কনীনিকা ঘোষ
এই দেশ আমার, এ আমার জন্মভূমি। ছোটবেলা থেকে পড়েছি "জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী- এ জন্মভূমিতে জন্মেই আমরা মা কে মা বলে ডাকতে শিখেছি, সাদাকালো ভালো-মন্দ চিনেছি, কিন্তু আজ যেন সাদা-কালো ভালো-মন্দ গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের দেশ, আমাদের সংবিধান তাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তাই এই সময়, যখন দেশ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যে নির্বাচনে ঠিক হবে দেশের সরকার, তখন আমাদের হক আমাদের বুঝে নিতেই হবে, জন্মভূমির বর্ণপরিচয় এর নকশা বদলানোর চেষ্টা রুখতেই হবে।
আমরা দেখছি, প্রধানমন্ত্রী মোদীজি, প্রথম কয়েক দফা নির্বাচনের পর খুবই যে বেকায়দায় পড়েছেন তা বুঝতে পারছেন। 'ইসবার ৪০০ পার' এর জন্য ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গ্যাস ভরে যে প্রচার বেলুন ওরা তৈরি করেছিলেন তা লিক হয়ে গেছে, তাই তা থেকে গ্যাস বেরিয়ে এখন প্রচার চুপসে যাচ্ছে। মোদীজি অমিত শাহরা বুঝেছেন তাদের হাল খুবই খারাপ, তাই এই বেহাল দশায় মাথা ঠিক রাখতে না পেরে একদিকে বিরোধী নেতাদের উদ্দেশ্যে কুকথার স্রোত বইয়ে দিচ্ছেন, ভোট জিহাদ বলছেন। হিন্দু রাষ্ট্রকে প্রতিমুহূর্তে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার জন্য যে মোদী একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, এখন তিনি হিন্দু মুসলিম করবেন না বলে সংকল্প গ্রহণ করছেন। এ যে আজ তার বানিয়ে তোলা কথা, তা তাদের করা সমস্ত কাজে পরিষ্কার। বিজেপি আরএসএস তারা একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শ নিয়েই চলে এবং ভারত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তাকে তারা প্রয়োগ করতে চায় এতো তাদের ঘোষিত লক্ষ্য। আমাদের রাজ্যের মাননীয়াও ওই আরএসএস’র পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেকে বাড়িয়ে তুলেছেন, আর আজ তো আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দল তার প্রধান হিসাবে নিজে আর বিশেষত তার ভাইপোর নানাবিধ দুর্নীতি আর কুকীর্তি থেকে তাকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে আরএসএস-কে আরও খুশি রাখার পথ গ্রহণ করেছেন। তাই দেশ, রাজ্য আজ কোনোটা আরএসএস’র প্রত্যক্ষ মদতে আর কোনোটা বা পরোক্ষ উপদেশের মাধ্যমে চলছে।
আরএসএস’র মুখপত্র অর্গানাইজার-এ সংবিধানের যথেষ্ট সমালোচনা করে বলা হয়েছিল এই সংবিধানে কোনও ভারতীয়ত্ব নেই।" আরও বলা হয়েছিল " 'মনুস্মৃতি 'তে যেভাবে তার আইন সমূহ বিবৃত হয়েছে, তাকে সারা পৃথিবী শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং আপনা থেকেই সেগুলির প্রতি আনুগত্য দেখায় ও মেনে নেয়। কিন্তু আমাদের সংবিধান প্রণেতা পণ্ডিতদের কাছে এর কোনও মূল্য নেই।"আর এই মনুস্মৃতি মেয়েদেরকে হীন, অধীনস্ত হিসাবে বারে বারে বর্ণনা করেছে ছত্রে ছত্রে তার বহু বিবরণ আছে। আজ সে বিষয়ে না গিয়েও বলতে চাই, আরএসএস, তার উত্থানের সাথে সাথেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বর্ণ ও লিঙ্গ ভিত্তিক যে সমতার দাবি উত্থাপিত হয়েছিল তার বিরোধিতা করে। আসলে আরএসএস তো একটা একচেটিয়াভাবে পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সংগঠন, তারা রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতিকে তাদের অধস্তন একটি সংগঠন হিসাবে প্রচার করে। এই নামটির দ্বারাই লিঙ্গ সম্পর্কে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়, কারণ এর নাম থেকেই স্বয়ম (সত্তা, স্বয়ং) শব্দটি অনুপস্থিত, এবং এর পরিবর্তে সেবিকা বা সেবা শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতিও তার নারী কর্মী বা সমর্থকদের কাছে নারীদের অধস্তন অবস্থানের পক্ষে সম্পূর্ণ সহমতের প্রচার করে আসছে। আরএসএস’রই রাজনৈতিক দল বিজেপি’র সহ সভানেত্রী বিজয়রাজে সিন্ধিয়া, রূপ কানোয়ার সতী মামলার পর সতীদাহকে সমর্থন করে সংসদে একটি মিছিল করেছিলেন। সিন্ধিয়া বিশ্বাস করতেন যে সতীদাহ প্রথা একটি গৌরবময় ঐতিহ্য এবং হিন্দু মহিলাদের অধিকার। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে মৃদুলা সিনহা, সেবিকা সমিতির শীর্ষ নেত্রী, স্যা ভি ম্যা গাজিনের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে হিন্দু মহিলাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন যদি তার স্বামী তাকে (ঐ মহিলাকে) মারধর করেন তবে সেটা সহ্য করে নিতে বা মানিয়ে নিতে। তার এ প্রসঙ্গে অদ্ভুত যুক্তি ছিল হয়ত ঐ মহিলাই তার স্বামীকে কোনোভাবে 'প্ররোচিত' করেছিলেন। এইভাবে মৃদুলা সিনহা তো নারী নির্যাতনকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন। এমনকি তিনি যৌতুকের পক্ষেও বলেন যে " আমার বাবা আমাকে মাত্র ৫০০০ টাকায় স্বামী কিনে দিয়েছেন" - তিনি এমন পশ্চাৎপদ কথাও বলেছিলেন যে খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া নারীদের বাইরে কাজ করা উচিত না। হ্যাঁ, এটাই মনুবাদী আদর্শে দীক্ষিত আরএসএস বা তাদের অনুসারী সংগঠনের সংস্কৃতি। তাই আজ মহিলা ভোটারের সংখ্যার দিকে তাকিয়ে যখন মোদীজি 'নারী শক্তি'র কথা বলেন কিন্তু অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নাম ব্যবহার করেন অথচ তাকে সেন্ট্রাল ভিস্তায় আমন্ত্রণ জানান না, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের তার দল ছেড়ে দেয়, মণিপুরের আদিম বর্বরতম ঘটনায় মোদীজি নীরব থাকেন, দেশের কুস্তিগিরদের হয়রানিতে হয়রানকারী তার দলের সাংসদ ব্রিজভূষণ সিং সারণ বা বিধায়ক সঞ্জয়ের পক্ষ নেন, তখন তার 'মন কি বাত' যে আসলে মনুবাদ তা বুঝে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না।
আরএসএস’র আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদ মুখে হিন্দুধর্মর কথা বললেও সাধারণভাবে প্রচলিত হিন্দুদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উৎসবই তাদের অভিধানে পালনীয় নয়। অধ্যাপক পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি একদা বহুদিন আরএসএস’রই সদস্য ছিলেন পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন তিনি তার 'ভারত শেষ ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে' বইতে আরএসএস’র উৎসব পালনের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে সাধারণভাবে হিন্দুদের প্রচলিত বড় উৎসবের অনেকগুলিই তাদের তালিকাতে নেই, এমনকি বাঙালির যে সবচেয়ে বড় শারদোৎসব তার ষষ্ঠী থেকে নবমী কোনোদিন তাদের তালিকাতে নেই শুধুমাত্র বিজয়া দশমী ছাড়া। বিজয়া দশমীতে যেহেতু রাম রাবণকে বধ করেছিলেন তাই ওই দিন ওদের পালনীয় কিন্তু বাকি দিনগুলো 'দুর্গা'র পুজোর যে দিন, তা নেই। আমরা যদি মনে করি রাম অকালবোধন করেছিলেন দেবী দুর্গার কিন্তু মনুবাদী আরএসএস, যেহেতু বাকি দিনগুলোতে দেবীর মাহাত্ম্য পালন করা হয় তাই সে দিনগুলো তাদের উৎসবের তালিকায় রাখেনি তাহলে কি ভুল হবে? মেয়েদের অধীনস্ত রাখার, ছোট করে রাখার মনুবাদী চিন্তার প্রতিফলন তো তাদের প্রতি কাজেই প্রকাশ পায় আর এই একই চিন্তার পথিকই তো আরএসএস’র প্রচারক নরেন্দ্র মোদী। আমরা প্রতিবাদ করি যখন বিজেপি আরএসএস মহিলাদের সম্পর্কে এমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেও শুধু ভোটের জন্য নারী শক্তির কথা বলে। এদের শাসনকালেই ক্রমাগত বাড়ে নারী নির্যাতন, দেশে প্রতি ঘণ্টায় ৫৭ জন নারী আজ নির্যাতিত হয়। এটাই আরএসএস। এদের হাতে মহিলারা তো বটেই কোনও মানুষই নিরাপদ নন। ধর্মীয়ফ্যাসিবাদের অন্যতম প্রতিভূ আরএসএস’র জন্যই বাড়ছে সংখ্যালঘুদের ওপর হিংসার ঘটনা। ভাবুন তো হিসারে প্রসাদ খাওয়ার জন্য প্রতিবন্ধী মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা থেকে শুরু করে, কনস্টেবলের দ্বারা ট্রেনে বেছে বেছে মুসলিম হত্যা কোন জিঘাংসার উদাহরণ!
এমনই ঘৃণা, বিভাজনের রাজনীতির চাষ করেছে বিজেপি আরএসএস, আর তাকে রাজনীতিগতভাবে মোকাবিলা করার কথা একবারও না ভেবে শুধু মাত্র ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য এই দেউলিয়া, লুটেরা স্বৈরাচারী তৃণমূল দল সাম্প্রদায়িকতাতে ও প্রতিযোগিতা করছে। কখনও বলছে যে গোরু দুধ দেয় তার লাথি খেতে হয়, আবার এই সরকারের পুলিশই আনিস খানকে হত্যা করছে, মাদ্রাসার চাকরিপ্রার্থীদের হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে লক আপে ভরেছে। নাঃ বামপন্থীরা সরকারে থাকার সময় এরকম ঘটনা ঘটেনি। আজ আমাদের বাংলায় দাঙ্গাও হচ্ছে, তাতে জড়িয়ে পড়ছেন বিজেপি তৃণমূলের নেতারা। মাননীয়া হিজাব পরছেন, মসীহা সাজতে চাইছেন, আবার তারই দলের নেতাদের প্রত্যক্ষ মদতে রামনবমীর মিছিলেও সংঘর্ষ হচ্ছে। বাংলা আগে এ চিত্র দেখেনি। জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হিজাব পরতে হতো না। নামাজ পড়তে যেতে হতো না, কিন্তু সংখ্যালঘুরা রাজ্যে ছিল নিরাপদ। তারা জানত এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কথা, 'হুকুমৎ' না চাইলে দাঙ্গা হয় না। জানত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা, যে প্রশাসন দাঙ্গাকারীদের মাথা ভেঙে দিতে পারে। এটাই মৌলিক পার্থক্য বামপন্থীদের সাথে বিজেপি আরএসএসবা তৃণমূলের। তাই দেশের জন্য, মানুষের জন্য " হাতে হাত ধরে আয় কাঁটাতার ভেঙে যায়" এর শপথ আমাদের এদের পরাস্ত করেই নিতে হবে।
বিজেপি-আরএসএস’র হিসাত্মক কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 'দানবের পেটে দু’দশক— আরএসএস-বিজেপি ও হিংস্র হিন্দুত্বকে যেভাবে দেখেছি 'বইতে লিখেছেন "যে আরএসএস একসময়ে এক প্রান্তিক,উপহাস্যস্পদ শক্তি ছিল অথবা অবজ্ঞার বিষয় ছিল তা আজ সত্যিই এক ভয়ঙ্কর দানবের মতো ভারতবর্ষকে গ্রাস করে ফেলেছে, ঘৃণা-বিভেদ, হিংসা, ভয় ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে তারা তাদের রাজনৈতিক ফ্রন্ট বিজেপি’র মাধ্যমে ভারতের শাসন ক্ষমতায় প্রবলভাবে জাঁকিয়ে বসেছে এবং একদিকে তাদের ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদী ডক্ট্রিন ও অন্যদিকে গণতন্ত্র বিরোধী বহু ধর্ম ও বহু জাতিত্ব বিরোধী ফ্যাসিস্ত কার্যকলাপের মাধ্যমে সহনশীল, শান্ত দেশকে চিরকালের মতো ধ্বংস করে দিতে উদ্যত। তাদের একসময়ের প্রচারিত স্বদেশি অর্থনীতি থেকে আজ তারা বহু দূরে— বহুজাতিক ও ভারতীয় ওয়ান পার্সেন্ট আজ দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে "- হ্যাঁ, এই 'কর্পোরেট কমিউনাল নেক্সাস' আজ আমাদের দেশকে সমস্ত দিক থেকে নিজেদের অ্যা জেন্ডায় চালাতে চাইছে। আর তাদেরই দোসর তৃণমূল যে ঘর করেছিল এই বিজেপি আরএসএস’র সাথে, তারা তাদের লুট চুরির শাস্তি থেকে বাঁচতে, মুখে বিজেপি বিরোধিতার নাটক করে আসলে বোঝাপড়া করছে তাদেরই সাথে, তাই লুটের বখরা এ ঘাট ও ঘাট ঘুরে কালীঘাটে গেছে বলে অভিযোগ এলেও, যখন অন্য রাজ্যের শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন কিন্তু মাননীয়া বা তার ভাইপোকে ছুঁচ্ছে না কেন্দ্রীয় এজেন্সি। আর এ কারণেই এতদিন' ক্যা ক্যা ছি ছি 'বলা মুখ্যমন্ত্রী এখন CAA-কে সমর্থন করছেন যা ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি, যা কখনও আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের অনুসারী না। বিজেপি, তৃণমূল প্রতিদিন নিজেদের মধ্যে দল বদল করে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ার কথা বলছে তাই মিডিয়া যতই বাইনারি করার চেষ্টা করুক এই ভোটে ওরা একদিকে আর বামপন্থী -কংগ্রেস-গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি আর একদিকে। আজ সঙ্কট বুঝে 'ইন্ডিয়া'র কথা বলছেন মাননীয়া, অথচ নিজেই একা লড়বেন, রাজ্যে কংগ্রেস সিপিআইএম বিজেপি’র সাথে, বলে ভাষণ দিয়েছেন। এবারের ভোট তাই মুখোশ ছেঁড়ার ভোট, ধর্মনিরপেক্ষতাকে তথা দেশের মানুষের সম্প্রীতিকে রক্ষা করার ভোট, দেশকে সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ করার ভোট। মানুষের জীবন যন্ত্রণার দাবিকে পার্লামেন্টে তুলে ধরার ভোট।জুমলা আর মিথ্যাকে ছারখার করে দেশে বিজেপি আরএসএস ও রাজ্যে তৃণমূলকে পরাস্ত করে এই ভোটে আমাদের হকের কথা সোচ্চারে বলতেই হবে।
Comments :0