Post Editorial

জনগণনা বন্ধ করে রাখা মোদীর আর এক ধূর্তামি

উত্তর সম্পাদকীয়​


দেবেশ দাস
রাষ্ট্রসঙ্ঘের ঘোষণা  অনুযায়ী ২০২৩-সালের এপ্রিলে চীনকে জনসংখ্যায় ছাড়িয়ে গিয়ে ভারত এখন সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ। চীনের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার তথ্য পেতে রাষ্ট্রসঙ্ঘ নির্ভর করেছে সে দেশের সরকারি তথ্যের উপর, ভারতের ক্ষেত্রে অনেক আগের সরকারি তথ্যের উপর অনুমান করে হিসাব করা হয়েছে, কারণ ভারত সরকার জনসংখ্যা নিয়ে কোনও সাম্প্রতিক রিপোর্ট প্রকাশ করেনি বা ভারত সরকার সেই রিপোর্ট প্রকাশ করতে অক্ষম, কারণ ২০২১ সালের নির্ধারিত জনগণনা তথা আদমশুমারি  ভারত সরকার করেনি।
প্রতিটি দেশেই ১০ বছর অন্তর জনগণনা হয়। স্বাধীনতার আগে ভারতে প্রথম পূর্ণাঙ্গ জণগণনা হয় ১৮৮১ সালে, তারপর থেকে প্রতি ১০ বছর অন্তর দেশে জণগণনা হয়ে আসছে, ১৯৪১ সালে জণগণনা হলেও  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তার সব রিপোর্ট আর প্রকাশ করা হয়নি। স্বাধীনতার পরেও ১৯৫১ সাল সেই ধারা চলেছে গত ২০১১ সাল অবধি। ২০২১ সালে এসে তা বন্ধ হয়ে আছে সরকারের সিদ্ধান্তে।
জনগণনাতে কী হয় ?
সব দেশেই ১০ বছর অন্তর সেই দেশগুলির সরকার যে জনগণনা  করে, তাতে শুধু কত মানুষ আছে, সেটাই দেখে না, মানুষদের জীবনযাত্রা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, ভাষা, ইত্যাদি তথ্য নেয়। ভারতে জনগণনাতে সরকার সমস্ত তথ্য নেয়, তার মধ্যে আছে  শিক্ষাগত অবস্থান, ধর্ম, ভাষা,  বিবাহিত কিনা, বিবাহিত হলে কয়টি সন্তান, শারীরিক পঙ্গুত্ব আছে কিনা, পেশা, পরিযায়ী কিনা, পরিযায়ী হলে পরিযায়ী হওয়ার কারণ কী (চাকরি, ব্যবসা, ইত্যাদি),  বাসস্থানের তথ্য (কয় কামরার ঘর, দেওয়াল বা ছাদ পাকা না কাঁচা, মেঝে মাটির না পাকা), বাড়িতে টেলিভিশন/কম্পিউটার/মোটর সাইকেল/গাড়ি ইত্যাদি আছে কিনা, শৌচাগার আছে কিনা, বিদ্যুত আছে কিনা, জল আনতে দূরে যেতে হয় কিনা,  মোবাইল আছে কিনা, ইত্যাদি । ২০১১ সালে জনগণনায় ২৯টি তথ্য নেওয়া হয়েছিল।  এর সাথে জনগণনায় জিজ্ঞাসা করা হয় তফসিলি জাতি বা তফসিলি জনজাতি কিনা, তাদের ক্ষেত্রে নানা তথ্য নেওয়া হয়।  
ভারতের মতো দেশে উপরোক্ত কাজগুলি বিশাল। ২০২১ সালে জনগণনা হলে প্রায় ৩০ লক্ষ  গণনাকারীকে নিয়োগ করতে হতো আনুমানিক ৩৩ কোটি পরিবারে প্রায় ১৪০ কোটি লোকের জনতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক নানা তথ্য সংগ্রহ করতে।  এমনকি দেশের গৃহপালিত পশুদের সংখ্যাও গণনা করা হয়।
কেন দেশে দেশে জনগণনা  হয়?
জনগণনা শুধু কিছু তথ্য বুঝতে সাহায্য করে না, জনগণনার তথ্য অনুশীলন করে সরকার পরিকল্পনা করে, নীতি নির্ধারণ করে। আজকে আমাদের দেশে ২০২৪ সালে  পরিকল্পনা ও নীতি ঠিক করতে সরকারের নির্ভর করতে হবে ১৩ বছর আগের ২০১১ সালের জনগণনার তথ্যের উপর, যার ফলে তা সম্পূর্ণ ঠিক তথ্য হবে না,  ২০২১ সালের তথ্য পেলে তা হতো আরও নির্ভরযোগ্য।  তাছাড়া, সরকার  যদি কোনও নতুন পরিকল্পনা নেওয়ার কথা ভাবে,তা বাস্তবায়নের জন্য কত অর্থসংস্থান দরকার, কী কী করা দরকার তার জন্য জনগণনার তথ্য জরুরি। উপযুক্ত তথ্যের অভাবে প্রতিটি দপ্তরের কার্যকারিতা ও দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জনগণনার তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রচুর নানারকম সামাজিক গবেষণা হয়, স্বাভাবিকভাবেই সাম্প্রতিক তথ্যের অভাবে সেই গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।  অন্যান্য দেশের সাথে তুলনামূলক বিচার করতে গিয়ে সেখানে অন্যান্য দেশের সাম্প্রতিক জনগণনার তথ্য পাওয়া যাবে, ভারতের থাকবে পুরানো তথ্য। অতএব ভারতের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনগণনার প্রকৃত সংখ্যা নানা ধরনের সূচক তৈরিতে মৌলিক ইনপুট ডেটা তৈরি করে। এই মৌলিক ইনপুট ডেটাগুলি ১৩ বছর আগেকার হওয়ায় সূচকগুলি হবে গোলমেলে। এই সূচকগুলি বিশ্বব্যাপী অংশীদারদের বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য নিয়ে সিদ্ধান্তের জন্যও ব্যবহৃত হয়।  নির্ভরযোগ্য সূচকের অভাবে, এই সিদ্ধান্তগুলির গুণমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জনগণনা বন্ধ করা নিয়ে সরকারের বক্তব্য
জনগণনার কাজ শুরু হয় অনেক আগে থেকেই। জনগণনার নির্ধারিত বছরের ৩ বছর আগে  ২০১৮ সালের ৩১ শে আগস্ট আসন্ন সরকারি স্তরে একটি সভা হয় তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সভাপতিত্বে। তারপরে অনেক সভা হয়েছে। ১ এপ্রিল, ২০২০ থেকে কাজ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু কোভিড-১৯ প্যান্ডামিকের জন্য তা বন্ধ হয়ে যায়। সেই যে বন্ধ হয়ে গেল, তা আজও শুরু হয়নি। ২০২১ সালে এসে সরকার বলল,অনির্দিষ্ট কালের জন্য তা বন্ধ। সরকারের শেষ  নোটিফিকেশন পাওয়া সংবাদে সরকার যা বলেছে তাতে ২০২৪ সালের অক্টোবরের আগে জনগণনা শুরু হচ্ছে না।  
অনেক তথ্য প্রকাশই এখন বন্ধ
জনগণনা ছাড়াও, যে সমস্ত নানা রকম তথ্য সরকার মাঝে মাঝে প্রকাশ করে থাকে, তার বেশিরভাগই এখন বন্ধ। যেমন ধরুন, প্রতি বছরই জন্ম-মৃত্যু নিয়ে হিসাব সরকার প্রকাশ করে, তাতে শেষ রিপোর্ট ২০২০ সালের, প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালে, তার পরে আর সেই রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি।  যারা রোগে ভুগে মারা যান, তারা কিসে ভুগে মারা গেলেন  প্রতি বছর তার একটা রিপোর্ট প্রকাশ হয়, ২০২০ সালের পর তা আর প্রকাশ হয়নি। কত লোক প্রতি বছর প্রত্যক্ষ কর দেন, তাদের মধ্যে আয়ের ভাগ কী, তারা মোট কত টাকা দেন, এই নিয়ে রিপোর্ট প্রতি বছর প্রকাশ হওয়ার কথা, ২০১৯ থেকে সেই রিপোর্ট প্রকাশ বন্ধ। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তর, নীতি আয়োগ মিলে প্রতি বছর প্রতিটি রাজ্যের একটি স্বাস্থ্য সূচক প্রকাশ করার কথা, ২০২০ সালের পরে তা প্রকাশ বন্ধ হয়ে আছে। ভবিষ্যতের বিপর্যয় (ঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা, ইত্যাদি) মোকাবিলার জন্য, যখন বিপর্যয় ঘটে তার সম্বন্ধে  (যেমন কত জন মারা গেল, কতজন ক্ষতিগ্রস্ত, কত অর্থনৈতিক ক্ষতি, ইত্যাদি) রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে সরকারের তথ্য নেওয়া ও প্রকাশ করার  কথা, ২০২১-২২ সালের পরে কোনও তথ্য নেই ভারতের দিক থেকে।
অপদার্থতা না ইচ্ছাকৃত?
এই যে এত রিপোর্ট সরকারের প্রকাশ করার কথা, অথচ করছে না, জনগণনার ক্ষেত্রে প্যান্ডামিকের অজুহাতে ৩ বছর ধরে সেটা বন্ধ করে রেখেছে, এটা কি সরকারের এক ধরনের অপদার্থতা?    পৃথিবীর কোনও দেশেই জনগণনার কাজ প্যান্ডামিকের জন্য বন্ধ হয়ে যায়নি। মোদী সরকারের  অনেক অপদার্থতা আছে ঠিকই, কিন্তু এই ক্ষেত্রে বিষয়টা শুধুই অপদার্থতা বলে মনে হচ্ছে না।     
আসলে তথ্য প্রকাশে ভয়
জনগণনা হলে জানা যেত যে দেশে কত পরিবারে শৌচাগার আছে, কত পরিবারে বিদ্যুৎ আছে, কত পরিবারে রান্নার গ্যাস আছে, ইত্যাদি। সরকার দাবি করছে যে, দেশের সব পরিবারেই পাকা শৌচাগার করে দেওয়া হয়েছে, কয়েক কোটি গরিব  পরিবারে উজালা প্রকল্পে গ্যাস দেওয়া হয়েছে। অথচ সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তর কর্তৃক ২০২১ সালে প্রকাশিত ন্যাশনাল ফ্যামিলি  হেলথ সমীক্ষা অনুযায়ী  ১৯ শতাংশ পরিবারে শৌচাগার নেই। এই সমীক্ষা অনুযায়ী ৪০ শতাংশ পরিবারে রান্নার গ্যাসে রান্না হয় না ফলে মোদীর উজলা গ্যাস প্রকল্পের সাফল্য নিয়েই সন্দেহ জাগে। এগুলি হচ্ছে সমীক্ষার ফলাফল, অনেকে বলতে পারেন, এটা আসল তথ্য নয়।  পরিসংখ্যানবিদ বিজ্ঞানীদের মতে সমীক্ষা অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য।  কিন্তু  একদম সঠিক তথ্য পাওয়া যেত তো জনগণনা হলে, তা বন্ধ কেন?
স্বাস্থ্য দপ্তরের সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে নানা কথাবার্তায় সরকারের অস্বস্তি প্রকাশ পায়। কিছুদিন পরে দেখা যায় সেই রিপোর্ট প্রকাশের দায়িত্বে থাকা অফিসারকেই সরকার সাসপেন্ড করেছে একটা অন্য অজুহাতে। জনগণনা হলে হয়ত সরকারের নানা ব্যাপারে আরও অস্বস্তি বাড়তো। নির্বাচনের আগে সেই অস্বস্তির মুখোমুখি বিজেপি হতে চায় না। তাই প্যান্ডামিকের অজুহাতে ৩ বছর বাদেও জনগণনার কাজ শুরু হয়নি।  নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই দেশের প্রগতির পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখন বন্ধ। ১৪০ বছরের জনগণনার ইতিহাসে এই প্রথম ছেদ।

Comments :0

Login to leave a comment