Massive strike

বেনজির ধর্মঘটে অচল প্রশাসন

রাজ্য

কর্মবিরতির ক্ষোভের আগুনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধর্মঘটের নয়া ইতিহাস তৈরি করলেন রাজ্যের কোষাগার থেকে বেতন নেওয়া কর্মচারীরা। 
ফেব্রুয়ারি মাসে দু’দিন দপ্তরে এসে কর্মবিরতি করেছিলেন সরকারি কর্মচারীরা। শুক্রবার রাজ্য প্রশাসনকে কার্যত স্তব্ধ করে ধর্মঘট করে বকেয়া ডিএ’র দাবির সঙ্গে এরাজ্যের বেকার যুবক, যুবতীদের শূন্যপদ পূরণের লড়াইকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিলেন মধ্যবিত্ত কর্মচারীরা। ধর্মঘটের এই সর্বাত্মক প্রভাবের পর কর্মচারী আন্দোলনের নেতা সন্দীপ রায় বলেছেন, ‘‘এরপর সরকারকে পঞ্চায়েতে ভোটে যেতে হবে। এই কর্মচারীরাই ভোটকর্মী হিসাবে যাবেন। এই ধর্মঘট এই বার্তাই দিয়েছে, আগের মতো আর ভোট লুটে কর্মচারীদের ব্যবহার করা যাবে না। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কর্মচারীরা আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাবেন।’’ 
ধর্মঘট নিয়ে কর্মচারীদের মনোভাব টের পেয়েছিল নবান্ন। তাই দপ্তরে দপ্তরে উপস্থিতি দেখাতে অভূতপূর্ব ছাড়ের সুযোগ দিয়ে বসেছিলেন আধিকারিকরা। একবার নয়, গোটা দিনে চারবার- সকাল ১০টা ৪৫মিনিট, বেলা ১২টায়, দুপুর দেড়টা এমনকি বিকাল ৫টা পর্যন্ত সময় দিয়ে নবান্নের অর্থ দপ্তর ও মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে উপস্থিতির তালিকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উপস্থিতির খাতা নিয়ে কলকাতার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের আধিকারিকরা বিকাল পর্যন্ত কর্মচারীদের ফোন করে অফিসে আসার অনুরোধ করেছেন। একবার এসে অন্তত উপস্থিতির খাতায় স্বাক্ষরটুকু অন্তত করে যান, এমন অনুরোধ এদিন ফিরিয়ে দিয়েছেন কর্মচারীরা। রাতে বাঁকুড়া জেলায় বেশ কিছু ব্লকে আধিকারিকরা সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার পর অফিসে ডেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যাতে অন্তত উপস্থিতির সংখ্যা বাড়িয়ে সরকারের মুখরক্ষা করা যায়। রাজ্যের সরকারি কোষাগার থেকে বেতন প্রাপক এক ধর্মঘটী কর্মচারী নেতার কটাক্ষ,‘‘ সরকার ধর্মঘট ঠেকাতে হাজিরার চৈত্র সেলের ব্যবস্থা করেছিল। সোমবার থেকে এই সুযোগ সরকার দেবে তো?’’ 


শেষ পর্যন্ত কত সংখ্যায় সরকারি দপ্তরে কর্মচারীরা উপস্থিত হলো, তা নিয়ে প্রকাশ্যে নবান্নের কোনও শীর্ষ আধিকারিক মুখ খুলতে চাননি। সন্ধ্যায় রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর থেকে বিনা স্বাক্ষরের একটি প্রেস বিবৃতি জারি করে জানানো হয়েছে, ‘‘এরাজ্যে ধর্মঘটের কোনও প্রভাব পড়েনি। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে গড়ে ৯০ শতাংশ কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।’’ এমনকি সরকারি হিসাবেও যাঁরা এদিন অনুপস্থিত থেকেছেন তাঁদেরও ধর্মঘটী হিসাবে মানতে চায়নি রাজ্য প্রশাসন। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, অনুপস্থিত কর্মচারীরা সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী অফিসে হাজির হননি। এরপরও যাঁরা আসেননি তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে বলে প্রেস বিবৃতিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। 
সরকার কী ব্যবস্থা নেবে, সেই আশঙ্কার দিন এদিন ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে ধর্মঘট করেছেন সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, থেকে পঞ্চায়েত ও পৌরসভার কর্মচারীরা। সরকারি সার্কুলারের ভয় তো দূর, শাসকদলের অতীতের গুন্ডামিকে পর্যন্ত আমল দেননি ধর্মঘটী কর্মচারীরা। যার সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে। প্রত্যন্ত গ্রামে পঞ্চায়েত দপ্তরে কার্যত তালা ঝুলিয়ে এদিন যে ধর্মঘট করেছেন কর্মচারীরা তা নজিরবিহীন। এরাজ্যে ৩ হাজারের ওপর গ্রাম পঞ্চায়েতের ১২০০-র ওপর গ্রাম পঞ্চায়েত ভবন ছিল পুরোপুরি স্তব্ধ। ১৪০০-র ওপর পঞ্চায়েতে ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে রীতিমতো উল্লেখযোগ্য। সবমিলিয়ে প্রায় ৮২শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতে এদিন কর্মচারীরা কাজ বন্ধ করে রাখেন। ৩০০র ওপর পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ৭৯ শতাংশ ব্লকে এদিন কর্মচারী ধর্মঘটের প্রভাব ছিল সর্বাত্মক। ২১টি জেলা পরিষদের মধ্যে ১৫টি জেলা পরিষদ দপ্তরে ধর্মঘট হয়েছে ভালোই।  
রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি এদিন বন্ধই ছিল। শিক্ষক, অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মীরা কাজে যাননি। কোথাও শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুলের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে দিয়েছেন, ‘ক্লাস করব না’। 
গ্রামের মতোই নজিরবিহীন সাড়া পড়েছে কলকাতায়। দিনের শেষে সরকারি ৯০ শতাংশ উপস্থিতির হিসাবকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে ধর্মঘট হয়েছে কলকাতার খাদ্য ভবন, নব মহাকরণ, জেশপ বিল্ডিং, কলকাতা কালেক্টরেট, সার্ভে  বিল্ডিং, মিত্র বিল্ডিং,সল্টলেকের অফিস পাড়ায়। রাজ্যের প্রতিটি জেলা সদর, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এদিন ছিল কার্যত ধর্মঘটীদের দখলে। জেশপ বিল্ডিংয়ে কারা দপ্তর। সেখানে ৭৬জন কর্মচারীর মধ্যে ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন ৬৩জন। 
নিউ মার্কেট এলাকার খাদ্য ভবন ক্যাম্পাসে আছে খাদ্য দপ্তর, অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর, পূর্ত দপ্তর, ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তর। সাত তলার খাদ্যশ্রী ভবনে প্রতিটি ফ্লোরেই কর্মচারী ছিল কার্যত শূন্য। একই অবস্থা বাকি দপ্তরগুলিতেও। দপ্তর শুধু কর্মশূন্যই ছিল না, ফি দিন পরিষেবা নিতে শয়ে শয়ে মানুষ আসেন খাদ্য ভবনে। কারোর দরকার থাকে রেশন কার্ডের, কারোর প্রয়োজন থাকে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তরের শংসাপত্র, ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরে কাজের প্রয়োজনে ফি দিন আইনজীবী থেকে সাধারণ মানুষ এসে ভিড় করেন খাদ্য ভবনে। কর্মচারী শূন্য সরকারি খাদ্য ভবনে এদিন নিত্য প্রয়োজনে আসা সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল নগন্য। খাদ্য ভবনের সামনে পিকেটিং করা কর্মচারী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বক্তব্য, সাধারণ মানুষও জেনে গিয়েছিলেন, ধর্মঘট ব্যাপক আকার নিতে চলেছে। 
২০১২সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মমতা ব্যানার্জির সরকারের শুরুর সময় থেকে ধর্মঘটে শামিল হওয়া এক সরকারি কর্মচারীর অভিজ্ঞতা, এবারের ধর্মঘটে সাড়া অভূতপূর্ব। আগের রাতে ধর্মঘটে অংশ না নেওয়ার জন্য আমার কাছে হুমকি ফোন এসেছিল। জবাব দেওয়ার পর হোয়াটসঅ্যাপ করে সেই হুমকিদাতা তৃণমূল নেতা দয়া করে অফিসে আসার আবেদন করে। ফলে সরকারি কর্মচারীদের নাছোড় জেদের সামনে সরকারই শুধু নয়, দাঁড়াতে পারেনি শাসকদলও। 
তাই এবারই ধর্মঘটের সমর্থনে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাজ্যের প্রতিটি দপ্তরে, পঞ্চায়েতে, ব্লক অফিসে, জেলা পরিষদে পিকেটিং করেছেন অবসরপ্রাপ্ত থেকে কর্মরত ধর্মঘটী কর্মচারীরা। সেই পিকেটিং এর প্রভাব কেমন? 
কলকাতার জেশপ বিল্ডিং এ সকাল থেকে পিকেটিংয়ে শামিল থাকা এক ধর্মঘটী কর্মচারীর বক্তব্য,‘‘ সকাল থেকে পিকেটিং চলাকালীন দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে থাকা দু’-চারজন কর্মচারী অফিসে চলে এসেছিলেন। পিকেটিং করতে থাকা সহকর্মীদের উপস্থিতি দেখে আর দপ্তরে যাননি। অনুপস্থিতির তালিকায় নাম ঢুকিয়ে পিকেটিং করতে বসে যান।’’ ধর্মঘটের দিন সকালেও নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করেছে কর্মচারী আন্দোলন।
সরকার যে কতটা ত্রস্ত তা টের পাওয়া গেছে নবান্নে। সকাল থেকে নবান্নে আসা কর্মচারীদের ব্যাগ তল্লাশি করেছে পুলিশ। ব্যাগ হাতড়ে কালো রুমাল পাওয়ার পর তা রেখে দেওয়া হয়েছে। কারণ, ওই কালো রুমাল নিয়ে যদি বিক্ষোভ হয়, সেই ভয়েই সরকার কর্মচারীদের রুমাল পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে। তারপরেও নবান্নে এদিন ধর্মঘটের প্রভাব সেভাবে পড়েনি। সকালেই নবান্নে কর্মচারীদের ঢোকার ছবি করছিলেন বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক। ভিডিও ছবি তোলার মুহূর্তেই রীতিমতো ক্ষুব্ধ এক মহিলা কর্মচারী বলেন, ‘‘কী ছবি তুলছেন? ধর্মঘট না করে অফিসে এসেছি? আসতে চাইনি। জোর করে আসার জন্য বাধ্য করা হয়েছে।’’ 
রাজ্য প্রশাসনকে টলিয়ে দিয়ে ধর্মঘট দেখিয়ে দিয়েছে, নবান্নে ধাক্কা দেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
 

Comments :0

Login to leave a comment