Post Editorial

৫ ছাঁকনি পেরিয়ে ৫৮

উত্তর সম্পাদকীয়​


খবর। ৩টে অক্ষর। কোথায় পাবেন? যে কেউ উত্তর দেবেন - সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, টিভি, রেডিও এবং অধুনা আবিষ্কৃত সোশাল নেটওয়ার্ক ইত্যাদি জায়গা থেকে। সত্যি কি সব খবর পান এখানে? 
না। এককথায় সংবাদমাধ্যমে সব খবর পায় না মানুষ। আবার পাওয়া সব খবর সত্যিও নয়। খবরেরও ছাঁকনি হয়। মানে কোন্‌ খবর যাবে, কোনটা যাবেনা, কোনটা অর্দ্ধেক যাবে, কোন তিলকে তাল করা হবে, কোন তাল'কে আবার বিলকুল হাপিস করতে হবে - এসব ছাঁকনিতে ছাঁকা হয়। 
কেমন ভাবে ছাঁকা হয়? চায়ের পাতা ছেঁকে যেমন শুধু 'তরল চা' কাপে পরিবেশন করা হয়, তেমনই খবর ছেঁকে আমার আপনার সামনে উপস্থিত করা হয়। ছেঁকে 'তরল চা' কাপে ঢেলে আপনাকে দেওয়া যেতে পারে, আবার ছাঁকনিতে থাকা চা পাতাও ডিশে সাজিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কোনটা আপনি পাবেন সেটা নির্ভর করে যিনি চা বানাচ্ছেন তার ওপর বা মূলত তার নিয়োগকর্তার ওপর।
ঠিক একই ভাবে আপনি খবরের লিকার পাবেন না কি চা-পাতা পাবেন, না কি শুধুই গরম বা ঠান্ডা জল পাবেন, না কি চা বাদে শুধু চিনি জল পাবেন, দুধে চা নাকি চায়ে দুধ ঢালা হবে - এটা নির্ভর করে যারা সংবাদ পরিবেশন করছেন তাঁদের ওপর বা মুলত তাদের নিয়োগকর্তাদের ওপর।
মালিকের ছাঁকনি
সংবাদ বা খবরের প্রথম ছাঁকনি হলো - সংবাদ মাধ্যমের মালিকানা। ভারতবর্ষ জুড়ে যে হাজার হাজার পত্র-পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল আছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র কয়েকটি কর্পোরেট কোম্পানি। এরা সংবাদের ব্যবসা থেকে শুরু করে তেল-নুন-সাবান সব কিছুই বেচে। ফলে এটা কি খুব অস্বাভাবিক যে এদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমেগুলোতে এদের স্বার্থবিরোধী কোনো সংবাদ প্রকাশিত হবে না? এছাড়াও এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা যেহেতু তাদের বিভিন্ন ব্যবসার জন্য সরকারের উপর নির্ভরশীল, তাই নিজেদের স্বার্থেই তারা সরকারের সমালোচনার ব্যাপারেও খুবই সাবধানতা নিয়ে চলে এবং সেই ধরনের রাজনৈতিক শক্তিকেই সরকারে চায়, যারা এদের স্বার্থ সিদ্ধি করবে। সেইজন্যই একটা টিভি কোম্পানির সঞ্চালিকা সরাসরি ঘোষণা করেন নির্দ্ধিধায় - এই চ্যানেলের মালিক যেহেতু আম্বানি, তাই তাঁর সমালোচনা এখানে করা যাবে না।
৫৮টি বড় সংবাদ মাধ্যম মুলত ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠককে খবর স্রবরাহ করে থাকে। ৫ বছর আগে 'মিডিয়া ওনারশিপ মনিটর' নামে একটি বেসরকারি সংস্থা প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল দেশের হিন্দি ছাপা সংবাদ মাধ্যমের বাজার মূলত ৪ টি মালিকানার দখলে আছে। হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত এই ৪ টি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যম পাঠকের ৭৬.৪৫% দখল করে আছে৷ 
একইভাবে, আঞ্চলিক ভাষার সংবাদ মাধ্যমের ওপরও একই রকম দখলদারি রয়েছে। ওই একই সমীক্ষায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এই বাজারের দখলদারিতেও রয়েছে সবচাইতে বড় ২ টি সংবাদপত্র। এরাই ৫০% বা তারও বেশি বাজার দখল করে আছে। উদাহরণস্বরূপ, ৫ টি তামিল সংবাদপত্রের মধ্যে, শীর্ষ দুটি সংবাদপত্র দুই তৃতীয়াংশ বাজারকে নিয়ন্ত্রন করে। একইভাবে, তেলেগু ভাষার ২ টি সংবাদপত্র ৭১.১৩% বাজার  নিয়ন্ত্রন করে। এই একই প্রবণতা বাংলা, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, কন্নড়, গুজরাটি, উর্দু, মারাঠি, অসমীয়া সহ সমস্ত আঞ্চলিক বাজার জুড়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
একইভাবে যে দু’টি লুটেরা লগ্নি পুঁজির শীর্ষ স্থানীয় কোম্পানি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাণের মিত্র, তারা এখন সংবাদ মাধ্যম দখলের অভিযানে নেমেছে। নেটওয়ার্ক ১৮, ফার্স্ট পোস্ট, সিএনএন-নিউজ ১৮ ইত্যাদি ইতিমধ্যেই মুকেশ আম্বানির দখলে। কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের কোম্পানি নিবন্ধকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পাঁচটি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সংস্থা - এনডিটিভি, নিউজ নেশন, ইন্ডিয়া টিভি, নিউজ ২৪ এবং নেটওয়ার্ক ১৮ - রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মুকেশ আম্বানির কাছে অথবা মহেন্দ্র নাহাটার কাছে ঋণী। নাহাটা একজন শিল্পপতি এবং আম্বানির সহযোগী যিনি রিলায়েন্সের টেলিকম কোম্পানি রিলায়েন্স জিও-এর বোর্ডেও রয়েছেন৷ বোঝাই যাচ্ছে বকলমে মুকেশ আম্বানিই একে নিয়ন্ত্রন করে। এনডিটিভি নেটওয়ার্ক, কুইন্টিলিয়ন বিজনেস এবং আইএএনএস সংবাদ সংস্থা এখন আদানি গোষ্ঠীর পকেটে। 
একইভাবে বিজেপি’র নেতারা সরাসরি সংবাদ মাধ্যমের মালিকানা নিয়ে বসে আছেন। এতদিন বিজেপি সাংসদ সুভাস ছন্দ্র ছিলেন জি’নেটওয়ার্কের মালিক। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে আরএসএস/বিজেপি/হিন্দুত্ববাদীরা নিয়ন্ত্রন করে অনেকগুলি সংবাদ মাধ্যম। এদের মধ্যে অন্যতম হ’লো রিপাবলিক টিভি নেটওয়ার্ক, দৈনিক জাগরন, টাইমস নাও, ইন্ডিয়া টুডে, উইন , সিএনএন-নিউজ১৮, জি নিউজ, ইন্ডিয়া টিভি, আজ তক্, এবিপি নিউজ, রিপাবলিক ভারত, সুদর্শন নিউজ, নিউজ নেশন নিউজ ২৪ (ভারত) ইত্যাদি। এদের নাম এখন 'গোদি মিডিয়া' যার অর্থ ‘কোলে বসে থাকা’। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাজারি সংবাদ মাধ্যমের বড় অংশই আবার 'দিদি মিডিয়া' নামে পরিচিত একই কারণে।
এদের কারোর থেকে সত্য খবর তো দুরের কথা, বানানো কুৎসিত মিথ্যাচার, বিদ্বেষ-ঘৃণার প্রচার আর মোদি-দিদি'র স্তুতি ছাড়া কোনো কিছু পাঠক/দর্শক/শ্রোতারা পাবেন?
সত্য ঢাকে বিজ্ঞাপনে
দ্বিতীয় ছাঁকনি হলো বিজ্ঞাপন। সংবাদ মাধ্যম চালাতে যে বিশাল খরচ প্রয়োজন হয়, গ্রাহকদের কাছ থেকে মূল্য বাবদ তার ক্ষুদ্র একটা অংশই কেবল উঠে আসে। আর টিভির সংবাদ তো আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনা অর্থ ব্যয়ে দেখি। অর্থের জন্য এদের নির্ভর করতে হয় সরকারি বা বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার বিজ্ঞাপনের ওপর। ফলে তাদেরকে শুধু নিজেদের মালিকদেরই নয়, অন্যান্য বিজ্ঞাপনদাতা কর্পোরেট মালিকদেরও সন্তুষ্ট রেখেই চলতে হয়।
তাই যে পানীয় বা খাবার খেলে ক্ষতি হয়, সেটা জানা সত্ত্বেও এদের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কোনো খবর পাঠকের কাছে কাছে দেয় না; যদি না আন্তঃ কর্পোরেট যুদ্ধের প্রয়োজনে কোনো খবর ব্যবহার করতে হয়। কর্পোরেটের জনবিরোধী কোনও কাজ বা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদের খবর তাই পাঠকের কাছে তুলে ধরেনা এরা।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১০ টি বিজ্ঞাপন সংস্থার নিয়ন্ত্রন করে বিজ্ঞাপন দুনিয়ার ৭৫% বাজার। WPP - লন্ডন, অমনিকম গ্রুপ - নিউ ইয়র্ক, পাবলিসিস গ্রুপ - প্যারিস, Accenture ইন্টারেক্টিভ - ডাবলিন, ইন্টারপাবলিক গ্রুপ অফ কোস. - নিউ ইয়র্ক, ডেন্টসু ইনকর্পোরেটেড - মিনাটো সিটি, টোকিও, ডেলয়েট ডিজিটাল - নিউ ইয়র্ক, পিডব্লিউসি ডিজিটাল পরিষেবা - হ্যাল্যান্ডেল বিচ, IBM iX - Armonk, ব্লুফোকাস কমিউনিকেশন গ্রুপ – বেইজিং। এরা যদি মনে করে অমুক সংবাদ মাধ্যম বিজ্ঞাপন পাবে, তমুক পাবে না, তাহলে তাই হবে। এদের বাইরে গিয়ে কোনো সংবাদ মাধ্যম বাঁচতে পারবে না আজকের দুনিয়ায়। 
দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনের উৎস সরকারি বিজ্ঞাপন। এক্ষেত্রেও সরকারি কাজের সমালোচনা করলে বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না। এর সবচাইতে বড় উদাহরণ গণশক্তি পত্রিকা। আর তৃতীয় উৎস হ’লো স্থানীয় বিজ্ঞাপন। এক্ষেত্রেও সরকার বিরোধী কোনো সংবাদ মাধ্যমে যদি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, সরকারের রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হতে হয় তাদের। তাই ব্যবসায়িক স্বার্থে সরকারের সাথে বিরোধে যেতে চায় না তারা। 
লুটেরা পুঁজিই নিয়ন্ত্রক
কর্পোরেট কোম্পানিগুলি নানাভাবে সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করছে আজকের দুনিয়ায়। ১) মালিকানায় দখলদারি, ২) বিজ্ঞাপনের রাজস্ব এবং ৩) সম্পাদকীয় নীতি নির্ধারনে নির্দেশিকা জারির মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে প্রভাবিত করা। যখন একটি কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের মালিক হয়, তখন এটি সামগ্র সম্পাদকীয় বিষয়বস্তু নির্দেশ করতে পারে। বিজ্ঞাপনের রাশ নিজেদের হাতে রেখে অপছন্দের সংবাদ মাধ্যমকে ভাতে মারার কৌশল অবলম্বন করে। আর সরকার যখন এই সব কর্পোরেট সংস্থাগুলির মূল পৃষ্ঠপোষকে রূপান্তরিত হয়, তখন কর্পোরেটের স্বার্থ বিরোধী সংবাদ পরিবেশন করলে, তারাও রুষ্ট হয়। তারাও বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দেয়।   
এজেন্সি কার এজেন্ট 
তৃতীয় ছাঁকনিটা হলো সংবাদের উৎসের সীমাবদ্ধতা। কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের পক্ষেই দেশ-বিদেশের সর্বত্র চিত্র/সংবাদ সংগ্রাহক বা সাংবাদিক নিয়োগ করা সম্ভব হয় না। সংবাদের জন্য তাদেরকে অধিকাংশক্ষেত্রেই নির্ভর করতে হয় মুলত ১) সরকারি সংস্থাগুলোর ওপর, ২) নানান দেশি-বিদেশি ও সরকারি-বেসরকারি সংবাদ সংস্থার ওপর।
স্বাভাবিকভাবেই পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশিত হয় উৎসমুখ থেকেই। সরকারি কর্মকর্তাদের চটাবার সাহস এদের থাকেনা। সংবাদের এই উৎস যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়, সেজন্য সংবাদ মাধ্যমগুলো এই উৎস থেকে পাওয়া সংবাদগুলোর ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করে না। আর দেশি-বিদেশি সংবাদ সংস্থাগুলিও হয় সরকার, না হয় কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত। যেমন আমাদের দেশে েই সেদিন আদানি গোষ্ঠী এআইএনএস স্নগসবাদ এজেন্সির মালিকানা দখল করে নিল। এদের কাছে থে লুটেরা লগ্নিপুঁজির অবাধ লুট বা এদের পছন্দের রাকনৈতিক দলগুলোর কুকীর্তি নিয়ে কোনো সংবাদ কি আশা করতে পারেন? 
ঘিরে ধরো
চতুর্থ ছাঁকনি হলো সমালোচনা। কোনো সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে যদি স্বাধীনচেতা কোনো লেখক বা আলোচক ক্ষমতাসীনদের কিংবা অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য রাখেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে অন্য সবগুলো সংবাদ মাধ্যমে প্রবল সমালোচনা শুরু করা হয় এবং তাকে এমনভাবে দাগিয়ে দেওয়া হয় যে, তার পক্ষে টিঁকে থাকাই কঠিন হ'য়ে দাঁড়ায়। 
মোক্ষম ছাঁকনি
পঞ্চম ছাঁকনিটি হলো কমিউনিজম। অতি দক্ষিণপন্থীদের জনমত উৎপাদনের জন্য একটি 'কল্পিত জাতীয় শত্রু'র প্রয়োজন হয়। কর্তৃত্ববাদী শক্তি সেই কল্পিত জুজুর ভয় দেখিয়ে সহজেই জনগণের সম্মতি আদায় করে নিতে পারে। সেই জন্যই সংসদে মাত্র ৮জন প্রতিনিধি থাকা সত্ত্বেও আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বিজয়া দশমীর গুরুত্বপূর্ণ ভাষনের বড় অংশ জুড়েই ছিল কমিউনিস্ট বিরোধী কুৎসা ও মিথ্যাচার। সাধারন মানুষের জীবন যন্ত্রনা নিয়ে শুধু নয়, এর জন্য দায়ি লুটেরাদের বিরুদ্ধেও মুখর বামপন্থীরা, তাই এই বিষোদগার। মানুষের প্রকৃত সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরাবার জন্য প্রায়শই পাকিস্তান, চীন, কমিউনিস্ট বিরোধিতার জিগির তোলার উদাহরণের বিশেষ অভাব আছে কি? এখন অবশ্য সন্ত্রাসবাদ, অভিবাসন, মৌলবাদের মতো বিষয়গুলোকে নিয়েও প্রচারের ঢেউ তুলে কৃত্রিম ভাবে জনমত উৎপাদন করা হচ্ছে।
চমস্কি-গ্রামসী’র ব্যাখ্যা
৫টা ছাঁকনির এই কথাগুলো আজ থেকে ৩৩ বছর আগে একটা বইয়ে লিখেছিলেন দুই চিন্তাবিদ - নোয়াম চমস্কি ও এডওয়ার্ড হারমান। নাম – ‘দ্য ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট'। আমেরিকার প্রেক্ষাপটে লেখা এই বইটা আমাদের দেশ-রাজ্যে কি অপ্রাসঙ্গিক? তারও বহু আগে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক, যাকে জেলে বন্দি করে রেখেছিল ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি সরকার, তিনি লিখেছিলেন রাষ্ট্র সম্মতি আদায়ের যন্ত্র। আন্তোনিও গ্রামসীর কথায় - নাগরিক সমাজ, রাষ্ট্র এবং এর মধ্যে কাজ করে একাধিক মধ্যস্থতাকারী এবং শ্রমিকরা এই ব্যবস্থায় যন্ত্রের মতো উত্পাদন এবং পুনরুৎপাদনের কাজ করে। এখানে  শ্রমজীবীদের ‘সম্মতি’, একটি মতাদর্শগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তিগুলি প্রভাবশালী শ্রেণীর আধিপত্যের পক্ষে ‘সম্মতি’ আদায় নিশ্চিত করে। অর্থাৎ সম্মতি দেবে মানুষ, কিন্ত এমন পরিবেশ বা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যেখানে শ্রমজীবীরাও বাধ্য হয় শাসক শ্রেণীর পক্ষে সম্মতি দিতে।
যে রাস্তা পেরোতে হয়েছে
এই ৫ টা ছাঁকনি পেরিয়ে সাড়ে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে মানুষের সামনে লড়াইয়ের খবর তুলে ধরে আসছে গণশক্তি। অনেক আক্রমণ, বাধা বিপত্তি কাটিয়ে রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে এই লড়াই চালিয়েই পথ চলতে হয়েছে গণশক্তি পত্রিকাকে। পেশী শক্তি ব্যবহারে ব্যর্থ হয়ে অর্থনৈতিক অবরোধের রাস্তাকে বেছে নিয়েছে শাসক দল। তাতেও গণশক্তির কলম রুদ্ধ হয়নি। সবাই এত ঝড় ঝাপটা সামলে টিঁকে থাকতে পারে নি। এমন কি আত্মসমর্পণ করেও টেঁকেনি। পশ্চিমবঙ্গে গণশক্তি পত্রিকার চাইতে বয়সে বড় বাংলা দৈনিক মাত্র একটাই টিঁকে আছে। তবে গণশক্তি আত্মসমর্পণ করে নয়, লড়েই বেঁচে আছে।  
৫৭ বছর আগে গণশক্তি পথ চলার প্রথম দিনেই ঘোষনা করেছিল – ‘গণশক্তি তুলে ধরবে, ছড়িয়ে দেবে শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতি জনগণের সংগ্রামকে। ক্লান্তিহীনভাবে মুখোস খুলে দেবে শাসক দলের সমস্ত জনবিরোধী কুটিল চক্রান্তের'। না, ৫৭ বছর বাদেও গণশক্তি ক্লান্ত নয়। সব ঝড়-ঝঞ্ঝার মোকাবিলা করেই ক্লান্তিহীন এই পথ চলেছে গণশক্তি। চলার এই পথে হারাতে হয়েছে অনেক বন্ধুকে। অনেক আত্মত্যাগ, রক্ত, অশ্রু ঘাম দিয়ে লেখা হয়েছে ৫৭ বছরের ইতিহাস। সুখ-স্বাচ্ছন্দ-ভোগ-বিলাসের বিপরীতে, সব আক্রমণের মোকাবিলা করার দুঃসাহস গণশক্তিকে যুগিয়েছে মতাদর্শ, মেহনতী মানুষের পক্ষে দায়বদ্ধতার মতাদর্শ। গণশক্তি জানে এটাই তার সেরা পুঁজি, একে পাথেয় করেই আগামীর পথ চলার শপথ নিচ্ছে গণশক্তি।
আজ ফ্যাসিবাদি শক্তি সমগ্র রাষ্ট্র দখলে উদ্যত। জাত-ধর্ম-ভাষার ভিত্তিতে দেশের মানুষের ঐক্য ভাঙতে সক্রিয়। লুটেরা লগ্নি পুঁজি এদের পক্ষে। তাদের হাতে বন্দি হয়ে পড়ছে একে একে সংসদ-বিচার ব্যবস্থা, পকেটস্থ হচ্ছে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদ মাধ্যম।  রাজ্যের মানুষের অধিকার-গণতন্ত্র স্বৈরাচারী শাসকের হাতে বন্দি। 
মানুষের অধিকারের লড়াইয়ের প্রতি দায়বদ্ধ গণশক্তি। গণশক্তির মালিক মেহনতী মানুষ। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-দৈহিক বাধা পেরিয়ে পথ চলার জন্য রক্ত-অশ্রু-ঘাম-আত্মত্যাগের ঝুলি নিয়ে অতীতের মতোই দাঁড়িয়ে থাকবে গণশক্তি। আমাদের ভরসা মানুষ। মেহনতী মানুষ, গণতন্ত্রপ্রিয় দেশপ্রমিক জনগণের মিলিত শক্তিকে জিততে হবেই। জয় হবেই গণশক্তির।

Comments :0

Login to leave a comment