আসানসোল বিশেষ আদালত মঙ্গলবার কয়লা পাচার কাণ্ডে সিবিআই’র তদন্তের ঢিলেমি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এদিনই কয়লা পাচার মামলায় চূড়ান্ত চার্জ গঠন হওয়ার কথা ছিল। হয়নি। সিবিআই’র ঢিলেমি তার অন্যতম কারণ। ক্ষুব্ধ বিচারপতির প্রশ্ন কতদিনে তদন্ত শেষ করবেন? কতদিন সময় লাগে তদন্তে? শেষ পর্যন্ত শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য হয়েছে আগামী ৩ জুলাই। অর্থাৎ ভোট শেষ হয়ে নতুন সরকার গঠনও হয়ে যাবে ততক্ষণে। তারপর চূড়ান্ত চার্জ গঠন হবে। সপ্তম দফা ভোটের আগে সুযোগ পেয়েও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কয়লা কাণ্ডের চার্জ গঠন পিছিয়ে দিতে চাইলো কেন?
কয়লা পাচার কাণ্ডে কার অস্বস্তি আড়ালের চেষ্টা? ভোটের আগে সংবাদমাধ্যমে সবথেকে বেশি যাকে আক্রমণ সেই তাঁর বিরুদ্ধে দুর্বল, রাজ্যের অচেনা মুখকে প্রার্থী করলো কেন বিজেপি? নিয়োগ দুর্নীতিতে ‘মানি লন্ডারিং’র তদন্তে প্রথম দফায় সেই ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির সম্পত্তির তালিকায় কেন একটিও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুঁজে না পেয়ে প্রায় তাঁকে বিপিএল তালিকায় ফেলে দেওয়া চেষ্টা করেছিল কেন ইডি? এমন যাবতীয় সব সন্দেহ যদিও আরএসএস স্পষ্ট দিয়েছে।
ভোটপর্বে দক্ষিণবঙ্গেরই আরএসএস’র এক প্রভাবশালী প্রচারক এবিষয়ে নির্দ্বিধায় জানিয়েছন- ‘আমরা পাতা কাটবো, গাছ নয়’। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কাছে অনুব্রত থেকে পার্থ চ্যাটার্জি, ‘কালীঘাটের কাকু’ থেকে মানিক ভট্টাচার্য এরা নিছকই পাতা। গাছ নয়। গাছ হলো মমতা ব্যানার্জি, অভিষেক ব্যানার্জি। আরএসএস সেই গাছ কাটা তো দূর অস্ত, গাছে জল-সারের যোগান-ই নিশ্চিত করছে। তাই পাতা কাটলেও গাছ কাটার পথে হাঁটবে না সঙ্ঘ!
শুধু তাই নয়, এর আগে আরএসএস’র এরাজ্যের মুখপত্রে গত বছরের অক্টোবর সংখ্যায় সরাসরি অভিষেক ব্যানার্জির গ্রেপ্তারি বা আটকে যে তাঁদের আপত্তি আছে, স্পষ্টতই ছাপার অক্ষরে জানানো হয়েছিল। সঙ্ঘের মুখপত্রে ‘অবোধের গোবধে আনন্দ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে সরাসরি জানানো হয়েছিল অভিষেক ব্যানার্জিকে গ্রেপ্তার করতে চাওয়া আসলে অবোধের গোবধে আনন্দ! অভিষেকের গ্রেপ্তারি দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিছকই ‘ইন্দ্রিয়সুখ’। নিবন্ধে লেখা হয়েছিল- ‘অনেকের কাছে অভিষেকবাবুর যেন-তেন প্রকার আটক ইন্দ্রিয়সুখের শামিল। কেন তিনি আটক হবেন, নির্দিষ্টভাবে তারা জানেন না। অভিষেকের আটক বা গ্রেপ্তার নিয়ে সাধারণের ভাবটা খুব গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না।’
অর্থাৎ পাতা ধরে টান দেওয়া বা মনের খুশিতে একটা পাতা ছিঁড়লেও গাছ কাটা বা গাছ ধরে নাড়ানোর দিকেও আদৌ যাচ্ছে না কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তার বিনিময় মূল্য কী? পাঁচ দফার ভোট শেষে শাসক তৃণমূলের অন্দরেই আশঙ্কা বেশ কয়েকটি নতুন আসনের রফা নয় তো? সন্দেহ আদৌ যে অমূলক নয়, তা পরিষ্কার ঘটনা পরম্পরাতেই। দুই রাজ্যে সরকার চালানোর দলের মাথাকেও ভোট চলাকালীন অনায়াসে গ্রেপ্তার করে ফেলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, অথচ নিয়োগ দুর্নীতি থেকে কয়লা পাচারের অধরা থেকে যায় অভিষেক ব্যানার্জি? চার্জশিটে রেহাই মেলে অনায়াসে!
যেমন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতি।
নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডের চার্জশিটেও এসেছিল মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির প্রসঙ্গ! তবে নিছকই ঘটনার যোগসূত্র স্পষ্ট করতে, কিন্তু ‘অভিযুক্ত’ হিসাবে নয়। সেই যোগসূত্রেই স্পষ্ট নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি অথচ ইডি সেই প্রসঙ্গ এড়িয়েছে ‘গাছ না কাটার’ লক্ষ্যেই।
গত বছরের জুলাই ইডির তরফে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে একটি অতিরিক্ত চার্জশিট দায়ের করা হয়। নিয়োগ কাণ্ডেই ধৃত অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকুর বিরুদ্ধে এই চার্জশিট দায়ের করা হয়। মোট ১২৬ পাতার চার্জশিট। ৭৫ নম্বর পাতায় রয়েছে অভিষেক ব্যানার্জির নাম। ‘সুজয় ভদ্র সেই সময় অভিষেক ব্যানার্জির আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি দেখভাল করতেন। সেই সময় অভিষেক ব্যানার্জি যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। সুজয় ভদ্র তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের অফিসেও নিয়মতি যাতায়াত করতেন। মূলত অভিষেক ব্যানার্জির হয়ে বার্তা মানিক ভট্টাচার্যের কাছে পৌছ দিতেই তিনি যেতেন’। অর্থাৎ অভিষেক ব্যানার্জির বার্তাবাহক হয়েই ধৃত মানিক ভট্টাচার্যের অফিসে যেতেন সুজয় ভদ্র। ২০১৪’র টেটে ঐ ৩২৫জনকে পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য ঐ চাকরি প্রার্থীদের নথি সুজয় ভদ্র মানিক ভট্টাচার্যের কাছে দিয়েছিলেন। কুন্তল ঘোষ বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে যে ৩২৫ জন প্রার্থীর তালিকা তৈরি করেছিলেন তা অভিষেক ব্যানার্জির নির্দেশেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল কালীঘাটের কাকুর আছে আর কালীঘাটের কাকু সেই ৩২৫জনের তালিকাই মানিক ভট্টাচার্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন অভিষেক ব্যানার্জির ‘বার্তাবাহক’ হয়ে! অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের নিয়োয়ের ক্ষেত্রে কালীঘাটের কাকুর মারফতই অপারেশন চালিয়েছিল অভিষেক! তারপরেও চার্জশিটে অভিযুক্ত হিসাবে নেই তাঁর নাম!
শুধু তাই সেই চার্জশিটেই জানা নিয়োগ দুর্নীতির টাকা ঢুকেছিল অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেডে। সেই টাকার পরিমাণ ৯৫ লক্ষ টাকা। ২০২০ সালের ফেব্রয়ারি থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে সেই টাকা ঢুকেছিল ব্যানার্জির পরিবারের ঐ পারিবারিক সংস্থায়। আরও তাৎপর্যের হলো কয়লা পাচার কাণ্ডেও মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে এই ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ নামক সংস্থায় কয়লার টাকা ঢুকেছে বলে নির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছিল ইডি। সেই টাকার পরিমাণ ছিল ৪কোটি ৩৭ লক্ষ। ঘুরপথে অভিষেক ঘনিষ্ঠ কালীঘাটের কাকুর সংস্থা এসডি কনসালটেন্সির মাধ্যমেই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২১’র জানুয়ারি পর্যন্ত তিন দফায় মোট ৯৫লক্ষ টাকা ঢুকেছিল লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে।
এবার কয়লা পাচারের তদন্ত। তখন করোনা পর্ব। সেই লকডাউনের সময়তেই পর্বেই ১০৯ দিনে ১৬৮ কোটি টাকা পাচার হয়। দৈনিক ১ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা! স্রেফ ভাউচারে সই করে মিলেছিল এই বিপুল পরিমাণ টাকা। ইডি’র সূত্র বলছে, তার সিংহভাগ টাকাই বর্তমানে ফেরার, প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দ্বীপরাষ্ট্রের বাসিন্দা বনে যাওয়া অভিষেক ঘনিষ্ঠ বিনয় মিশ্রের নির্দেশে হাওলার মাধ্যমে যায় ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রী ও শ্যালিকার অ্যাকাউন্টে। এই বিপুল আর্থিক লেনদেন হয়েছে ২০২০ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। শুধু তাই নয় দিল্লির রাউস এভিনিউ কোর্টের ইডি‘র তরফে দায়ের প্রসিকিউশন কমপ্যানায়েন্টে দাবি কয়লাকাণ্ডেই ধৃত পুলিশ আধিকারিক অজয় মিশ্রর বয়ান উল্লেখ করা হয়েছিল। একসময় ভাইপো সাংসদের নির্বাচনী কেন্দ্রের অন্তর্গত ডায়মন্ডহারবারের বিষ্ণুপুর থানায় কিছুদিনের জন্য উত্তরবঙ্গে বদলি। তারপর পাকাপাকিভাবে আসেন বাঁকুড়া থানায়। প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা এই পুলিশ আধিকারিকের মাধ্যমে পৌঁছে যেত দক্ষিণ কলকাতায় নির্দিষ্ট ঠিকানায়। লালার ডায়েরিতেও মিলেছে সেই যোগের নথি।
তারপরেও চার্জশিটে রেহাই। কারণ পাতা কাটলেও গাছ কাটবে না মোদী-শাহ।
Abhishek RRS
পাতা কাটলেও ‘গাছ’ কাটতে চায় না সঙ্ঘ
×
Comments :0