প্রথমে উত্তর প্রদেশ, পরে উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকার ধর্মাচারীদের কাঁওয়ার যাত্রাপথের সর্বত্র খাবারের দোকানে মালিক ও কর্মচারীদের নাম স্পষ্ট অক্ষরে লিখে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। সরকারের দাবি এর ফলে পুণ্যার্থীরা তাদের পছন্দের খাবারের দোকান নির্বাচন এবং খাবারের গুণমান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারবেন। সরকার মনে করছে যারা কাঁওয়ার যাত্রায় যান তারা দোকানের মালিকের ও কর্মীর নাম না জানলে খাদ্যের গুণ ও দোকান নির্বাচন করতে অক্ষম। এই অক্ষমরা প্রতিদিন তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার বা খাদ্যপণ্য যে সব দোকান থেকে কেনেন বা অনলাইনে কেনেন সেইসব দোকান বা অনলাইন সংস্থার মালিক ও কর্মচারীদের নাম জানার জন্য কি মোদী সরকারের কোনও নির্দেশ আছে? না থাকলে শুধু ধর্মযাত্রার সময় এমন নির্দেশ কেন? যদি মালিক কর্মচারীর নাম জানা খাদ্যগুণ বিচারের মাপকাঠি হয় তাহলে বাজারে বিক্রি হয় এমন লক্ষ লক্ষ পণ্যের গায়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মালিকের ও কর্মচারীদের নাম লিখে দিতে হয়। যোগী সরকারের নির্দেশ যদি মোদী সরকার সমর্থন করে থাকে তাহলে তো মোদীকে অবিলম্বে ভারতে বিক্রিত সমস্ত ধরনের খাদ্যপণ্যের উৎপাদক সংস্থার ও বিপণন সংস্থার মালিকের ও কর্মচারীদের নাম প্রকাশ্যে লিখে দেবার বিজ্ঞপ্তি অবিলম্বে জারি করতে। যদি না করে তাহলে বুঝতে হবে যোগীর নির্দেশের আড়ালে শয়তানি লুকিয়ে আছে।
শ্রাবণ মাসে হরিদ্বারের গঙ্গা থেকে জল নিয়ে বাঁকে করে ঘরে ফেরেন যারা তাদের কাঁওয়ারিয়া বলে। আর এই যাত্রা কাঁওয়ার নামে পরিচিত। গোটা উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড সহ আশপাশের রাজ্য থেকে যারা কাঁওয়ারে যান তারা হিন্দু ধর্মাচারী। যাত্রা পথে মুসলিম বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অথবা নানা জাত-পাতের দোকানগুলিকে চিহ্নিত করে দেবার জন্যই পরিকল্পনা করে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুসলিম এবং উঁচু জাত, নিচু জাতের দোকান চিহ্নিত করে দিতে পারলে মুসলিম ও নিচুজাতের দোকানগুলি বয়কট বা বাতিলের রাস্তা প্রশস্ত করা যাবে। সচেতনভাবে ধর্মীয় ও জাতপাতের বিভাজনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। কাঁওয়ার যাত্রীদের মধ্যে সুকৌশলে ধর্মীয় ও জাতপাতের ঘৃণা-বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার ব্যবস্থা হয়েছে। আর এই সুযোগে যদি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে গোলমাল বাধিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তখন তাকে ঘিরে শুরু হবে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক প্রচার যে বিজেপি’র রাজনীতির প্রধান অস্ত্র।
বহু বছর ধরে এইযাত্রা চললেও কোনোদিন কোনও সমস্যা হয়নি। এবছর লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর ঘুরে দাঁড়াবার আর কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে যোগী সেই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক মেরুকরণের রাস্তাতেই ফিরে এসেছে। এই হঠকারী নির্দেশের ফলে বরাবর যেসব মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শিবির বানিয়ে কাঁওয়ার যাত্রীদের নানাভাবে সাহায্য করত এবার তারা শিবির করেনি। যেসব মুসলিম দোকানে হিন্দুকর্মী ছিল তারা এবং হিন্দুর দোকানের মুসলিম কর্মীরা কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। নতুন করে কাজ হারাতে হয়েছে অনেক মানুষের। ধর্মীয় বিভাজন এবং মুসলিম বয়কট বা এক ঘরে করার এই কৌশল আরএসএস আমদানি করেছে নাৎসি জার্মানি থেকে। হিটলার এইভাবেই দোকানে বা সংস্থায় মালিকের নাম লেখা বাধ্যতামূলক করে ইহুদীদের চিহ্নিত করে তাদের আর্থিকভাবে বিপন্ন করার ও ভীত সন্তস্ত্র করার ব্যবস্থা করেছিল। হিটলারের অনুগামী হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে সেই ব্যবস্থা কার্যকর করতে চাইছে। এটা ভারতের সংবিধানের এবং ভারত ভাবনা সম্পূর্ণ বিরোধী। অবিলম্বে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করে সমানাধিকার, একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার, একে অপরকে সাহায্য করার মানসিকতাকে জোরদার করার দিকে নজর দেওয়া উচিত।
Comments :0