Post Editorial

প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েও ব্যবসা?

উত্তর সম্পাদকীয়​


শুভজিৎ সরকার
কথায় আছে একটা প্রজন্মের উন্নত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তর থেকে তার শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটা চারা গাছ যদি ঠিকভাবে জল হাওয়া না পায় তার পক্ষে বেড়ে ওঠা সম্ভব নয়, তেমনই একজন বাচ্চা যদি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ না পায় তার পক্ষে এই সমাজে বেড়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। তার উপর এখনকার বাজার অর্থনীতি এবং পুঁজি যেভাবে গ্রাস করেছে চারপাশকে, আমরা যতই বলি পুঁথিগত শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার থেকেও সামাজিক শিক্ষা এবং আত্মোপলব্ধি বড়, আসলে ডিগ্রি, পুঁথি এবং প্রাতিষ্ঠানিকতা ছাড়া এই সমাজে বেঁচে থাকাই দুষ্কর। কে কতটা জানলো তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কে কতটা প্রেজেন্ট করে ভালো করে, এখন শিক্ষিত, জ্ঞানী লোকের থেকেও প্রেজেন্টারদের উপর নজর বেশি দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।  আমরা ছোটবেলায় শুনেছি গুরুকুলে শিক্ষার কথা, যেই  বেদের গল্প দিয়ে একদল লোক গোটা সমাজে মন্দির, মসজিদের রাজনীতি করছে তারা কি জানে যে বৈদিক সময় বেসরকারি স্কুলের ভাবনা ছিল না। প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষা পয়সা দিয়ে ক্রয় করতে হতো না। এখন তো প্লে স্কুলের যুগ, মানে মূল স্কুলে যাওয়ার আগে মা বাবারা কারি কারি টাকা দিয়ে এমন একটি স্কুলে বাচ্চাদের পাঠায় যেখানে তাদের খেলাধুলা করানো হয়, সোশাল ম্যানার্স শেখানো হবে এমন বলে, প্রচুর প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। বাবা মায়েরা ভাবে এইসব স্কুলে না পড়লে তাদের বাচ্চারা পিছিয়ে যাবে। আসলে এই যে প্রসেস এটা একদিনে তৈরি হয়নি। আমরা যারা নাইন্টিস কিড অর্থাৎ যাদের জন্ম ১৯৯০-এর দশকে তারা এই পুরো প্রসেসটা তৈরি হতে দেখেছি। মূলত শহরে তৈরি হয় এই প্রসেস যেটা আস্তে আস্তে এখন গ্রাম মফস্বল সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। আসলে এর পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিশ্ববাজার এবং তার অর্থনীতির চারিত্রিক পরিবর্তন। রাষ্ট্রের চরিত্রগত পরিবর্তন এবং এই সমস্তটাই আসলে রাজনীতির জন্যই। কারণ রাজনীতি সমস্ত নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যদি এমন কোনও শাসক থাকে যে চায় রাষ্ট্রীয় কাঠামো আসলে জনগণের জন্য তৈরি হওয়া একটি কাঠামো এবং এখানে এর মূল্য ততদিনই যতদিন জনগণ মনে করবে তাহলে এক বিষয়। আবার অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী এবং আরও প্রতিক্রিয়াশীল কিন্তু মুখে লিবারেল যদি কোনও শক্তি থাকে সে বেশিরভাগ সময়ই লিবারেলের মুখোশ পরে আসলে welfare state এর ভাবনাকে দূরে সরিয়ে মনে করে যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য জনগণ। জনগণের জন্য কাজ করা বা তাদের ওয়েলফেয়ার করাটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এমনটা নয়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে একদল ছোট অংশের অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল মানুষের হাতে ক্ষমতা উপভোগ করার পক্ষে এরা।

বিশ্বায়নের পরবর্তী দুনিয়ায় যেমন অনেকের মতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বের সংস্পর্শে আসতে পারে পশ্চিমী দুনিয়া এবং তাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের পদ্ধতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে গণতন্ত্রের প্রসার করার কাজে মন দিতে থাকে পূর্বতন সোভিয়েতের বিভিন্ন দেশগুলো, এর পাশাপাশি আস্তে আস্তে সমাজতন্ত্রের মূল ভাবনাকে আমেরিকা সরাতে গিয়ে একসাথে বাঁচার ভাবনাও নস্যাৎ হয়ে যায়। নিজ কেন্দ্রিক, আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার উৎপত্তি আসলে আধুনিকতার মোড়কে সমাজে বিরাট অবক্ষয়ের সন্ধিক্ষণে নিয়ে গেছে আমাদের। একজন বাচ্চাকে ছোট থেকে শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে, টাকা থাকলে তোমার মূল্য আছে আর টাকা না থাকলে তুমি মূল্যহীন। বাবা মায়ের পকেটে পয়সা থাকলেই তুমি স্কুলে আসতে পারবে, না থাকলে পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। পরে ছোটখাট চাকরি করতে যেটুকু ইংরেজি লাগে সেটা কোনও বেসরকারি সংস্থা থেকে শিখে নিলেই হবে। সমাজ নষ্ট করার ষড়যন্ত্রকারীদের দেখানো পথ অনুকরণ করে আমাদের বাড়ির লোকেরা ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন নামীদামি বেসরকারি স্কুলে ঢোকানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক স্তর মানে যেখানে ভিত শক্ত হওয়ার কথা সেই স্তরে ছাত্রটির স্কুল বলতে প্রথম উপলব্ধি হচ্ছে কি, স্কুল মানে পশ্চিমী দুনিয়ার কিছু আদব কায়দা। নিজের দেশ বা রাজ্য বা স্থানীয় জিনিস জানার আগে জানতে হবে ইংল্যান্ড কেমন দেশ, তার ইতিহাস, ভূগোল। আমেরিকার ইতিহাস, আমেরিকার কটা নদী আছে, পারলে পুকুর কটা আছে পড়িয়ে দেয় কিন্তু ভারতবর্ষে গঙ্গা আর হুগলী নদীর পার্থক্য জানতে পারেনা আপনার বাড়ির সন্তান। ছোট থেকে হুগলী নদীকে গঙ্গা বলে বড় হয়েছে সে। সে ভাষার প্রনান্সিয়েশন শিখলেও নিজের মাতৃভাষা এবং সর্বোপরি মূল শিক্ষা, চারপাশ নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকছে না। প্রাইভেট স্কুল গজিয়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। যাদের বাবা, মায়েরা সরকারি স্কুলে গিয়ে পড়াশুনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের বাড়ির লোকও প্রাইভেট স্কুলেই পাঠাচ্ছে। হ্যাঁ, হয়ত বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে এই ধারণা আছে কিন্তু এর জন্য দায়ী কে?
দায়ী অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা আছে তারাই। তারা যদি স্পষ্টভাবে এই ভাবনা ত্বরান্বিত করত যে শিক্ষার মধ্যে পুঁজির বিনিয়োগ করা চলবে না, শিক্ষার মতো ফান্ডামেন্টাল একটা জিনিসের মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয় এলে প্রাথমিক স্তরেই গন্ডগোল শুরু হবে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময় আমাদের দেশ যখন আস্তে আস্তে নিজেকে গড়ে তোলার দিকে এগতে থাকছে তখন বিভিন্ন স্তর থেকে ভিন্ন মতামত উঠে আসছিল হয়ে রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বা ওয়েলফেয়ার স্টেটের দিকে যাওয়ার পক্ষে যারা ছিল তারা নিজেদের দিকে সমর্থন আদায় করে পরবর্তীকালে দেশের সরকারকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিকানা রাষ্ট্র তথা সরকারের হাতে শক্তভাবে রাখতে সক্ষম হন। ১৯৬০,১৯৭০ এর দশকে যখন দেশজুড়ে এক টালমাটাল পরিস্থিতি তখন আস্তে আস্তে শিক্ষাকে প্রাথমিকে বাধ্যতামূলক করা এবং অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা উঠে আসে। ১৯৭৭ সালে এই রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার আসার পর অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটে। বিনামূল্যে, বেতন ছাড়া প্রাথমিকে শিক্ষা। রাজ্যের কোনায় কোনায়, গ্রামে গ্রামে একাধিক প্রাইমারি স্কুল তৈরি হয়। যেই স্কুলগুলোর লক্ষ্য ছিল ক্লাসরুমগুলোতে কালো মাথার ভিড় করে তাদের মধ্যে যুক্তিবোধ তৈরি করবে। কেবল পুঁথিগত শিক্ষায় সীমাবদ্ধ না দেখে তাদের মধ্যে সমাজ চেতনার ভাবনা তৈরি করাটাও লক্ষ্য ছিল। এই স্কুলগুলোর মধ্যে একাধিক শিক্ষক, শিক্ষিকার দরকার ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই স্কুলগুলোতে চাকরির ব্যবস্থা হয় এই রাজ্যের শিক্ষিত যুব সমাজের। একটা ব্যবস্থাপনা তৈরি হয়, পড়াশোনার পরিসরে আগ্রহ বাড়ে। শিক্ষিত হওয়ার হার প্রায় দ্বিগুণ হতে থেকে ২০-২৫ বছরের মধ্যে। রাজ্যে বাম সরকার তার মূল ধারণা, ভাবনা সমাজ বিকাশের কথা, সমাজের সামাজিক ভাবনা সমস্তটা মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া। তবে ২০০০ পরবর্তী সময় যখন বিশ্বায়ন নিজের মডিফিকেশন করে অন্য রূপ নেওয়া শুরু করে এবং কমোডিটি ফেটিশইজম হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা, তখন এই বেসরকারিকরণের ঢেউকে রুখতে সমস্যা শুরু হতে থাকে।

আস্তে আস্তে বিশ্বায়নের প্রভাব সঙ্গে উপনিবেশবাদের মিলিত প্রভাবে প্রভাবিত হতে শুরু করে চারপাশের মানুষজন। শিক্ষা আস্তে আস্তে পণ্যে রূপান্তরিত হওয়ার দিকে এগতে থাকে। Knowledge Centric Education থেকে Information Centric Education এর দিকে এগনোর হাওয়া ওঠে। আর প্রাথমিকেও প্রভাব শুরু হয়। ওই যে শুরুতেই বলেছি প্লে স্কুলের কথা, সেরকম প্লে স্কুল এতটা প্রভাব বিস্তার করে যে বেসরকারি স্কুলের আবহ তৈরি হয়ে যায়। ভাবতে পারেন স্কুলের ব্যবসা নাকি একটা প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এই রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার পর যখন নির্বাচনী রাজনীতিতে বামপন্থীদের প্রভাব কমতে থাকে এবং তৃণমূল আর বিজেপি-কে এক অংশের মিডিয়া একমাত্র নির্বাচনে প্রাসঙ্গিক শক্তি হিসাবে তুলে ধরতে থাকে তখন এই বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া আরও সহজ হতে থাকে। রাজ্যের শীর্ষে বসে থাকা লোকেরা, বা কেন্দ্রীয় সরকারের মাথায় বসে থাকা নেতারা যখন বলতে থেকে বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হয়। এখান থেকে এটা স্পষ্ট হতে থাকে যে আসলে রাষ্ট্র নিজের কল্যাণমূলক চরিত্র থেকে বেরিয়ে কেবল একদল উচ্চ শ্রেণির মানুষের যন্ত্র হিসাবেই ব্যবহারিত হবে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর বা সংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমকে ব্যবহার করে রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্রের আবহই আবার তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে সমাজের উপরের শ্রেণি। শুরুর দিকে অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষায় বেসরকারি স্কুল গজানোর সময় যেই অর্থ ধার্য করা হতো তার থেকে বেশি গুণ টাকা বর্তমানে এই স্কুলগুলো নিয়ে থাকে ছাত্রদের থেকে। সব থেকে বড় কথা অল্প লাভ নয় এখন বর্তমানে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বেসরকারিকরণের ফলে বড় বড় পুঁজিপতিরা এই নির্দিষ্ট খাতে বেশি বেশি ইনভেস্ট করছে কারণ এখানে লাভের মাত্রা বেশি।

তার উপর নতুন সংযোজন হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষা নীতি এবং আমাদের রাজ্যের সরকারের যে নতুন শিক্ষা নীতি যেখানে স্কুলগুলো মার্জ করে দিয়ে স্কুলের সংখ্যা কমানোর কাজ চলছে। রাজ্যের বাম সরকার বছর বছর অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল তৈরি করত আর কেন্দ্রের বিজেপি, রাজ্যের তৃণমূল মিলিতভাবে স্কুলগুলো বন্ধ করছে। এতে যারা শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে তাদের সুবিধা হচ্ছে। এমন ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে সরকারি স্কুল মানে কিছু শিখবেনা আপনার সন্তান, সঠিক শিক্ষা প্রদানের জায়গা কেবলই বেসরকারি স্কুল। এর উপর নতুনভাবে আবার উপনিবেশবাদী চিন্তার সংযোজন আছে যেখানে ইংরেজি ভাষা এবং পশ্চিমী দুনিয়ার এক বিরাট প্রভাব আমাদের সমাজে। লুচি আলুর দমের থেকে পিৎজা বারগারের গুরুত্ব যেরকম বেশি সেইভাবে টাই সুট পরে স্কুলে যাওয়ার একটা হিড়িক তৈরি করেছে পশ্চিমী জগৎ। এই সমস্ত কিছুর জন্য আমজনতাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, চারিপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করেছে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যারা শীর্ষে বসে।

সব থেকে বড় কথা এই সমস্ত কিছুর মূল সমস্যার কারণ কি মাধ্যমে পড়া হবে বা না হবে তার থেকেও বেশি হচ্ছে শিক্ষায় বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগের মাত্রা এত বেড়ে যাচ্ছে যে সত্যিই শিক্ষা আজকে বিলাসিতার এক পণ্যে পরিণত হচ্ছে। যেই সর্ব শিক্ষা অভিযানের জন্য এত লড়াই, এত আন্দোলন সমস্তটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কতটা ভয়ানক পরিস্থিতি নিজেরাই ভাবুন যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বসে থাকা সরকার আপনার দায়িত্ব নিতে চাইছে না। তাহলে স্বাধীন ভারতবর্ষের পার্থক্য কি পরাধীন ভারতের থেকে। কোটি কোটি টাকা উলটো পালটা কাজে খরচ হলেও শিক্ষায় বরাদ্দ কমছে প্রতি বছর। দেশের মধ্যে নির্বাচনের আগে বাইনারি তৈরি হচ্ছে, আর সারা বছর জাতপাতের আবহ। এই সব কিছুর সমাধান করতে গেলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় আরও বেশি অংশের মানুষকে যুক্ত করতে হবে। যারা ছেড়ে দিতে চাইছে তাদের শিক্ষায় ফেরাতে হবে। এই রাজ্যে বাম সরকার থাকাকালীন মিড ডে মিল প্রকল্প থেকে মাতৃ ভাষায় শিক্ষার কথা বলেছিল বলেই আজও আমার আপনার ঘরের ছেলে,মেয়েটা মাথা উঁচু করে যুক্তি তর্কের মধ্যে অংশগ্রহণ করতে পারে, শিক্ষার পাঠ দিতে পারে, অন্য রাজ্যে চাকরি পায়। কি আর করা যাবে এই রাজ্যে তো আর চাকরি নেই। মিড ডে মিল দিল কেন? 
যাতে একবেলার খাবার স্কুলে পাবে বলে বাড়ির লোক স্কুলে পাঠায় বাচ্চাদের। স্কুলের খাওয়ার পাশাপাশি পড়াশোনা হবে, সাক্ষরতার হার বাড়বে, শিক্ষার হার বাড়বে। এবং অবশ্যই একসাথে খাওয়ার সময় তার মাথায় জাতপাত, ধর্মীয় বিভাজন এগুলো থাকবে না। তৃণমূল সরকার মুখে বলবে মিড ডে মিলে মাংস দেবে এদিকে যেই চাল দেওয়ার শিশুদের খাবারে সেই চালের বস্তা তৃণমূলের পঞ্চায়েতের নেতার বাড়িতে পাওয়া যায় মহামারীর সময়। অনেকেই ইংরেজি তুলে দেওয়া নিয়ে অনেক কুমন্তব্য করে বাম সরকারের বিরুদ্ধে, তারা কি জানে যে আসলে পৃথিবীর ২০% কম মানুষ ইংরেজি ভাষা জানে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশ ইংরেজিকে ভাষা হিসাবেই পাত্তা দেয় না। আমাদের দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের ফলে ইংরেজি একটি ভাষা যা আমাদের পুরো দেশকে না জানতেও এক করে দেয়, কিন্তু সেটা আমাদের প্রাথমিক কাজ নয়। প্রাথমিক কাজ নিজের ভাষা শেখা। যাদের প্রথম প্রজন্ম স্কুলে যাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় পড়াশোনা করা যতটা সহজ ভিন্ন এক অন্য দেশের ভাষা বা কোনও অন্য ভাষায় পড়াশোনা করা অনেক কঠিন। তাই কেন্দ্রের বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন যখন প্রাথমিকে মাতৃভাষায় শিক্ষার কথা বলে তখন তামিলনাড়ুর সরকার এবং আমাদের রাজ্যের বামফ্রন্ট পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গের সরকারই মাতৃভাষায় পড়ানোর সুপারিশ মানে। এক্ষেত্রে রাজ্যের প্রান্তিক অংশের মানুষ, কৃষক, খেতমজুর, দিনমজুরের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয় এবং এরাই পরবর্তীকালে শিক্ষিত হয়ে SSC, TET, PSC, CSC-এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়তে পড়ানোর কাজে যুক্ত হয়। অনেকে আরও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি পায়।

মোদ্দা কথা একটাই, সরকার চাইলে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি হবে আর সরকারের চাহিদা যদি হয় যে সে দায়িত্ব নেবে না, স্থায়ী কোনও ব্যবস্থা করবেন তার জনগণের জন্য তাহলে সেটাই হবে। বর্তমান সময়ে শিক্ষার এই বেহাল অবস্থার জন্য আমরা সকলেই অল্প বিস্তর দায়ী। শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগ, অত্যধিক মুনাফা করার যে আগ্রাসী চরিত্র এটা বর্তমানে অবিলম্বে বন্ধ হওয়ার প্রয়োজন। আর সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে, অভিভাবকদের মধ্যে সরকারি স্কুল সম্বন্ধে যে অনীহা এবং খারাপ ধারণা এটা পালটাতে হবে। শিক্ষা সরকারি উদ্যোগে হওয়ার জিনিস, বেসরকারি হাতে যাওয়ার জিনিস নয় এই শিক্ষাব্যবস্থা। আসলে বেসরকারি মানে পরিষেবা ভালো নয়, বেসরকারি মানে সমাজের অবক্ষয়, বেসরকারি মানে কেবল যে মালিক তার মুনাফা, আপনার, আমার প্রগতি বা আমাদের ভালো হবে এমনটা নয়। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে সর্বত্র ঐক্য গড়ে তুলুন। সরকারকে জোর গলায় বলুন, শিক্ষায় ব্যবসা ঢোকালে তাদের গদি থেকে ফেলে দেবেন।

Comments :0

Login to leave a comment