November Revolution

নভেম্বর বিপ্লব ও মহামারী নিয়ন্ত্রণ

সম্পাদকীয় বিভাগ

November Revolution

রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে অঙ্গাঙ্গী ভাবে সম্পর্কিত তা প্রথম হাতে-কলমে প্রমাণিত হয় বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়। এপিডেমিক টাইফাস, স্মল পক্স, প্লেগ, ম্যালেরিয়ার মত রোগের মহামারীতে বিধ্বস্ত ছিল প্রাক-বিপ্লব রাশিয়ার ট্রপিক্যাল অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখন্ডের বহু ভাষাভাষী, বহু সংস্কৃতির জাতিসমূহ। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সংক্রামক রোগে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার ছিল জার-শাসিত রাশিয়াতেই। উণবিংশ‌ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই শহরে ও গ্রামে উকুন-বাহিত টাইফাসের বাড়বাড়ন্ত হয় মূলতঃ শীতপ্রধান অঞ্চলের গরীব মানুষের অপরিসর আবাসনে, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের‌ শেষের দিকে  বৃহৎ মাত্রায় পরিযাণের ফলে তা মহামারীর আকার নেয়। ১৯১৮ থেকে ১৯২৫ সাল অব্দি প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় টাইফাসে। 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, টাইফাসের জীবাণু রিকেটসিয়া মাসের পর মাস নোংরা জামাকাপড়ে, ধুলোবালির মধ্যেও বেঁচে থাকে, বাহক উকুন শরীরে কামড়ালে তা চুলকে ফেললেই রক্তে জীবাণু মিশে যায় এবং টাইফাসে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৫ থেকে ৪০ শতাংশ। নভেম্বর বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধ, শ্বেতসন্ত্রাস ও দুর্ভিক্ষের ফলে বহু মানুষ বাধ্য হলেন গ্রাম ছেড়ে মস্কো বা সেন্ট পিটসবার্গে কাজের খোঁজে পাড়ি দিতে। সমীক্ষায় দেখা গেল এই পরিযায়ী শ্রমিকদের ও লালফৌজের মধ্যেই টাইফাস সংক্রমণ সর্বাধিক। মস্কোতে ও পেত্রোগ্রাদে আক্রান্তের সংখ্যা ১৯১৭ সালে ছিল যথাক্রমে ১০৯৫ ও ৫১৭, ১৯১৮-তে বেড়ে দাঁড়ালো ৬৯৮৮ ও ১০৯৭৬। বিপ্লবোত্তর গৃহযুদ্ধ ও শ্বেতসন্ত্রাসের বাতাবরণে ১৯২০ সালে উরাল থেকে সাইবেরিয়া, ইউক্রেন থেকে ভল্গা টাইফাস ছড়িয়ে পড়ল। অভিজাত শ্বেত প্রতি-বিপ্লবীদের মধ্যে তুলনায় অনেক কম ছড়ালেও মার্কিন রেড ক্রস মূলতঃ তাদেরই চিকিৎসা পরিষেবা দিচ্ছিল।

 অন্যদিকে লালফৌজের অবস্থা সঙ্গীন। খাদ্য ও পোষাক অপ্রতুল, সাবান বা দাড়ি কাটার ব্লেড সরবরাহ নেই, জ্বালানী বাড়ন্ত - প্রবল শীতে স্নান একপ্রকার অসম্ভব। রেলস্টেশন, ওয়েটিং রুম ও ট্রেনের কামরাগুলো উকুনে ভর্তি, টাফাসের আঁতুড়ঘর। ফেব্রুয়ারি ১৯১৮-তে লালফৌজে ও অসামরিক জনগণের মধ্যে টাইফাসে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬৬,১১৩ ও ৩,৮৯,৮৫৪। পরের বছর লালফৌজে টাইফাস আক্রান্তের হার বেড়ে হল প্রতি হাজারে ২০৪ জন। সারা দেশেই চিকিৎসকের সংখ্যা কম। তাঁদের মধ্যে ৪ হাজার চিকিৎসক আক্রান্ত হন, আটশো‌জন মারা যান। লালফৌজের সাড়ে তিন হাজার ডাক্তারের মধ্যে ১১৮৩ জন আক্রান্ত হন, ২৩৫ জন মারা যান। 

১৯২০ সালের ১-লা মার্চ অল রাশিয়া মেডিক্যাল ওয়ার্কার্সের দ্বিতীয় কংগ্রেস উদ্বোধন করে লেনিন বলেন, 'যুদ্ধক্ষেত্রে ফৌজ ছাড়া আপনাদের আত্মত্যাগের আর কোন তুলনা চলে না। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের চার বছর মৃত্যু ছাড়াও কোটি কোটি মানুষকে পঙ্গুত্ব আর মহামারী উপহার দিয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবে উন্নয়নের কাজ করে যেতে চাই। যে রক্তাক্ত যুদ্ধে নামতে আমরা বাধ্য হয়েছি, সেখানকার অভিজ্ঞতা আমরা রক্তপাতহীন যুদ্ধে কাজে লাগাবো। গৃহযুদ্ধে যে প্রত্যয় ও অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি, তার সবটুকু মহামারীর মোকাবিলায় ব্যবহার করব। একটা সময় ছিল যখন চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত পেশাজীবীদের অবিশ্বাসের চোখে দেখত সর্বহারারা, একটা সময় অব্দি সেই পেশাজীবীরাও ভাবছিলেন ফের বুর্জোয়া জমানা ফিরে আসবে। কিন্তু আজ তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে সর্বহারাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই রাশিয়ায় একটা বিকাশমান সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব। একমাত্র বৈজ্ঞানিক ও শ্রমিকদের পারষ্পরিক সহযোগিতাই পারে নিপীড়ন, দারিদ্র, রোগবালাই ও আবর্জনা থেকে মুক্ত করতে। এবং তা আমরা করবই। কোন অন্ধকারের‌ শক্তি বৈজ্ঞানিক, প্রোলেতারিয়েত ও প্রযুক্তিবিদদের ঐক্যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।'

তখন সবে জানা গেছে যে উকুন টাইফাসের বাহক, তবে উকুন নিধনের কোন পন্থা, টাইফাসের কোন ওষুধ জানা ছিল না। পার্টি সম্মেলনে লেনিন বললেন, 'হয় উকুন সমাজতন্ত্রকে পরাজিত করবে, নয় সমাজতন্ত্র উকুনকে পরাস্ত করবে।' যে এপিডেমিক টাইফাস রাশিয়ায় কয়েকশো বছর ধরে মহামারী বাধিয়ে আসছিল, বিপ্লবের মাত্র দু'দশকের মধ্যেই সেই রোগকে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে সোভিয়েতের জনমুখী প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যনীতি ও তার যথাযথ প্রয়োগের সুবাদে। জারের আমলে কোন কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী বা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল না। রাশিয়ান উপনিবেশগুলোতে কার্যতঃ কোন স্বাস্থ্য পরিকাঠামোও ছিল না। লেনিনের‌ নেতৃত্বে পরপর কয়েকটি অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নেওয়া হল। গৃহযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই সকলের জন্য নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু করা হয়। রোগীর সংক্রামক রোগ সম্পর্কে গোপনীয়তা রক্ষার যে বাধ্যবাধকতা চিকিৎসকের ছিল, তার অবলুপ্তি ঘটিয়ে রোগ ও রোগীর বিশদ জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা চিকিৎসকের অবশ্যকর্তব্য বলে মেডিক্যাল ম্যানুয়ালে ঘোষিত হল 'ব্যক্তির স্বার্থের উর্ধ্বে সমষ্টির স্বার্থ' - এই যুক্তিতে। 

১৯১৮ সালেই সারা দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে এক ছাতার আওতায় আনা হয় জনস্বাস্থ্য গণপরিষদ (পিপলস কমিসারেট  অব পাবলিক হেলথ) গঠনের মাধ্যমে। ঐবছরেই 'মহামারী মোকাবিলায় ব্যবস্থাদি' শীর্ষক ডিক্রী জারি হল, যেখানে মহামারীকে বলশেভিক সরকার নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান বিপদগুলোর অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সরকারের প্রশাসনিক পদক্ষেপের পরিপূরক হিসেবে রাজনৈতিক উদ্যোগে সমস্ত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীতে পার্টি, গণসংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন ও সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হল। ঠিক পরের বছর লেনিনের স্বাক্ষরিত আরেকটি ডিক্রী জারি হল 'বাধ্যতামূলক গুটিবসন্ত টীকাকরন বিষয়ে'। জনস্বার্থে সংক্রামক রোগের চিকিৎসা ও প্রতিষেধক বাধ্যতামূলক করার সূচনা এখান থেকেই। এই লক্ষ্যে তিন ধরণের পরস্পর-সংযুক্ত স্যানিটারি স্টেশন খোলা হয় দেশের প্রতিটি প্রান্তে ও কোণে, কেন্দ্রীয়ভাবে যেগুলির সমন্বয় রক্ষার দায়িত্বে থাকল জনস্বাস্থ্য গণপরিষদ - ১) সাধারণ স্বাস্থ্যবিধির জন্য স্টেশন, ২) অ্যান্টি-প্লেগ স্টেশন, যেখানে প্লেগ ছাড়াও কলেরা, গুটিবসন্ত, টুলারেমিয়া, অ্যান্থ্রাক্স, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি অত্যন্ত সংক্রামক রোগেরও মহামারী মোকাবিলা হয়, ৩) অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া স্টেশন। এই স্টেশনগুলোই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহামারী মোকাবিলার ভিত্তিপ্রস্তর। যদিও বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধের সময়কালে টাইফাসের তুলনায় প্লেগ ও ম্যালেরিয়ার ঝক্কি অনেক কম ছিল, টাইফাস নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বাকী দুটি রোগ নিয়ন্ত্রণ কঠিনতর ছিল। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি পালন ও জামাকাপড়, বিছানাপত্তর উকুনমুক্ত করার চেয়ে মশা ও ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন। যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক পুনর্গঠন শুরু হতেই শিল্পায়নে, নির্মানকার্যে ও নতুন বসতি গড়ে ওঠায় গতি এল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মশা ও ইঁদুরের উপদ্রবও বাড়তে থাকল। বিশেষতঃ, কেন্দ্রীয় এশিয়া, ককেশিয়া ও সাইবেরিয়া অঞ্চলে নতুন করে প্লেগ ও ম্যালেরিয়া ছড়াতে শুরু করল। প্লেগ নিয়ন্ত্রণে নতুন সরকার অর্থবরাদ্দ চতুর্গুন করার পাশাপাশি চিকিৎসকদের দীর্ঘদিনের দাবী মেনে 'প্রথম আলেক্সান্ডার প্লেগ ল্যাবরেটরি'-কে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে কাস্পিয়ান সাগরতীরের সারাটভ শহরে স্থানান্তরিত করে তাকে ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী করা হল, কারণ ঐ অঞ্চলেই প্লেগের বাড়বাড়ন্ত সবচেয়ে বেশী। 'প্লেগ মহামারী নিয়ন্ত্রণের কাজে যুক্ত শ্রমিকদের সুযোগসুবিধা সম্পর্কিত' ডিক্রী জারি হল। 

প্লেগের উৎস খুঁজতে অধ্যাপক জ্যাবোলটনির নেতৃত্বে ১৯২০ সালে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দল পাঠানো হল সেন্ট্রাল এশিয়া ও কাজাখস্তানে। ভারত ও আফগানিস্থান থেকে প্লেগ রোগ বয়ে আসছে এই ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গে তাঁরা প্রমাণ করলেন ঐ অঞ্চলের কাঠবিড়ালিদের মধ্যেই রয়েছে উৎস। ১৯৩০ সালে লেভ জিলবারের নেতৃত্বে আরো একটি দল আজারবাইজানে গিয়ে প্রত্যক্ষ করল কঠোর কোয়ারান্টাইনের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না, স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ টীকাকরণে অনাগ্রহী এবং তাঁরা আধুনিক চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যেতেও নারাজ। তাঁরা ওঝা-গুণীনদের উপর নির্ভরশীল। জিলবার লালফৌজকে কাজে লাগিয়ে বিষাক্ত ক্লোরপিকরিন কীটনাশক ছড়িয়ে পুরো অঞ্চলের সমস্ত আগাছা পুড়িয়ে কাঠবিড়ালী নিধন করে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনেন। প্রত্যেক অ্যান্টি-প্লেগ স্টেশনে একজন করে এপিডেমিওলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, জুলজিস্ট ও প্যারাসাইটোলজিস্ট নিয়োগ করা হল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েই এঁদের সরকারী কাজে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সীমান্তে ও দেশের অভ্যন্তরে কড়া নজরদারী নিশ্চিত করা হয়। ২৫ শতাংশ মৃত্যুহার হওয়ায় প্রতি বছর যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্লেগে মারা যেত, সেখানে ১৯৩০ সাল থেকে প্রকোপ কমতে কমতে ১৯৩৭ সালের পর প্লেগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল দেশ‌ থেকে।

 অবশ্য সোভিয়েত জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেমে থাকল না, কারণ মানুষের আক্রান্ত হওয়া ঠেকানো গেলেও মাটির নীচে ইঁদুরদের মধ্যে প্লেগের জীবাণু তখনো রয়ে গেছে। অ্যান্টি-প্লেগ স্টেশনের নেটওয়র্ককে এবার মাটির নীচে ইঁদুর নিধনের কাজে নামানো হল। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ - পাঁচ বছরে কাস্পিয়ান অঞ্চলে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ইঁদুর ও কাঠবিড়ালীমুক্ত করা হয় বহু সহস্র শ্রমিক-কৃষকের স্বেচ্ছাশ্রমে। এধরণের ও এত বড় মাপের কাজ বিশ্বে সমসাময়িক কালে তো অকল্পনীয় ছিলই, আজকের দিনেও তাই। একাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল যৌথ খামার, যৌথ রাষ্ট্রীয় রান্নাঘর ও বিপ্লবী চেতনায় শানিত শ্রমিক-কৃষকের শৃঙ্খলাবদ্ধতার জন্যই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবার কয়েকটি জায়গায় প্লেগের দু'চারটে উৎস খুঁজে পাওয়া গেলে তড়িঘড়ি সেইসব অঞ্চলে ছ'টি প্লেগ রিসার্চ ইন্সটিটিউট, ২৭-টি প্লেগ কন্ট্রোল স্টেশন ও তাদের ৫২-টি অতিরিক্ত শাখা খোলা হয়, যেগুলো দ্রুত প্লেগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নতুন উন্নত টীকা উদ্ভাবন, অ্যান্টি-প্লেগ সেরাম প্রস্তুত, ইঁদুর ও ইঁদুরের গায়ে লেগে থাকা প্লেগের বাহক মাছির জীবনচক্র ও বৈশিষ্ট নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। সোভিয়েত ভেঙ্গে গেলেও এই সমগ্র পরিকাঠামোটি আজও রাশিয়ায় কাজ করে চলেছে।

প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু সত্বেও ১৯১৭ সালের আগে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের সরকারী কোন ব্যবস্থাই ছিল‌ না ওদেশে। ১৯১৩ সালে পিরোগভ সোসাইটি অব রাশিয়ান ফিজিশিয়ানসের অষ্টম কংগ্রেস থেকে ম্যালেরিয়া মোকাবিলায় যে সাতটি পদক্ষেপের সুপারিশ চিকিৎসকরা করেছিল, জারের সরকার তাতে আমল না দিলেও বলশেভিক জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সেই সবক'টি সুপারিশ গ্রহণ করে - ১) রবার্ট ককের পদ্ধতি মেনে সমস্ত রোগীকে ক্যুইনাইন দিয়ে চিকিৎসা, ২) ইতালীয় পদ্ধতিতে পুকুর সংস্কার ও নিকাশী, ৩) জলাভূমিতে প্যারাফিন ছড়িয়ে মশা নিধন, ৪) রেলপথের দুধারে চাষজমি পুনরুদ্ধার করে তা বুজিয়ে ফেলা ও স্থানীয়দের রেলে চাকরী দেওয়া ৫) স্থানীয় ভাষায় সহজ সচিত্র সচেতনতা প্রচার ও জনপ্রিয় লোকসংস্কৃতিকে একাজে ব্যবহার, ৬) প্রতিটি ম্যালেরিয়া রোগীর বাধ্যতামূলক নথিভূক্তি ও নিখরচায় চিকিৎসা। ১৯২১ সালে জনস্বাস্থ্য গণপরিষদ এই মর্মে ডিক্রী জারীর মাধ্যমে সোভিয়েত ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ পরিষেবা চালু করে। 

ঐবছরেই অধ্যাপক মার্টজিনোভস্কির নেতৃত্বে মোট এগারোটি ইন্সটিটিউট অব ম্যালেরিয়া, প্যারাসাইটোলজি অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন প্রতিষ্ঠিত হয় এগারোটি ম্যালেরিয়া অধ্যূষিত প্রদেশে। সেসময় ম্যালেরিয়ার একমাত্র ওষুধ ক্যুইনাইনকে সম্পূর্ণ করমুক্ত করা হয়। পরের‌ দু'বছরে অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া স্টেশনের এক বিশাল নেটওয়র্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়, স্টেশনের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১৯৪০ সালে ১২৩৬-এ পৌঁছায়। ১৯২০ সালের মাঝামাঝি রোগের প্রকোপ অনেকখানি নেমে এলে সরকারের নজর ঘুরল আপৎকালীন ব্যবস্থা থেকে দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণে। ক্যুইনাইনের সংকট মেটাতে তা আর অনুমানভিত্তিক রোগে ব্যবহৃত না হয়ে শুধুমাত্র নিশ্চিত রোগীর উপর প্রয়োগের জন্য তুলে রাখা হল ১৯৩০ সালে ইন্সটিটিউট অব ম্যালেরিয়া কর্তৃক ক্যুইনাইনের কৃত্রিম বিকল্প আবিষ্কারের আগে অব্দি। নিকাশী ও সেচ ব্যবস্থা এমনভাবে ঢেলে সাজানো হল যাতে জল জমে মশা না জন্মাতে পারে। 

এতদসত্বেও ১৯৩৫ সালে নতুন করে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ৯০ লক্ষ ছাড়ালো। ভল্গা, উত্তর ককেসাস ও সেন্ট্রাল এশিয়ায় ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া। চার কোটি শ্রমদিবস নষ্ট হয় একবছরে। পার্টির অষ্টম কংগ্রেসের রিপোর্টে ম্যালেরিয়াকে শিল্পায়নের অসহনীয়  বিপর্যয় বলে চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীতে বৈপ্লবিক গতিসঞ্চারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরের বছর অর্থবরাদ্দ চারগুণ বৃদ্ধি পেল। সমস্ত চিকিৎসককে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন ও পুনঃসংক্রমণের রোগীদের দ্রুত রোগনির্ণয় ও আমূল চিকিৎসার পাশাপাশি ব্যাপক গণ-উদ্যোগে মশার জন্মস্থান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। 

মস্কো ইনস্টিটিউট অব ম্যালেরিয়া নতুন ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ওষুধ বাইগুম্যাল আবিষ্কার করল, বাড়ি বাড়ি ডিডিটি স্প্রের প্রবর্তন করল। শ্রমিক-কৃষকদের স্থানীয় কমিটিগুলোর সহায়তায় জনস্বাস্থ্যকর্মীরা দৈনিক প্রতি কমিউনে ও বাড়িতে জ্বরের সমীক্ষা চালায়। এইসব কর্মকান্ডের ফলে ১৯৪০ সালের মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার তলানিতে এসে ঠেকল। এত কম সময়ের মধ্যে এত বড় সাফল্য বিশ্বে অতুলনীয়। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৫০-এর দশকে শুধু এই মডেলকে হাতিয়ার করে অন্যান্য দেশে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার খোলনলচেই বদলে দিল না, তারা সোভিয়েতের মাটি থেকে ১৯৫০ সালে কোয়ার্টান ম্যালেরিয়া, ১৯৫৭ সালে ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া ও ১৯৬০ সালে টার্শিয়ান (ভাইভ্যাক্স) ম্যালেরিয়া নির্মূল ঘোষণা করল। অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া স্টেশনসমূহের সুবিশাল নেটওয়র্ককে অন্যান্য পরজীবীজনিত রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হল। ১৯৬১ সালে তাসখন্দে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলনে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে এই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনের সার্টিফিকেট সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে তুলে দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ম্যালেরিয়া বিভাগের তদানীন্তন প্রধান ডাঃ ব্রুস শোয়াট বললেন এই অসাধ্যসাধনের কৃতিত্ব রাশিয়ার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, সর্বোপরি শ্রমিক-কৃষকদের।

এধরণের শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা পশ্চিমা দুনিয়া কল্পনাও করতে পারে না।
সোভিয়েত রাশিয়ায় মহামারী নিয়ন্ত্রণ প্রমাণ করে দিয়েছে যে জনস্বাস্থ্য এবং মহামারী নিয়ন্ত্রণ আসলে একটি সামাজিক বিজ্ঞান, যা কোনভাবেই শ্রেণী-নিরপেক্ষ নয়। রাষ্ট্রের উদ্যোগ, রাজনৈতিক অগ্রাধিকার, সমাজের নীচের তলার অর্থনৈতিক বিকাশ ও মানুষের সামূহিক অংশগ্রহণ বাদ দিয়ে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব নয়।

Comments :0

Login to leave a comment