Dengue

মাঝ নভেম্বরেও বাড়ছে ডেঙ্গু, প্লেটলেটের হাহাকার রাজ্যে

রাজ্য

Dengue increasing

শুক্রবার থেকে শনিবারের মধ্যে রাজ্যে প্রায় ১ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য দপ্তর জানিয়েছে। প্রতিদিনেরই একই চিত্র। পরীক্ষার সংখ্যা বাড়লেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন বেসরকারি সূত্র থেকে যে খবর মিলছে তাতে এপর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৯০ পেরিয়ে গিয়েছে। অথচ মৃত্যু সংখ্যা গোপন করেছে সরকার। ওদিকে রাজ্যের মোট আক্রান্তের সংখ্যা চলতি মরশুমে এখনও পর্যন্ত ৭০ হাজারের আশেপাশে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের মধ্যে কলকাতা-বিধাননগর, হাওড়া, হুগলী, উত্তর ২৪ পরগনা, শিলিগুড়ি, মুর্শিদাবাদে ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ, বাড়ছে ম্যালেরিয়াও। সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রক্ত পরীক্ষা করালেও অনেকক্ষেত্রেই ডেঙ্গুর পজিটিভ রিপোর্ট চেপে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ বলছে, সঙ্কটজনক অবস্থায় বহু মানুষ প্লেটলেট পাচ্ছেন না হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রশাসনের ব্যর্থতার দিকে আঙ্গুল তুলেছেন মানুষ। সচেতনতা প্রচারে এলাকায় এলাকায় পথে নেমেছেন বাম ছাত্র-যুব-মহিলারা। শিলিগুড়িতে চলছে সিপিআই(এম) কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডভিত্তিক পরিক্রমা।
মশা কামড়ালেই মানুষ আতঙ্কে ভুগছেন যে জ্বর আসছে কিনা। আর জ্বর হলেই সর্বপ্রথম চিন্তা তা ডেঙ্গু কিনা এবং হাসপাতালে বা ব্লাড ব্যাঙ্কে প্লেটলেট মিলবে কিনা। ভয়ঙ্কর আকাল দেখা দিয়েছে প্লেটলেটের। রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলি সহ বিভিন্ন হাসপাতাল পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে তাদের প্লেটলেটের ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। রোগীর পরিবারকেই দাতা জোগাড় করতে হবে। অবস্থা এমনই যে, বেসরকারি হাসপাতালের তরফে বলা হচ্ছে, মজুত থাকলে রোগীকে রক্ত দেওয়া যেতে পারে কিন্তু সেই রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে কাউকে সেই সম পরিমাণ রক্ত হাসপাতালে দান করলে ভালো হয়, কারণ পর্যাপ্ত রক্তের অত্যন্ত অভাব রয়েছে। রোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকেই এই বক্তব্য মিলছে। রক্তদান আন্দোলনের নেতা ও মেডিক্যাল ব্যাঙ্কের সম্পাদক ডি আশিস বলেন, সত্যিই রক্তের জোগানের পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। প্রতিদিন রাজ্যে প্রায় ৪ হাজার ইউনিট রক্ত দরকার হয়। তার থেকে প্লেটলেট তৈরি করতে ৪-৬ ঘণ্টা লাগে। আবার প্লেটলেট বেশিক্ষণ সঞ্চয় করেও রাখা যায় না। ফলে রক্তের জোগান আসবে এবং তা থেকে প্লেটলেট তৈরি হবে— এটা সময়সাপেক্ষ। সরকারি পরিকাঠামো, প্রয়োজনীয় কর্মীর অত্যন্ত অভাবে গোটা প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত হয়ে পড়ে। যে হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে তাতে এই পরিস্থিতিতে স্বভাবতই রক্তের হাহাকার তৈরি হবে হাসপাতালগুলিতে এবং বাস্তবে তাই ঘটছে। 
অন্যদিকে রক্ত পরীক্ষার পর ডেঙ্গু পজিটিভ রিপোর্ট চেপে দেওয়ারও অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে। অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হিসাবে অন্য তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছে। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়িতে এরকম নানা নমুনার উল্লেখ করেছেন সিপিআই(এম) কাউন্সিলররাও। অতি সম্প্রতি বারাসত জেলা হাসপাতলে মৃত্যু হয়েছে দেগঙ্গার বাসিন্দা হামিদা বিবির। চিকিৎসকরা পরিবারের সদস্যদের রোগীর ডেঙ্গু হয়েছে বললেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গুর কথা বেমালুম চেপে মৃত্যুর অন্য কারণ দেখিয়েছে বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়, বিক্ষোভ দেখান মৃতার পরিজনরা। আরও ভয়ঙ্কর অভিযোগ উঠেছে খোদ কলকাতা থেকেই। দিন কয়েক আগে চেতলা অঞ্চলের এক বাসিন্দার অভিযোগ ছিল, কয়েকদিন ধরে তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। ডেঙ্গু হতে পারে, এই সন্দেহে তিনি সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েছিলেন রক্ত পরীক্ষা করাতে। কিন্তু পরীক্ষায় তাঁর ডেঙ্গু সংক্রমণ ধরা পড়েনি। এরপর জ্বর না কমতে থাকায় এক বেসরকারি ল্যাবে রক্ত পরীক্ষা করালে সেখানে ডেঙ্গু সংক্রমণ ধরা পড়ে। মহানগরের বিভিন্ন এলাকা থেকেই এমন অভিযোগ আসছে। এলাকাবাসীদের বক্তব্য, ডেঙ্গু সংক্রমণকে চেপে যাওয়া, আড়াল করার লক্ষ্যে এই ছলচাতুরি চলছে, যেমন এর আগে চলেছে করোনার সময়ে।


রাজ্য জুড়ে প্রায় মহামারীর আকার নিয়েছে ডেঙ্গু, ফলে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, বলছেন চিকিৎসকরাই। শুধু ডেঙ্গু নয়, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপও। কোভিডের মতো এই দুটি রোগেরই যাবতীয় তথ্য চেপে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে নবান্ন। কেন্দ্রকে তথ্য দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ভেক্টর বর্ন ডিজিজেস কন্ট্রোল’র তথ্য বলছে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত রাজ্যে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তারপর থেকে আর কোনও তথ্যই দেওয়া হয়নি ম্যালেরিয়া নিয়ে। ডেঙ্গু নিয়ে সম্প্রতি প্রবল হই চই হওয়ায় কিছু কিছু তথ্য নবান্ন থেকে মিলছিল, গত ১২ দিন যাবৎ তাও দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী পরিষ্কারই বলেছেন, এ রাজ্য কোনও তথ্য কেন্দ্রকে জানাচ্ছে না। চিকিৎসকরা বলছেন, এর ফলে বাস্তব পরিস্থিতি প্রকাশ পাচ্ছে না। এবং সেই কারণে ডেঙ্গু মোকাবিলার সঠিক পরিকল্পনার অভাব হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে হাসপাতালের বেড এবং রক্তের জোগানের ওপরেও। ওদিকে ডেঙ্গু কবলিত এলাকায় সাফাইয়ের কাজ নিয়েও ক্ষোভ ক্রমশ চরমে উঠছে রাজ্যবাসীর। ক্ষোভ, মশা মারার তেল ইত্যাদি বা ব্লিচিং পাউডারের বিশুদ্ধতা নিয়েও। 
শনিবার হুগলীর বৈদ্যবাটিতে এক কিশোরীর মৃত্যুর পর পৌরসভার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, মশা নিধন করতে যে তেল ব্যবহার করা হয় সেটা তেল নয় জল। শুধু তাই নয়, যে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা হয় তাতে চুন মেশানো হয়। তাতে ব্লিচিং পাউডারের কোনও গন্ধ বা ধক থাকে না। এলাকায় এলাকায় পুকুরগুলো সমস্ত আবর্জনায় ডুবে রয়েছে। একই অবস্থা রাস্তঘাট, ফাঁকা জমিতেও। বহু দিন থেকেই একই অভিযোগ এসেছে শিলিগুড়ি সহ ডেঙ্গু কবলিত বিভিন্ন জেলার নানা অঞ্চল থেকে। ফলে মশার কামড়ে ডেঙ্গু অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন বেসরকারি সূত্রে জানা যাচ্ছে এপর্যন্ত কলকাতা-বিধাননগর এলাকাতেই অন্তত ৩৫জনের মৃত্যু হয়েছে। হাওড়া-বালি এলাকায় এই সংখ্যা ১০ ছাড়িয়েছে। শিলিগুড়িতে মৃত্যু সংখ্যা প্রায় ২০ বলে জানা যাচ্ছে, হুগলীতেও এপর্যন্ত ১০ জন মারা গেছেন বলে জানা যাচ্ছে। এছাড়া উত্তর ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ১৫-র আশেপাশে বলে খবর।

Comments :0

Login to leave a comment