Municipality recruitment scam

ফিরহাদ, মদন সহ তৃণমূল নেতাদের বাড়িতে একযোগে হানা সিবিআই’র

রাজ্য

প্রায় আড়াই বছর বাদে ফের কলকাতার মেয়র ও রাজ্যের পৌর মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বাড়িতে সিবিআই হানা। ২০২১’র মে মাসে নারদ ঘুষকাণ্ডের তদন্তে সিবিআই হানা দিয়েছিল তাঁর বাড়িতে, বাড়ি থেকেই তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এবার পৌরসভায় নিয়োগে দুর্নীতিতে বাড়িতেই তল্লাশি ও জেরার মুখে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ শাসক তৃণমূলের এই শীর্ষ নেতা।
রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় দশ ঘণ্টা তল্লাশি অভিযানের শেষে সিবিআই আধিকারিকরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে ফিরহাদ হাকিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘এদিনের তল্লাশি অভিযানের নির্যাস বিগ জিরো। ওরা আমার, আমার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তির তালিকা নিয়েছে। আমার প্যান কার্ড, ব্যাঙ্কের ডিটেলস নিয়েছে।’’
ইডি’র তল্লাশি অভিযানের তিন দিন পরেই এদিন সকাল থেকে একযোগে রাজ্যে ১২টি জায়গায় দফায় দফায় তল্লাশি অভিযান শুরু করেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা। শুধু ফিরহাদ হাকিম নয়, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও বিধায়ক মদন মিত্র থেকে শুরু করে উত্তর ২৪ পরগনা ও নদীয়ার একাধিক পৌরসভার প্রাক্তন ও বর্তমান চেয়ারম্যানের বাড়ি ও অফিসে তল্লাশি শুরু করে সিবিআই। 
আদালতে বারবার তদন্তের গতি নিয়ে ভর্ৎসনার মুখে পড়েই সিবিআই’র এমন তৎপরতা বলে মনে করা হচ্ছে, যদিও তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ প্রোমোটার অয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করার পরে এই তদন্তে এখন পর্যন্ত তেমন কোনও গ্রেপ্তারি নেই। মাথার আশপাশেই যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে তদন্ত প্রক্রিয়া। স্বাভাবিকভাবেই আদালত ছাড়িয়ে জনমানসেও তদন্তের গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
পৌরসভায় নিয়োগে দুর্নীতিতেই কিছু দিন আগে ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, ‘‘আরে তদন্তটা কীসের, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’’ ওদিকে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে দুর্নীতির তদন্তে নেমে ততক্ষণে ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের বাড়ি ও অফিস থেকে নথি উদ্ধার করে ইডি আদালতে জানায়, ‘‘সোনার খনির খোঁজ মিলেছে।’’ প্রোমোটারের কাছ থেকে প্রাইমারি টেটে দুর্নীতির নথির পাশাপাশি পৌরসভায় চাকরির পরীক্ষার ওএমআর শিটও মিলেছে! 
সেই বেনজির দুর্নীতির তদন্তেই রবিবার সকাল থেকে চলল ১২টি জায়গায় সিবিআই’র ম্যারাথন তল্লাশি অভিযান। বাজেয়াপ্ত করা হলো একাধিক ঠিকানা থেকে বিপুল নথি। এদিন সকালে সিবিআই’র একটি দল চেতলায় ফিরহাদ হাকিমের বাড়িতে পৌঁছায়। গোটা বাড়ি ঘিরে রাখেন বিপুল সংখ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর সশস্ত্র জওয়ানরা। তল্লাশি পর্বে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তা নিয়ে প্রকাশ্যেই ফিরহাদ হাকিমের কন্যার সঙ্গে বচসাও বাঁধে কেন্দ্রীয় বাহিনীর। মেয়রের মোবাইল বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে তারপরে তাঁকে জেরা শুরু করা হয়। সকাল ১০টার পরে ঘরেই জেরার মুখে পড়েন পৌর মন্ত্রী।
অন্যদিকে তার একটু পরেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আধিকারিকদের আরেকটি তদন্তকারী দল মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্রে ভবানীপুরে মদন মিত্রের বাড়িতে হানা দেয়। সেখানে মূলত তল্লাশি চলে। দক্ষিণেশ্বরে মদন মিত্রের আরেকটি ফ্ল্যাটেও তার কিছু পরে পৌঁছে যায় তদন্তকারী আধিকারিকদের আরেকটি দল। সেখানেও শুরু হয় তল্লাশি অভিযান। বেলায় খবর পাওয়া যায়, হালিশহর ও কাঁচরাপাড়ার প্রাক্তন তৃণমূলী পৌরপ্রধানদের বাড়িতেও হানা দিয়েছে সিবিআই’র তদন্তকারী দল। এরপর একে একে দমদম, উত্তর দমদম, টাকি ও কৃষ্ণনগরে বর্তমান ও প্রাক্তন পৌরপ্রধানদের বাড়িতে, কোথাও আবার অফিসে শুরু হয় ঝটিকা তল্লাশি অভিযান।
এই অভিযান চলাকালীনই সিবিআই’র তরফে একটি প্রেস বিবৃতিতে দাবি করা হয়, বিভিন্ন পৌরসভা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদে গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যাবতীয় বরাত দেওয়া হয় একটি নির্দিষ্ট সংস্থাকে। নিয়োগের জন্য পরীক্ষার সব ব্যবস্থা করতো ওই সংস্থা। ওএমআর শিট তৈরি করা থেকে তা স্ক্যান করা, এমনকী মেরিট লিস্টও তৈরি করানো হতো ওই সংস্থাকে দিয়ে। গোটা প্রক্রিয়াই চালানো হয়েছিল বেআইনি নিয়োগের পথ প্রশস্ত করতে। আদালতের নির্দেশেই তদন্ত, সেই তদন্তের সূত্রেই এই তল্লাশি অভিযান।
তল্লাশি পর্বেই সিবিআই’র একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, মূলত ২০১৪ সালের পর কীভাবে নিয়োগ, কত জনকে পৌরসভায় নিয়োগ করা হয়েছে, নিয়োগ সংক্রান্ত কোনও প্রস্তাব পৌরসভার বোর্ড মিটিংয়ে নেওয়া হয়েছিল কি না, তালিকা কীভাবে এল— সেই সব সংক্রান্ত নথি এই অভিযানে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একের পর এক পৌরসভায় একটি মাত্র সংস্থাই পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বরাত পেল কীভাবে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পৌরসভার চেয়ারম্যানদের কি কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, অয়ন শীলের ‘এবিএস ইনফোজেন’ নামক সংস্থাকেই বরাত দিতে হবে! কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, কয়েকশো কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। টাকার বিনিময়ে ওএমআর শিট বিকৃত করেই চাকরি বিক্রি করা হয়েছে।
গত ৫ অক্টোবর একইভাবে রাজ্যের খাদ্য মন্ত্রীর বাড়ি সহ উত্তর ২৪ পরগনার ১২টি জায়গায় একযোগে তল্লাশি চালায় আরেক কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি। পৌরসভায় নিয়োগে দুর্নীতিতে অর্থের বেআইনি লেনদেনের তদন্তেই সেই অভিযান চালানো হয়। খাদ্য মন্ত্রী তথা মধ্যমগ্রাম পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যানের বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত চলে দীর্ঘ জেরা ও তল্লাশি পর্ব। মন্ত্রীর বাড়ির বাইরে তৃণমূলী বাহিনীও সেই দিন জমায়েত করে।
এদিনও যেমন সকালে ফিরহাদ হাকিমের বাড়িতে সিবিআই’র ছয় জন আধিকারিক ঢুকেছেন, সেই খবর পাওয়ার পরেই চেতলা ও খিদিরপুর এলাকার তৃণমূলের বাহিনী জড়ো হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুক্ষণ বিক্ষোভও দেখানো হয়। বিকালের দিকে মদন মিত্রের বাড়ি ও ফ্ল্যাট থেকে সিবিআই আধিকারিকরা কিছু নথি সংগ্রহ করে বেরিয়ে যান। কামারহাটি পৌরসভায় নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়েই মদন মিত্রের বড়িতে হানা দেয় সিবিআই। তিন দিন আগে এই পৌরসভার বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে হানা দিয়েছিল ইডি। এই ব্যক্তি ধৃত অয়ন শীলের ঘনিষ্ঠ ছিল বলে জানা গিয়েছে। সেই সূত্রেই এবার তল্লাশির মুখে মদন মিত্র।
একই সময়ে সিবিআই আধিকারিকদের একাধিক দল হালিশহরের প্রাক্তন পৌরপ্রধান অংশুমান রায়, কাঁচরাপাড়ার প্রাক্তন পৌরপ্রধান সদুমা রায়, নিউ বারাকপুরের প্রাক্তন পৌরপ্রধান তৃপ্তি মজুমদার, টাকি পৌরসভার চেয়ারম্যান সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে হানা দেয়। এর আগে গত ৭ জুন টাকি সহ এই একাধিক পৌরসভায় তল্লাশি চালিয়েছিল সিবিআই। নদীয়ার কৃষ্ণনগর পৌরসভার চেয়ারম্যান তৃণমূল নেতা অসীম সাহার বাড়িতে এদিন ফের হানা দেয় সিবিআই। অয়ন শীলের জেরাতেও এই ব্যক্তির নাম সামনে এসেছিল। সেই সঙ্গে দমদমের পৌরপ্রধান হরেন্দ্র সিং, উত্তর দমদমের প্রাক্তন পৌরপ্রধান সুবোধ চক্রবর্তীর বাড়িতেও চলে তল্লাশি অভিযান। ধৃত অয়ন শীলের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া নথিপত্র ও জেরা থেকেই এই ব্যক্তিদের নাম সামনে এসেছে বলে দাবি সিবিআই’র।
তৃণমূল এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ শান্তনু ব্যানার্জির ‘বন্ধু’ অয়ন শীলের সংস্থাকেই পৌরসভায় কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘থার্ড পার্টি এজেন্সি’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল সরকার। অধিকাংশ পৌরসভায় নিয়োগের বরাত পেয়েছিল ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের সংস্থা ‘এবিএস ইনফোজোন প্রাইভেট লিমিটেড’। ইন্টারভিউ নেওয়া থেকে শুরু করে ওএমআর শিট ছাপানো, নিয়োগপত্র দেওয়া পর্যন্ত সব প্রক্রিয়ার জন্য টেন্ডার পেত অয়ন শীলের সংস্থা। অয়ন শীলের অপর একটি সংস্থা ‘এবিএস ইনফ্রাজোন প্রাইভেট লিমিটেড’ আবার পেত সেই পৌরসভাগুলিতে যাবতীয় নির্মাণকার্য থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাত। এক জন প্রোমোটারের দু’টি সংস্থার মাধ্যমেই পৌরসভায় নিয়োগ ও পৌরসভার কাজের যাবতীয় বরাত বণ্টন!

Comments :0

Login to leave a comment