, স্বাধীন ভারতে এবারই প্রথম।
রাম রথযাত্রার মাধ্যমে হিন্দি বলয়ে উত্থান হয় বিজেপির। তারপর বাবরি মসজিদ ধ্বংস আরএসএস-বিজেপি’র। এবার ফের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাম মন্দিরের হাওয়া তুলে নির্বাচন পার করার পরিকল্পনা করেছে বিজেপি। অসম্পূর্ণ মন্দির উদ্বোধনে ক্ষোভ শঙ্করাচার্যদের, তবু তড়িঘড়ি ধর্মগুরুর ভূমিকায় ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী!
তাতেও যে চিঁড়ে ভিজবে না তা বুঝতে পেরেছে বিজেপি। তাই পরিকল্পনা মাফিক কাশির জ্ঞানবাপী মসজিদ এবং মথুরার শাহী ইদগাহ নিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরন শুরু করেছে তারা। ফের স্লোগান তোলা শুরু হয়েছে ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’।
এতদিন এই নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও, রিল ইতিমধ্যে ছাড়ানো হচ্ছিল। এবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই কথা বলে দিলেন। তিনি বলেন, ‘‘অযোধ্যার উৎসব লোকেরা দেখেছেন। তারপরই নন্দী বাবা (শিবের ষাঁড়) বললেন, আমি কেন অপেক্ষা করবো। তাই অপেক্ষা না করে তিনি রাতেই ব্যরিকেড ভাঙিয়ে নিয়েছেন। এখন আমাদের কৃষ্ণ-কানাহাইয়া কেন মানবেন?’’
সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্য, চারশো আসনের স্লোগান তোলা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের বড় অংশই নিয়ন্ত্রণে, ফলে প্রচারও হচ্ছে। কিন্তু বিজেপি নিজেই নিশ্চিত নয় লোকসভা ভোটে গরিষ্ঠতা হবে কিনা। সে কারণেই ধর্মীয় মেরুকরণে এত ব্যস্ততা।
Comments :0