স্বপ্নের ফেরিওয়ালা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বভাব বৈশিষ্ট্যই হলো একটার পর একটা স্বপ্নে উড়ান ভাসিয়ে দেওয়া। প্রথম দিকে তাঁর স্বপ্ন উড়ানের টার্গেট ছিল স্বাধীনতার ৭৫ বছর। বলেছিলেন স্বাধীনতার ৭৫ বছরের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন। ভারতের অর্থনীতির আয়তন পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করবেন। প্রতিটি নাগরিকের মাথায় শক্তপোক্ত ছাদের ব্যবস্থা করবেন। ঘরে ঘরে শৌচালয়, নলবাহিত বিশুদ্ধ পানীয় জল, বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। এর যে কোনোটাই হয়নি সেটা মোটামুটি সকলেরই জানা। পরে এল আরও নতুন প্রতিশ্রুতি, নতুন স্বপ্ন। বলা হলো ভারত হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ভারতেই বসবে অলিম্পিকের আসর। সর্বশেষ যে স্বপ্নকে ঘিরে সর্বাধিক মাতামাতি চলছে সেটা হলো স্বাধীনতার শতবর্ষ অর্থাৎ ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারত হয়ে উঠবে উন্নত বিশ্বের শরিক। অর্থাৎ আর উন্নয়নশীল বা বিকাশমান নয় একেবারে আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপানের মতো উন্নত দেশ। ইদানীং কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রী সকাল-সন্ধেয় নিয়ম করে বিকশিত ভারতের কথা জপ করে থাকেন। আগামী কয়েক বছর রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখার জন্য আপাতত এই স্বপ্নটাই একমাত্র বিশল্যকরণী।
সেই বিকশিত ভারতের সোনালি ছবিকে সামনে রেখে তার সঙ্গে মানানসই করে নতুন নতুন নির্মাণের কাজ এখন থেকেই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। উন্নত ভারতের নমুনা হিসাবে ইতিমধ্যেই হাজির করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অতি স্বাদের নতুন সংসদ ভবন। অনেক ঘটা করে সাড়ম্বরে যাগযজ্ঞ সহযোগে সাধু-সন্ন্যাসীদের উপস্থিতিতে উদ্বোধন হয়েছিল উন্নত ভারতের উপযোগী সংসদ ভবন। গুজরাট থেকে নিজের পছন্দের স্থপতিকে এনে দায়িত্ব দিয়েছিলেন চোখ ধাঁধানো বিলাসবহুল এই ভবন নির্মাণের। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য নির্মাণের পর প্রথম বর্ষার প্রথম বর্ষণেই উন্নত ভারতের আধুনিক সংসদ ভবনের ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়তে থাকে। হতবাক কর্মীরা বড় অকারের প্লাস্টিকের বালতি বসিয়ে সেই জল সংগ্রহ করে বাইরে ফেলার ব্যবস্থা করেন যাতে মেঝে ভেসে না যায়। শুধু ১২০০ কোটি টাকার ভবনের ফুটো ছাদ দিয়ে জল পড়া নয়, গোটা সংসদ চত্বর জল থইথই। অবস্থা। ভবনের প্রধান গেটের সামনে হাঁটু জল। বোঝাই যাচ্ছে জনগণের করের টাকা ঢেলে কেমন পরিকল্পনা হয়েছে। এর আগে জি-২০ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে প্রগতি ময়দানে তৈরি হয়েছিল বিশ্বমানের কনভেনশন ও এক্সিবিশন সেন্টার। ঝলমলে সাজানো নির্মাণে প্রদর্শনী চলাকালীন বৃষ্টির জলে ডুবে যায়। ময়দানে যাবার বিশেষ পাতাল পথ চলে যায় জলের তলায়। বন্ধ করে দিতে হয় সেই পথ। এক্ষেত্রেও নির্মাণের দায়িত্বে ছিল মোদীর ঘনিষ্ট গুজরাটের স্থপতি। বিকাশের আর এক আশ্চর্য নিদর্শন হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল মুম্বাইয়ের সমুদ্র সেতুকে। বিকশিত ভারতের জন্য এই ব্রিজ উৎসর্গ করেছিলেন মোদী। বছর কাটতে না কাটতেই সেই ব্রিজে ধরা পড়ে গুরুতর ফাটল। কিছুকাল আগে সামান্য বৃষ্টিতে উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশের কগেকটি বিমান বন্দরের অত্যাধুনিক নির্মাণ ধরে পড়ে। ভেঙে পড়ে বিমান বন্দরের ছাদ।
সবচেয়ে চমক সৃষ্টি হয় অযোধ্যার রাম মন্দিরে। পরমাত্মা প্রেরিত অজৈবিক প্রধানমন্ত্রীর হাতে শিলান্যাস ও উদ্বোধন হয়েছিল এই মন্দিরে। দেশ জুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করা হয়েছিল রাম মন্দিরের উদ্বোধনকে ঘিরে। সেই মন্দিরে প্রথম বৃষ্টির ধাক্কাতেই ছাদ ফুটো হয়ে রামের মূর্তির মাথায় জল পড়তে থাকে। মোদীর স্বপ্নের আধুনিক উন্নত ভারতের কিছু নমুনা মাত্র। আসলে হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা নেতারা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি উন্নত বা বিকশিত ব্যাপারটা ঠিক কেমন। শুধু টাকা ঢেলে বড় নির্মাণ করলেই উন্নত হওয়া যায় না। তার জন্য আগে শিক্ষায়, চেতনায়, বোধে, যুক্তিতে, বিজ্ঞানে উন্নত হতে হয়। সততায়, নৈতিকতায়, আদর্শে উন্নত হতে হয়। তা না হলে উন্নত ভারত হবে গোরুর গাড়িতে হেড লাইট লাগানোর মতোই।
Comments :0