EDITORIAL

মনুবাদী বুমেরাং

জাতীয়

ভূতের মুখে রাম নামের মতো নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন জাত একটাই সেটা গরিব। তাঁর সরকার নাকি এই গরিবদের জন্যই কাজ করে যাচ্ছে। যে ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দু মতাদর্শের ছাঁচে নরেন্দ্র মোদী তৈরি সেই মতাদর্শের প্রধান ভিত্তি মনুবাদ। সমাজে জাত বিভাজনের মধ্য দিয়েই ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাষ্ট্র চায় তারা। অর্থাৎ সেই রাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকবে উঁচু জাত। এহেন মতাদর্শের ছাঁচে ঢাল মোদী খামোখা জাতপাতের বিষয়টি আড়াল করে গরিবদেরই প্রধান এবং একমাত্র জাত বলে চিহ্নিত করতে গেলেন কেন?
রাজতন্ত্রে বাহ্মণ্যবাদীরা সমাজে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল রাজার আনুকূল্যে। মনুর বিধান মেনেই সেটা হয়েছিল। কিন্তু সত্যিকারের গণতন্ত্রে মনুর সেই সামাজিক বিধান কার্যকর নয়। গণতন্ত্রে মানুষ জাতপাত, ধর্ম বর্ণের ঊর্ধ্বে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত। মনুর দোহাই দিয়ে জাতের বিধান মেনে রাজারা বংশপরম্পরায় ক্ষমতা দখলে রাখতে পারেন বল প্রয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু গণতন্ত্রে সেটা সম্ভব নয়। এখানে নাগরিকদের সিদ্ধান্তেই ঠিক হয় কে সরকারে থাকবে আর কে বিদায় নেবে। জাতের ভিত্তিতে ভোট চাইতে গেলে বিজেপি’র সমূহ বিপদ। কারণ আরএসএস-বিজেপি যে জাত বা বর্ণের আদর্শগত প্রতি‍‌নিধি তারা সমগ্র জনসংখ্যার অতি সংখ্যালঘু অংশ। তাই জাত-বর্ণকে এড়িয়ে তারা ধর্মকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। কারণ সংখ্যার বিচারে হিন্দুরাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। হিন্দু ভোটকে এক করে যদি হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে ভোট বাক্সে ফেলা যায় তাহলে বিজেপি’র জয় অনিবার্য। তাই আগামী লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে হিন্দু‍‌ ভোটের লক্ষ্যে আরএসএস’র পরিকল্পনায় রাম মন্দিরকে ঘিরে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে ‘হিন্দু জাগরণ’ ঘটাতে চায় তারা।
কিন্তু সমস্যা ধর্ম খেয়ে তো পেট ভরে না। হিন্দু হলে দারিদ্র ঘুচে যায় না, বেকারির অবসান হয় না। বাজারে সস্তায় জিনিস মেলে না, কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্যে না। ধর্ম ব্যক্তিগত আচরণ, বিশ্বাস ও অনুসরণের বিষয়। জীবন জীবিকার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা নির্ভর করে সরকারের নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতার উপর। গত সাড়ে ৯ বছর ধরে ধর্ম নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে। সংঘাত-উন্মাদনা ছড়িয়েছে। কিন্তু তাতে গরিবের দুঃখমোচন হয়নি। বেকার কাজ পায়নি। জিনিসের দাম কমেনি। বিপরীতে দুর্দশা ক্রমাগত বে‍‌ড়েছে।
এই বাস্তবতার মধ্যেই বিরোধী দলসমূহ নজর দিতে চাইছে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানটা ঠিক কোথায় বুঝে নিতে। সেই জন্যই জাত গণনা বা জাতভিত্তিক জনগণনা। অর্থাৎ তফসিলি জাতি, উপজাতি, ওবিসি প্রভৃতিরা ঠিক কি অবস্থায় আছে জানা দরকার। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা আদৌ তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে কিনা সেটাও জানা দরকার। বিহারে এমন গণনায় উ‍‌ঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ারাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ তারা হিন্দু। একই ছবি নিশ্চয়ই রাজ্যে রাজ্যে এবং গোটা দেশে। এই সত্য প্রকাশ হলেও মহা বিপর্যয়ের মুখে পড়বেন মোদীরা। তাই জাত গণনার বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে তারা মরীয়া। সে লক্ষ্যেই মোদীকে বলতে হচ্ছে গরিবরাই একমাত্র জাত।

Comments :0

Login to leave a comment