নীলাদ্রি সেন
ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়া সফর কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? রাজনৈতিক, কুটনৈতিক মহলে এখন এই প্রশ্নই ঘোরাফেরা করছে। প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে যে মস্কোয় রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় ভারত-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির পাশাপাশি দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সমঝোতাকে আরও দৃঢ় করে তুলতে আলোচনা করেছেন মোদী। এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধও এসেছিল আলোচনায়। তাহলে কি বিশ্বে সাম্প্রতিক নতুন বিন্যাসকেই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন মোদী? তবে ন্যাটো জোট বা ইজরায়েলের সাথে মাখামাখি বজায় রেখে এই নতুন বিন্যাসের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারবেন, সেটা সময়ই বলতে পারবে।
ইউক্রেন ইস্যুতে মস্কোকে একঘরে করে রাখবার মতলব সম্প্রতি জোর ধাক্কা খেয়েছে। সেইসঙ্গে ইউক্রেনে ওয়াশিংটনের মদতে চলা দীর্ঘমেয়াদি সংঘর্ষ পুঁজি করে রাশিয়াকে দখলে এনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিশ্বব্যাপী পেশি প্রদর্শনের স্বপ্নের ফানুসও চুপসে গেল। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক কোরিয়া সফর ও দুদেশের মধ্যে অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর বাইডেনের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে দিল। এই চুক্তি করবার পর পরই সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামে গিয়ে পুতিনের দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে সই করা কার্যত এখন হোয়াইট হাউসের কপালের ভাঁজকে আরো চওড়া করে তুলেছে।
শেষবার পুতিন গণতান্ত্রিক কোরিয়াতে যান দু’হাজার সালে। তারপর প্রায় চব্বিশ বছর পর পিয়ঙইয়ঙের মাটিতে পা রাখলেন রুশ রাষ্ট্রপতি। সেখানে রাষ্ট্রপতি কিম জঙ উন পুতিনকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। অভুতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয় পুতিন সহ উচ্চ পর্যায়ের রুশ প্রতিনিধি দলকে।
উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনায় উঠে আসে দু’দেশ আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার প্রশ্ন। তখনই সিদ্ধান্ত হয় যৌথভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলবার। উভয় দেশ ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরস্পরকে রক্ষা করবার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। পুতিনের কথায় দুই দেশের মধ্যে কারো ওপর আগ্রাসন নেমে এলে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবার লক্ষ্যেই এই চুক্তি।
যদি দু’পক্ষের মধ্যে কোনও এক পক্ষকে অপর কোনও এক অথবা একাধিক দেশ সশস্ত্র হানার মাধ্যমে যুদ্ধে টেনে আনতে বাধ্য করে তাহলে চুক্তিতে থাকা অন্য দেশ তৎক্ষণাৎ সামরিক ও অন্যান্য সমস্ত রকমের সহযোগিতা নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াবে। এটা করা হবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদের ৫১ নম্বর ধারা মেনে। এই ধারাতে কোনও দেশ আক্রান্ত হলে তার আত্মরক্ষার বিষয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে। এরসঙ্গে গণতান্ত্রিক কোরিয়া ও রাশিয়া দু’দেশের আইনও প্রযোজ্য হবে। এই হলো পুতিন ও কিমের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অন্যতম মূল বিষয়।
দু’দেশের আলোচনাতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে উঠে আসে ভবিষ্যতে সামরিক প্রযুক্তি বিনিময় প্রসঙ্গ। এরমধ্যে পিয়ঙইয়ঙের ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট আধুনিকীকরণ কর্মসূচিতে সম্ভাব্য রুশ সহায়তার বিষয়েও দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে আলোচনা হয়। রাশিয়া ও গণতান্ত্রিক কোরিয়াতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্য নয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে অতিরিক্ত ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি নজরে এসেছে। আলোচনা প্রসঙ্গে পুতিন বলেন যে এই দুই দেশই আরো বেশি উন্নয়নের লক্ষ্য ও সহযোগিতার নীতি নিয়ে এগতে চায়। এই কাজে দু’দেশের সংসদ, আইন, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা বিভাগ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও নাগরিকদের সহযোগিতা যৌথভাবে রাশিয়া ও গণতান্ত্রিক কোরিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এই বন্ধুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব চুক্তিতে অতীতের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন অনেকেই। ১৯৬১ তে এভাবেই মস্কো - পিয়ঙইয়ঙের মধ্যে সহযোগিতামুলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সাবেক সোভিয়েতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের সময় থেকে এই চুক্তি আর সেভাবে কার্যকরী ছিল না। দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে ২০০০ সালে ফের এই দু’দেশকে এক হয়ে নতুনভাবে চুক্তি স্বাক্ষর করতে দেখা যায়। অবশ্য তাতে সামরিকের থেকেও অনেক বেশি ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়। এই চুক্তি দু’দেশের আর্থিক উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য ছাপ ফেলেছে। এই পথ ধরেই সাম্প্রতিক চুক্তি। তবে এরমধ্যে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। বিশ্ব পরিস্থিতিতে তা গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাই দু দেশের মধ্যে সময়োপযোগী নতুন নথি বিনিময় জরুরি হয়ে ওঠে।
এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছিল। ২০২২ সাল থেকে ন্যাটোকে জঘন্যভাবে ব্যবহার করে রাশিয়াকে দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে রক্তাক্ত করে দুর্বল করে দেওয়া এবং এই সুযোগে আক্রমণকে আরও জোরালো করে তুলে তাদের আত্মসমর্পণ করানোই বরাবরের লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার। আর এরমধ্য দিয়ে নিজেদের সুপার পাওয়ার হিসাবে তুলে ধরে বিশ্বজুড়ে একচেটিয়া পুঁজিবাদী আধিপত্যবাদ কায়েম করতে মরিয়া হয়ে ওঠে হোয়াইট হাউস।
ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো বাইডেনের প্রত্যক্ষ মদতে ইউক্রেনকে দুরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। জেলেনেস্কিকে দিয়ে তা অনবরত ব্যবহার করানো হচ্ছে মস্কোর বিরুদ্ধে। যাতে রাশিয়াকে তারা সহজেই গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এই যুদ্ধকে পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে তৎপরতা চালাচ্ছে ওয়াশিংটন। আর তারই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। এই লক্ষ্যপূরণে আমেরিকা বিভিন্ন সময়ে যুক্ত থাকা আন্তর্জাতিক শান্তি চুক্তিগুলোকে বেপরোয়াভাবে লঙ্ঘন করে চলেছে। রাশিয়াতে ন্যাটোর এই নাগাড়ে হামলা তাই গণতান্ত্রিক কোরিয়াকে এই যুদ্ধে সরাসরি টেনে আনতে পারে। যার প্রভাব কোরিয়ার উপদ্বীপগুলোতে পড়তে বাধ্য। এমনকি সমাজতান্ত্রিক চীনকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে দেওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।
ফলে বিরামহীন সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে আমেরিকা। উদ্দেশ্য এই যুদ্ধকে গোটা পূর্ব ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়ে সেখানে খবরদারী চালানো। ইন্দো প্যাসিফিক দ্বন্ধকে উসকে দিয়ে ওয়াশিংটন আরো একবার রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে চায়। রাশিয়াকে উত্তপ্ত রেখে গণতান্ত্রিক কোরিয়া ও চীনে আমেরিকা তার সম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কায়েম করে নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ হিসেবে তুলে ধরতে চায়। কারণ এই মূহুর্তে সমাজতান্ত্রিক চীনের অসামান্য অগ্রগতি পুঁজিবাদ শিরোমণি আমেরিকার মাথা ব্যাথার বড় কারণ।
তাইওয়ানকে চীনের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়ে চীনকে যুদ্ধে টেনে নামানোর চেষ্টার মতোই ইউক্রেনকে মদত দিয়ে রাশিয়াকে উত্তপ্ত করে রাখবার চেষ্টা চালাচ্ছে আমেরিকা। চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার পাশে এখন জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও দক্ষিণ কোরিয়া। আমেরিকার জন্য অস্ত্র সরবরাহের বিশ্বস্ত মিত্র হয়ে উঠেছে সিওল এবং টোকিও। গত বছরের শেষে ফাঁস হয়ে গিয়েছে যে ইউক্রেনে ১৫৫ এম এম শেলের সর্ববৃহৎ সরবরাহকারী হল সিওল। অন্যদিকে নিজের দেশের সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে টোকিও ইউক্রেনের জন্য আমেরিকাকে পেট্রিয়ট ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহ করছে।
পুতিন রাশিয়া থেকে সটান চলে যান হ্যানয়ে। সেখানে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপ্রধান তো লামের সঙ্গে হয় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। ২০১৭ সালের পর এই প্রথম পুতিন ভিয়েতনাম সফরে আসেন। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকা ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে রাশিয়া। দু দেশ এখন থেকে পরস্পরের মধ্যে সহযোগীতার নীতি নিয়ে এগোনোর বার্তা দেয়।
এদিকে পুতিনের এই কৌশলী পদক্ষেপে রীতিমতো চাপে রয়েছে ওয়াশিংটন। আমেরিকার সেক্রেটারী অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে ধমকের সুরে বলতে শোনা যায় যে তারা নাকি যেকোনো সময়ে পদক্ষেপ নিতে পারে ! ইরান ও গণতান্ত্রিক কোরিয়ার মতো রাশিয়ার সঙ্গেও সব সম্পর্ক তারা ছিন্ন করে দিতে পারে। ব্লিঙ্কেনের কথার প্রতিদ্ধনি শোনা গেল ন্যাটোর সেক্রেটারী জেনারেল জেনস্ স্টোলেনবার্গকের মুখে। ইউরোপের ঘটনাবলী এশিয়াতে প্রভাব ফেলে। এশিয়ার ঘটনা প্রভাব ফেলে আমাদের ওপর। ইউক্রেনের ঘটনায় এখন এটা স্পষ্ট। যেখানে ইরান, গণতান্ত্রিক কোরিয়া ও চীন মদত দিচ্ছে রাশিয়াকে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। এইভাবে রাশিয়াকে দুষছেন স্টোলেনবার্গ।
পুতিনের উদ্যোগ, রাশিয়া ও দুই সমাজতান্ত্রিক দেশ যথাক্রমে গণতান্ত্রিক কোরিয়া ও ভিয়েতনামের পারস্পরিক সহযোগীতার পরিবেশ গড়ে ওঠা এবং সমাজতান্ত্রিক চীনের সঙ্গেও আগামী দিনে মৈত্রির সম্পর্কের জোরালো আভাস বিশ্বে যে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের জন্ম দিয়েছে তাতে বাইডেন জমানা এখন রীতিমতো বেসামাল একথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
প্রধানমণ্ত্রী মোদীও হয়তো তা টৈর পেয়েই এবার মস্কোর হাতে হাত রেখে ভারত - রাশিয়ার মধ্যে প্রতিরক্ষা সমঝোতাকে মজবুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যা ওয়াশিংটনের অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে তুলছে সন্দেহ নেই।
Comments :0