Lok Sabha Elections 2024

‘একটি কারখানার নাম বলুন যা মমতা, শুভেন্দু এনেছেন’

রাজ্য লোকসভা ২০২৪

রামশঙ্কর চক্রবর্তী: তমলুক 


‘‘ক’টি কারখানা এনেছেন মমতা ব্যানার্জি, শুভেন্দু অধিকারী? শুধু এটা জানতে চাই। একটি কারখানার নাম বলুন যা আগেই ছিল না। আপনি জানেন তো বলুন।’’ যুবকের এটিই প্রশ্ন।
মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রীকালে শুভেন্দু অধিকারীর একটিই অবদান। হলদিয়ায় প্রবেশ পথে একটি বড় গেট। তার কাছে দোকান আছে অনেকগুলো। তার মধ্যে তেলেভাজার দোকানও আছে। তবে মমতা ব্যানার্জির ‘তেলেভাজাও শিল্প’ ঘোষণার অনেক আগে থেকেই সেই দোকানগুলির অবস্থান। তারই একটির সামনে দাঁড়িয়ে, বেশ জোরে জোরেই সরোজ দেবনাথ প্রশ্নটি করলেন।
তৃণমূল এখন বেশ ব্যাকফুটে। তোলা আদায় চলছে কারখানাগুলি থেকে। কিন্তু বছর তিনেক আগেও বিরোধিতা করলেই ‘মারবো ধরবো’ মেজাজে তেড়ে আসার দমে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে তাদের। কারণ? ‘‘দূর, ওরা হলো চোর। ভোট লুট করবে। ভোটের দিন বন্দুক নিয়ে ভয় দেখাবে। বুথ দখল করবে। তারপর সরকারি টাকা লুট করবে। এই হচ্ছে ওদের কাজ। হলদিয়ায় একটি লোক পাবেন, আপনি ডেকে আনুন, যে বলবে তৃণমূলকে পছন্দ করে।’’ বেশ জোরের সঙ্গে যুবক বললেন। চাকরি পাননি। বাড়িতে বেশ কয়েকটি পাশের সার্টিফিকেট আছে। সরোজকে দেখিয়ে তাঁর বন্ধু উৎপল বললেন,‘‘ও এত পড়েছে। আমরা ওকে মজা করে বলি, কী লাভ হলো এত পড়ে। কাজই যখন পাস না। আমি তো বাইরে কাজ করি। বাঙ্গালোরে। ও শুনল না। এখানে কাজ খুঁজল। আরে ভাই, এখানে কে কাজ দেবে? কারখানা হয়েছে কিছু?’’
মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রিত্বর এটি একযুগ। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের দশ বছর। দু’জনের কারও পক্ষে দাবি করা সম্ভব নয়—  হলদিয়ায় এই সময়ে একটি নতুন কারখানা হয়েছে। ‘সাফল্য’ বলতে একটিই। গৌতম আদানি পা রেখেছেন হলদিয়া বন্দরে, ৫নং জেটি বানানোর কাজে। তবে তাতে রাজ্য সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। 
‘বেঙ্গল লিডস’ হয়েছিল হলদিয়ায়। ২০১৩-র ১৫-১৬ জানুয়ারি। সঞ্জীব গোয়েঙ্কা আর সিকে ধানুকাকে মঞ্চে তুলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গান গাইতে বাধ্য করেছিলেন,‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে...।’ গানই হয়েছিল। মেলা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ হয়েছিল। কিন্তু বিনিয়োগ হয়নি। নতুন কারখানা হয়নি।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে কাজ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা। তৃণমূল, বিজেপি সেই প্রশ্নের ধারেকাছ দিয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু কাজের বেহাল দশার সূত্রে হলদিয়ার দুর্দশা তুলে ধরছেন বামফ্রন্ট কর্মীরা।
তবে শুধু কাজ, শিল্পের প্রসঙ্গেই হলদিয়া জড়িয়ে আছে, তা নয়। তোলা আদায়ে পথ দেখিয়েছে তৃণমূল— হলদিয়াতে। 
হলদিয়ায় তোলা আদায় নিয়ে ২০২২-এ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। তৃণমূলের তোলা আদায় নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে কারখানা বন্ধ হতে দেখেছে হলদিয়া। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে তিন বছর অন্তর শ্রমিকদের বেতন পুনর্বিন্যাস হতো। গত বারো বছরে তা বন্ধ। কোনও কারখানায় চার বছর, কোথাও পাঁচ বছর একই বেতনে কাজ করছেন শ্রমিকরা। হলদিয়ায় ঠিকা শ্রমিক বেড়েছে। স্থায়ী নিয়োগ বন্ধ হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে প্রতিটি কারখানায় স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল মোট শ্রমিকের তিন ভাগ। এখন পুরো উলটো। ফলে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো, সুরক্ষার জন্য মালিকের সঙ্গে ‘বারগেন’ করার ক্ষমতা কমানো হয়েছে — মদত তৃণমূলের। লাভ মালিকদের। শুধু টাকা হলেই চলে তৃণমূলের। ‘ডেইলি সাপ্লাই ওয়ার্কার’রা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। যতদিন কাজ করেন সেই দিনগুলির মজুরি পান। এক্ষেত্রে কারখানাগুলিতে ডেলি সাপ্লাই ওয়ার্কারের জোগান দেয় তৃণমূলের নেতারা।
মোদ্দা কথা—  ‘‘হলদিয়া এখনও বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য হিসাবে টিকে আছে। হলদিয়ার যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা জানান দিচ্ছে এই সবই বামফ্রন্ট করেছিল।’’ এমন একজন এই কথা বললেন যিনি থাকেন হলদিয়ার অন্যপারে—  নন্দীগ্রামে। হলদিয়ায় তাঁর ছোট দোকান। বছর পঞ্চাশের সেই ব্যক্তির কথায়,‘‘এখনও ভাবলে অবাক লাগে এত বড় একটা শহর, এতগুলো শিল্প এনেছিল বামফ্রন্ট! তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলাম? নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না।’’ মানুষটির একমাত্র ছেলে চেন্নাইয়ে কাজ করেন। ঘরের কাছে নন্দীগ্রামে কাজ নেই! 
আর সেই হলদিয়া দেখিয়েছে, আজ যে তৃণমূল কাল সে বিজেপি। আজ যে মমতার শুভেন্দু, কাল সে অমিত শাহ’র শুভেন্দু।
হলদিয়ার বাইরেও, পূর্ব মেদিনীপুরের অন্যত্র কারখানা বন্ধ করার রেকর্ড আছে শুভেন্দু অধিকারীর বানানো তৃণমূল কর্মীদের। বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বাণিজ্যিক টার্নওভারের একটি কোম্পানিকে তৃণমূল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে তৃণমূল, পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নাতে। ২০০১ সালের ১০ নভেম্বর ময়নার পরমানন্দপুর এলাকায় ব্রাইট সোলার নামে একটি ব্যাটারি ও সোলার প্লেট তৈরির কারখানা চালু হয়েছিল। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী নন্দগোপাল ভট্টাচার্য। এই কোম্পানিরই চারটি কারখানা তৈরি হয়েছিল ময়না এলাকার চরণদাসচক, সুদামপুর, পরমানন্দপুর এবং দোনাচক এলাকায়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, উত্তর প্রদেশ সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যেও এই কোম্পানি সোলার প্ল্যান্ট বসানোর কাজ করত। এই কোম্পানির প্রতিটি ওয়ার্কশপে ২০০ জন করে শ্রমিক এই কারখানায় কাজ করত সেই সময়। ২০১১ সালে সম্পূর্ণ কোম্পানিটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন মালিক তপন কুমার দাস, তৃণমূলের দৌরাত্যেস ।
২০২০-র ১০ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সহ রাজ্যপাল, বিধানসভার অধ্যক্ষ, রাজ্যের পুলিশ কমিশনার, সিআইডি দপ্তর, সিবিআই দপ্তর, পূর্ব মেদিনীপুর জেলাশাসক, পুলিশ সুপারকে চিঠি দেন তপন কুমার দাস। তাতেও কারখানা খোলেনি।
 

Comments :0

Login to leave a comment