Manipur

ভোররাতে শেষ ১০ পরিবারকে গাড়িতে তুলে ছেড়ে দিয়ে আসা হলো অন্যত্র

জাতীয়

বিশ্বজিৎ দাস, গুয়াহাটি
 

গোটা ইম্ফলকেই ‘কুকি-মুক্ত’ করে ফেললো বিজেপি। ইম্ফল শহরে থাকা  কুকিদের সর্বশেষ ১০টি পরিবারের মোট ২৪ জনকে শনিবার  ইম্ফল থেকে জোর করেই তুলে নিয়ে গিয়ে কুকি নিবিড় কাঙপকপি জেলায় ফেলে এসেছে বীরেন সিং সরকারের পুলিশ। ফলে ইম্ফল উপত্যকায় আর একজনও কুকি মানুষ রইলেন না। ইম্ফল উপত্যকায় ‘কুকি উপজাতি নির্মূল অভিযান’ সম্পন্ন করল মণিপুরের বিজেপি সরকার।
এই ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। রাজ্যে চলতি হিংসার পেছনে  ‘জাতিকেই নির্মূল’ করাই যে বিজেপি’র ছক ছিল, তা স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধী দল সংগঠন সহ বিশিষ্টজন। কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদাম্বরম টুইট করে বলেছেন, ‘মণিপুরে জাতি নির্মূল অভিযান সম্পন্ন করলো বিজেপি সরকার।’ সংবাদ মাধ্যমে কুকিদের জোর করে ইম্ফল থেকে তাড়ানোর খবর দেখে তার প্রতিক্রিয়ায় চিদাম্বরম বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করছে, রাজ্য সরকার নাকি সংবিধান মেনে কাজ করছে। জাতি নির্মূল অভিযান সংবিধানের কোথায় লেখা আছে? প্রশ্ন করেন তিনি। চিদাম্বরমের অভিযোগ, বিজেপি সরকার আরও একটি নিম্ন পর্যায়ের কাজ করলো। যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। মণিপুরের কংগ্রেস ও বামপন্থী নেতারা বলেন, সংসদে মণিপুর নিয়ে বিশেষ অধিবেশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের নির্দেশ মেনে কাজ করছেন। তাহলে কি মোদী-শাহ'র নির্দেশেই ইম্ফল উপত্যকা থেকে কুকিদের নির্মূল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং?  এই প্রশ্ন তুলেছেন  রাজ্যের বিরোধী নেতারা। ইম্ফল উপত্যকা থেকে কুকি জাতি নির্মূল অভিযান নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও মোদী-শাহ যথারীতি ‘চুপ’। 
শনিবার সর্বশেষ যে দশটি পরিবারকে ইম্ফল থেকে উচ্ছেদ করেছে মণিপুর সরকার, তাদের মধ্যে সবচেয়ে  প্রবীণ ব্যক্তি ৭৫ বছরের  এস প্রিম ভাইফেই এবং ৬০  বছরের হেজাঙ কিপজেম জানান, ‘ইম্ফল উপত্যকার নিউ লাম্বুলান এলাকা মূলত কুকিদের বসবাস। ষাট-সত্তর বছর ধরে তাঁরা এই এলাকায় বসবাস করছেন। এই এলাকায় একটি উপজাতি বাজার রয়েছে। এটি কুকিরা পরিচালনা করেন। চার মাস আগে রাজ্যে জাতি সংঘর্ষ শুরুর পর অন্তত তিনশো পরিবার প্রাণ বাঁচাতে দফায় দফায় এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১০টি পরিবারের ২৪ জন জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এলাকায় থেকে গিয়েছিলেন। মধ্যে কিছুদিন আশ্রয় শিবিরে ছিলেন।  তাদের অন্যত্র বসবাসের  জায়গা না থাকায় ফের নিজের এলাকায় ফিরে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন একদিন রাজ্যে শান্তি ফিরে আসবে। আবার আগের মতো সকলে মিলে একসঙ্গে থাকবেন। কিন্তু তা আর হলো না। ১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার  মধ্য রাতে ১০-১২ জনের উর্দিধারী একদল যুবক এসে তাঁদেরকে বাড়ি ছাড়তে নির্দেশ দেয়। তাদের নানা ভয় দেখায়। তবুও তাঁরা তাদের জমি ছাড়তে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত  শনিবার ভোরে এতে একটি গাড়িতে জোর করে তুলে তাঁদের ইম্ফল থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরের মটবুং এলাকায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসে ওই যুবকরা। মটবুং এলাকাটি কুকি নিবিড় কাঙপকপি জেলায় পড়ে। বিবৃতিতে তাঁরা আরও উল্লেখ করেন, বাড়ি ছেড়ে আসার সময় ঘরের জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি তাঁদের। এক কাপড়ে ঘর ছাড়তে হয়েছে তাদের। বাড়ির জমির নথিপত্র, ঘরের আসবাবপত্র, অলঙ্কার, ব্যাঙ্ক-বিমার কাগজপত্র, টাকাপয়সা সব ফেলে আসতে হয়েছে।'
এই উর্দি ধারী যুবকরা যে বীরেন সিংয়ের পুলিশ, তা জানাজানি হয়ে গেছে। কারণ পুলিশের তরফেই বলা হয়েছে, কুকি পরিবারদের উচ্ছেদ করার নির্দেশ ছিল তাদের কাছে। উচ্ছেদ হওয়া কুকিরা এখন খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন। এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দিবে কুকিদের মিলিত সংগঠন কুকি ইনপি মণিপুর বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাজ্যে বিজেপি সরকার আমাদের পৃথক করে দিয়েছে। সরকার আমাদের একসঙ্গে থাকতে দিচ্ছে না। তাই কুকিদের পৃথক প্রশাসনের দাবি মানতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। 
উল্লেখ্য, রাজ্যের বিজেপি সরকারের পূর্বপরিকল্পনা মতো ৩ মে থেকে রাজ্যে কুকি ও মেইতেইদের মধ্যে যে জাতি সংঘর্ষ শুরু হয়েছে বলে প্রথম থেকেই অভিযোগ করছে বিরোধীরা। মূলত বিজেপি-আরএসএস’র আধিপত্যবাদী রাজনীতির চিত্রনাট্য মণিপুরে মঞ্চস্থ হচ্ছে। সংখ্যালঘু কুকিদের উপর সরকারি মদতে আক্রমণ চলছে। থানা থেকে অস্ত্র লুট করে কুকিদের খুন, ধর্ষণ করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় জড়িত মেইতেই দুষ্কৃতীরা সেনা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও সরকারের চাপে দুষ্কৃতী, উগ্রপন্থীদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সেনারা। দুই কুকি মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনা জেনেও জোর করে চাপা দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। মোদী-শাহ'র প্রেসক্রিপশন মেনে  বীরেন সিং এসব কাজ করছেন,তা সংসদে অমিত শাহ'র মন্তব্যেই স্পষ্ট হয়েছে। সংসদের বিশেষ অধিবেশনে বীরেন সিংয়ের ইস্তফার দাবি উঠলে শাহ বলেন, কেন্দ্রের নির্দেশ মেনেই মুখ্যমন্ত্রী কাজ করছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী বদলের প্রশ্নই ওঠে না। 
এদিকে রাজ্যের দশ কুকি বিধায়ক পৃথক প্রশাসনের দাবিতে সূর চড়িয়েছেন। তাদের দাবি, ইম্ফল উপত্যকায় কুকিরা নিরাপদ নন, তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। তাই কুকি নিবিড় জেলাগুলির জন্য মুখ্য সচিব পর্যায়ের একজন আধিকারিক ও পুলিশের ডিজি পর্যায়ের একজন আধিকারিক নিয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য, ইম্ফলে নিরাপত্তার অভাবের কারণ দেখিয়ে গত ২৯ আগস্ট মণিপুর বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন  বয়কট করেন কুকি বিধায়করা।  তাঁরা বিধানসভার অধ্যক্ষকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানান। তখন শাসক বিজেপি থেকে বলা হয়, কুকি বিধায়করা অধিবেশনে হাজির হলে তাদের কঠোর নিরাপত্তা দেবে সরকার। কিন্তু সরকারের কথায় ভরসা পাননি বিধায়করা।
এদিকে, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর খাম খান সুয়ান হাউসিঙের দুই আইনজীবীর বাড়িতে হামলা চালিয়েছে মেইতেই দুষ্কৃতীরা। আইনজীবী সোরাইসাম চিত্তরঞ্জন ও ভিক্টর চঙথামের ইম্ফলের বাড়িতে শুক্রবার রাতে আগুন ধরিয়ে দেয় অপরিচিত দুষ্কৃতীরা। ভয়ে তাঁরা দু’জন বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন প্রোফেসরের পক্ষে তাঁরা আর আইনি লড়াই লড়বেন না। উল্লেখ্য, মণিপুরে কুকিদের ইতিহাস নিয়ে বই সম্পাদনা করায় প্রোফেসর হাউজিঙের বিরুদ্ধে মামলা করে মণিপুর সরকার। হাউজিং আইনি লড়াইয়ের জন্য মেইতেই গোষ্ঠীর দুই আইনজীবী নিয়োগ করেছিলেন। এখন প্রাণের ভয়ে মামলা থেকে সরে আসতে হয়েছে। রাজ্যের পরিস্থিতি আঁচ করে  চলমান হিংসায় সিবিআই'র হাতে ন্যস্ত মামলাগুলি ইতোমধ্যে  মণিপুর থেকে  আসামে সরিয়ে  এনেছে সুপ্রিম কোর্ট। 
এদিকে, মণিপুরের পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন করে শনিবার  যে প্রতিবেদন প্রকাশিত করেছে ভারতের এডিটরস গিল্ড, তাতেও মণিপুরের বিজেপি সরকার নগ্ন হয়ে গেছে। রাজ্যের জাতি সংঘর্ষ যে বিজেপি সরকারের ষড়যন্ত্র, তা গিল্ডের প্রতিবেদনে পাতায় পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই সংঘর্ষে রাজ্যের মিডিয়াগুলিও যে পক্ষপাতিত্বমূলক ও কখনও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশন করছে,তাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গত ৭ আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট গিল্ডের তিনজনের এক প্রতিনিধি দল মণিপুর পরিদর্শন করে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সীমা গুহ,ভরত ভূষণ ও সঞ্জয় কাপুর। তাঁরা দুই পক্ষের পীড়িত মানুষ, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের মালিকদের সৃষ্টি মতবিনিময় করেছেন বলে ২৪ পাতার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

Comments :0

Login to leave a comment