Post Editorial

সংগ্রামের এক জীবন

উত্তর সম্পাদকীয়​

এম এ বেবি


ভারতের জীবিত কমিউনিস্টদের মধ্যে কমরেড ভি এস অচ্যুতানন্দন ছিলেন প্রবীণতম। এই বিপ্লবী নেতার উদ্দেশ্যে শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে যেভাবে অসংখ্য মানুষ সমবেত হয়েছিলেন তা বর্ণনার অতীত। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যারা একসময় সরাসরি তাঁর সহকর্মী হিসাবে একসঙ্গে কাজ করেছেন, মধ্যবয়সি যারা তাঁর নেতৃত্বের দক্ষতা প্রত্যক্ষ করেছেন, যুবরা যারা তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা হিসাবে দেখেছেন, এমনকি যে শিশুরাও শেষ যাত্রায় উপস্থিত হয়েছিল। ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে শেষ কয়েক বছর জনজীবনে অনুপস্থিত থাকায় যারা তাঁকে শুধু গল্পেই জেনেছে এমন সকলেই জাতীয় সড়কের দু-পাশে ভিড় জমিয়েছিল।
তিরুবনন্তপুরম থেকে আলাপ্পুঝা পর্যন্ত ১৫০ কিলোমিটার রাস্তা। সাধারণত এই পথ পেরোতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। শেষবারের মতো প্রিয় নেতাকে একঝলক দেখার তীব্র ইচ্ছার কথা মাথায় রেখে ধারণা করা হয়েছিল যে কমরেড ভি এস-এর এই অন্তিম যাত্রাপথ শেষ হতে অন্তত ৮ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু বাস্তবে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় গেল ২২ঘণ্টা। এর একমাত্র কারণ বিপুল সংখ্যক মানুষের অদম্য ভিড় যারা রাতভর ধৈর্য ধরে, প্রবল বর্ষা উপেক্ষা করেও একজন শতায়ু কমিউনিস্ট নেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে অপেক্ষা করেছেন।
এই জমায়েতে মহিলা ও তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছিল ব্যতিক্রমী যা আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। ‘ভি এস আমাদের নয়নের মণি’– শেষ যাত্রাপথ জুড়ে এই স্লোগানে আকাশ বারবার মুখরিত হয়েছে!
তাঁকে আমি প্রথমবার সামনে থেকে দেখি ১৯৭০ সালে, কোল্লাম রেলওয়ে স্টেশন মাঠে সিপিআই(এম)’র একটি রাজনৈতিক জনসভায়। তখন তাঁর দেহ বলিষ্ঠ ও দৃঢ়। তাঁর বক্তৃতা হতো আবেগপ্রবণ, তীব্রতায় ভরপুর, জোরালো হাতের নানা অঙ্গভঙ্গি— সব মিলিয়ে এতে প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রম হতো। বক্তৃতার শেষে তিনি ঘেমে নেয়ে একেবারে ভিজে যেতেন, পরনের কুর্তাটি গায়ে সেঁটে থাকত— সেই দৃশ্যটা আজও আমার মনে গেঁথে আছে।
জরুরি অবস্থা শেষ হওয়ার পর, ১০ম পার্টি কংগ্রেসের প্রাক্কালে আমি সিপিআই(এম)’র কোল্লাম জেলা কমিটির সদস্য হই। তখনই তাঁর সঙ্গে এবং তাঁর নেতৃত্বের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়। শুরুতে তিনি কঠোর ও রুক্ষ স্বভাবের বলে আমার মনে হয়েছিল। তবে একটা ঘটনা আজও মনে আছে, যেটা তাঁর সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিল।
১৯৮০ সালে কমরেড ই কে নায়নার কেরালার মুখ্যমন্ত্রী হলে ভি এস পার্টির রাজ্য সম্পাদক হন। ১৯৮৫ সালে কোচিতে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্মেলন চলাকালীন এম ভি রাঘবনের বিকল্প নথি ঘিরে বিতর্কের কারণে বিশেষভাবে আলোচনা হয়েছিল। তবে ঐ সম্মেলনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও হয়, তা হলো— পার্টি নেতৃত্বের উচিত বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের সঙ্গে আরও সহানুভূতিশীল ও আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
এর ঠিক কয়েক সপ্তাহ পরের ঘটনা। কোল্লামের পোলায়াথোড়ে জেলা কমিটির অফিসের বারান্দায় বসে আমরা সংবাদপত্র পড়ছিলাম, হঠাৎ ভি এস সেখানে এলেন। সাধারণত তিনি সরাসরি জেলা সম্পাদকের ঘরে চলে যেতেন কারণ তাঁর সময়সূচি থাকত খুবই আঁটোসাঁটো। কিন্তু সেদিন তিনি সে রুটিন ভাঙলেন। আমাদের সকলকে নমস্কার করলেন, কুশল জিজ্ঞাসা করলেন এবং কয়েক মিনিট আমাদের সঙ্গে কথা বলে ভিতরের ঘরে গেলেন।
যাঁরাই এর্নাকুলাম সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, তারা নিশ্চয়ই এমন পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন। ঐ ঘরে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে যেন একজন প্রকৃত কমিউনিস্টের অন্তর্নিহিত গুণটি প্রকাশ পেয়েছিল। ঐ গুণই আমাদের মধ্যে আত্মসমালোচনা ও নিজেকে পরিবর্তন করার মানসিকতা গড়ে দেয়।
ভি এস-এর ব্যক্তি জীবন ও রাজনৈতিক জীবন ছিল এক নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ সংগ্রামের পথ। এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। মাত্র চার বছর বয়সে মাকে হারান, এগারো বছর বয়সে বাবা মারা যান। এই পরিস্থিতির জন্যই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। যখন তাঁর সমবয়সিরা স্কুলে পড়ত, তিনি বড় দাদার কাছে দরজির কাজ শিখতে শুরু করেন। পরে ‘অ্যাস্পিনওয়াল’ কোম্পানিতে নারকেল জালের কারখানায় কর্মী হিসাবে যুক্ত হন। সেই কাজই তাঁকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিংবদন্তি সংগঠক কমরেড পি কৃষ্ণ পিল্লাই কুট্টানাড় অঞ্চলে খেতমজুরদের সংগঠিত করার গুরুদায়িত্ব সেদিনের তরুণ কমরেড ভি এস-এর হাতে তুলে দেন। পুন্নাপ্রা-ভয়ালার অভ্যুত্থানের পর ভি এস আত্মগোপনে চলে যান। সেভাবেই পার্টির কাজ চালিয়ে যান। পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁর উপর ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।
তবুও যে সংগ্রাম তিনি যৌবনে শুরু করেছিলেন তা কখনো থেমে যায়নি— ১০১ বছর বয়স পর্যন্ত। এমনকি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকার সময়ও সেই সংগ্রামী চেতনা অটুট থেকেছে।
কেরালার সংগ্রামী ইতিহাসে ভি এস-এর সবচেয়ে স্থায়ী অবদান হলো কুট্টানাড়ে খেতমজুরদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর পথপ্রদর্শকের ভূমিকা। তাদের মাথা উঁচু করে নিজেদের অধিকারের দাবি করতে শেখানো। পি কৃষ্ণ পিল্লাই তরুণ ভি এস-এর মধ্যে এক অসাধারণ সাংগঠনিক সম্ভাবনা দেখতে পান। কুট্টানাড়ে অসংগঠিত খেতমজুরদের লাল পতাকার তলে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব তাঁকে সেজন্যই দেওয়া হয়।
সাহসিকতা আর নির্ভীক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভি এস সেখানে খেতমজুর আন্দোলনের ভিত গড়ে তোলেন। যারা এতদিন পশুর মতো জীবনে অভ্যস্ত ছিল তাঁরা সোজা হয়ে দাঁড়াল, মুষ্টিবদ্ধ প্রতিবাদী হাত তুলল। আর তখনই ধানখেত থেকে গর্জে উঠল সেই ঐতিহাসিক স্লোগান: ‘আমরা দাস নই, আর কখনো আমরা মাথা নত করব না!’
ঐ স্লোগান আজও গণসংগঠক ভি এস-এর এক অমর সাক্ষ্য।
রাজনৈতিক হোক বা সাংগঠনিক, যত কঠিন দায়িত্বই হোক না কেন ভি এস-এর কাঁধে সেটা নিশ্চিন্তে তুলে দেওয়া যেত। তিনি কখনও ব্যর্থ হননি।
সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সিপিআই’র জাতীয় পরিষদ থেকে ১৯৬৪ সালে যে বত্রিশ জন নেতা বেরিয়ে আসেন, ভি এস ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন। এ দিক থেকেও তিনি ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এক এমন অধ্যায়ে পরিণত হয়েছেন, যাকে মুছে ফেলা যায় না।
১৯৬৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিনি মোট দশটি নির্বাচন লড়েছেন— যার মধ্যে সাতবার জয়ী হয়েছে, তিনবার পরাজিত। কিন্তু কোনও পরাজয়ই তাঁর দৃঢ় সংকল্পকে ভাঙতে পারেনি। পরিবেশ রক্ষা, মহিলাদের অধিকার সহ আরও বিভিন্ন ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক খাঁটি বিপ্লবীর চেতনা নিয়ে তিনি লড়েছেন।
এক সময় মিডিয়া তাঁকে উপহাস করত। কিন্তু পরে, সেই সংবাদমাধ্যমই তাঁকে ‘জনগণের নেতা’ বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
কোনও প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা না থাকলেও দায়িত্ব পালনে তা কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কাজের মধ্য দিয়েই তিনি জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকে অর্জন করেছিলেন। ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি কেরালা বিধানসভার সদস্য ছিলাম।  
মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা হিসাবে তাঁর কাজ করার পদ্ধতি আমি সামনে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। যে কোনও বিষয় তাঁর কাছে উপস্থাপিত হলে তিনি তা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিবেচনা করতেন, তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল তীক্ষ্ণ ও কার্যকর।
এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ২০০৬-’১১ সালের এলডিএফ সরকারে মুখ্যমন্ত্রী ভি এস-এর নেতৃত্বে কেরালায় আইটি@স্কুল প্রকল্পের বাস্তবায়ন। সে সময় আমি তাঁর মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী ছিলাম।
আইটি@স্কুল প্রকল্পটি শুরু হয় ‘আই টি ইন এডুকেশন: ভিশন ২০১০’ রিপোর্টের ভিত্তিতে। ১৯৯৬–২০০১ নাগাদ তৎকালীন এলডিএফ সরকারের সময় কমরেড নায়নার’র মুখ্যমন্ত্রিত্বে গঠিত অধ্যাপক ইউ আর রাও-র নেতৃত্বাধীন এক কমিটি ঐ রিপোর্ট জমা দেয়।
কিন্তু পরবর্তী ইউডিএফ সরকারের (২০০১–০৬) সময় কেরালার তথ্যপ্রযুক্তি-শিক্ষা কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিশেষ করে মাইক্রোসফট-এর মতো কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়া হতে থাকে। এ নিয়ে রাজ্যজুড়ে প্রবল উদ্বেগ দেখা দেয়।
তৎকালীন বিরোধী দলনেতা হিসাবে ভি এস এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেন। ২০০৬ সালে এলডিএফ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এলে জনশিক্ষায় ফ্রি সফটওয়্যা র প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে।
২০০৭ সালে এলডিএফ সরকার ঘোষিত ‘আইটি নীতি’ কেরালাকে ফ্রি সফটওয়্যা রের জগতে প্রবেশের দরজা খুলে দেয়। ২০০৮ সালের মার্চের মধ্যেই কেরালার সরকারি ও সরকার-পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ফ্রি সফটওয়্যা রে রূপান্তর করা সম্পন্ন হয়।
ঐ নীতির সুবাদেই তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে আলাদা করে শেখার বদলে ছাত্র-ছাত্রীরা তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নিতে শুরু করে। ২০০৮ সালের মধ্যেই সমস্ত সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিকে বিএসএনএল-এর মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদান করা হয়।
এরপর ২০১৬–২০২১ সালের এলডিএফ সরকারের আমলে, পিনারাই বিজয়নের মুখ্যমন্ত্রিত্বে প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতেও ব্রডব্যান্ড ব্যবস্থার সম্প্রসারণের পরবর্তী ধাপটি সম্পন্ন হয়।
আইটি@স্কুল কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা (যার ৭৫ শতাংশ খরচ কেন্দ্র ও ২৫ শতাংশ রাজ্য বহন করবে) অনুযায়ী ২০০৭-০৮ সালে ১,০১৬টি বিদ্যালয়কে অনুদান দেওয়া হয়। এ কাজে অগ্রগতির মূল্যায়নের পর আরও ৩,০৫৫টি বিদ্যালয়কেও পরবর্তীতে ঐ প্রকল্পে যুক্ত করা হয়। মোট ৪,০৭১টি বিদ্যালয়ে পাঁচ বছরে ২৭০ কোটি টাকার মূল্যের ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, প্রিন্টার, ডিজিটাল ক্যামেরা, টিভি এবং জেনারেটর ইত্যাদি সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীদের সাহায্যে ভাঙা কম্পিউটার মেরামত করার হার্ডওয়্যা র ক্লিনিকগুলো একটি অনন্য মডেল হিসাবে নজর কেড়ে নেয়। ফ্রি সফটওয়্যা র ব্যবহারের নীতি সহজ ও কার্যকর হবে কি না এ সন্দেহ থাকলেও আইটি@স্কুল এবং কেরালা ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড টেকনোলজি ফর এডুকেশন (কাইট) প্রোগ্রাম শুধু এর কার্যকারিতাকেই প্রমাণ করেনি, আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী রাজ্য সরকারের প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা সাশ্রয়ও হয়েছে।
ইউনিসেফ কেরালার এই ডিজিটাল শিক্ষা মডেলকে শুধুমাত্র গ্লোবাল সাউথের জন্য নয় উন্নত দেশগুলির জন্যও সারা বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এই পরিবর্তনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল ভি এস-এর নেতৃত্বে এলডিএফ সরকার।
ভি এস একজন অনন্য কৌশলীও ছিলেন। ১৯৫৮ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি অমৃতসর কংগ্রেস চলছিল। তখনই দেবিকুলমে উপনির্বাচন চলছিল। তখনকার EMS সরকারের জন্য ঐ নির্বাচন ছিল এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। পার্টির অনুরোধে ভি এস পার্টি কংগ্রেস ছেড়ে এসে সরাসরি ঐ নির্বাচনের কাজে বিশেষত প্রচারের কাজ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন। তিনি কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন না, তবুও তাঁকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত করা হয়।
কঠিন প্রতিযোগিতার শেষে নির্বাচনে পার্টির প্রার্থীই জয়ী হন। এটি ছিল ভি এস-এর দক্ষ রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনার ফলাফল। ঐ প্রচারে ইলাইয়ারাজা ও তাঁর ভাই গঙ্গাই আমরানও বিপ্লবী গান গেয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ভি এস বুঝতে পেরেছিলেন রাজনৈতিক সংগ্রামে সাংস্কৃতিক দিক থাকাও জরুরি, ঐ কর্মসূচিই তার প্রমাণ।
কেরালায় জীবনযাত্রার মান ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে উন্নত একথা ব্যাপকভাবেই স্বীকৃত। সেই উন্নতির পিছনে ভূমি সংস্কারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ বিষয়ে বহু গবেষণায় দিকনির্দেশ করা হয়েছে। ১৯৫৭ সালে ইএমএস সরকারের উদ্যোগে কেরালায় ভূমি সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারটি স্বীকৃত হলেও অনেকেই ভুলে যান যে ভি এস-ও ভূমি সংস্কার বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
১৯৬৯ সালে দ্বিতীয়বারের ইএমএস সরকার কংগ্রেস ও তাদের জোট বাহিনীর কাছে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও ভূমি সংস্কারের কার্যকর বাস্তবায়নের দাবিতে সিপিআই(এম) সহ কৃষকসভা ও খেতমজুর ইউনিয়ন প্রতিবাদ শুরু করে। কৃষক সঙ্ঘম ও কৃষক-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে অর্ভুকাদ, আলাপ্পুঝায় ব্যাপক জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ভি এস-এর নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালের ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর হাজার হাজার প্রতিবাদী ঐ জায়গায় একত্রিত হন।
তৎকালীন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড পি সুন্দরাইয়া, পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য কমরেডস ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ এবং একে গোপালন সহ কৃষকসভার নেতা কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙারও ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি ভূমি সংস্কার আইনকে অনুমোদন দিতে অস্বীকার করলে একে গোপালন ঘোষণা করেন আইন বাস্তবায়ন করবে জনগণ নিজেই।
এরপরে যে সংগ্রাম শুরু হয়, সেখানে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক ভি এস-এর নেতৃত্বে কেরালার বিভিন্ন জায়গায় অতিরিক্ত জমি দখল করেন, লাল পতাকা লাগান এবং জমির মালিকানা দাবি করেন। নারকেল গাছে চড়া থেকে শুরু করে জনপ্রিয় নিয়ন্ত্রণ (পপ্যুলার কন্ট্রোল) ঘোষণা করা পর্যন্ত তারা পুলিশি নির্মমতা, হিংস্র আক্রমণ, গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ড সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যান। এই সংগ্রামে ১৮ জন কমরেড শহীদ হন। শহীদের মধ্যে ছিলেন কাবালম শ্রীধরণ, কল্লিকাদ নীলকণ্ডন এবং ভার্গবী।
রক্তাক্ত এ সংগ্রামের ফলে প্রায় ২.৮ মিলিয়ন ভূমিহীন কৃষক ও আড়াই লক্ষাধিক ভূমিহীন পরিবার জমির মালিকানা পেয়েছিলেন। আরভুকাদ প্রতিবাদ ছিল শতাব্দী প্রাচীন জাতিবিদ্বেষী জমিদারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করাই ছিল ভি এস-এর জীবনের মূল লক্ষ্য।
এক স্মরণীয় মুখ্যমন্ত্রী, একজন বিশাল মাপের জননেতা এবং কেরালার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলনেতা হিসাবে ভি এস চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দরজি ও নারকেল জাল শ্রমিক থেকে শুরু করে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণআন্দোলন ও সরকারের শিখরে পৌঁছেছিলেন তিনি। সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সংগ্রামের স্বরূপ।
একজন খাঁটি শ্রমজীবী আন্দোলনের নেতা হিসাবে তিনি কারিগর থেকে শিখরে উঠে এসেছিলেন। নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও প্রতিরোধের এমন এক জীবন যা বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীকে সংযুক্ত করেছিল— সেই ব্যক্তিত্বেরই নাম ভি এস।
 

Comments :0

Login to leave a comment