একদা বিপুল আড়ম্বরে ধুমধাম করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন তাঁর স্বাদের ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’। এই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগানের মর্মার্থ হিসাবে সামনে আনা হয়েছিল অনেকগুলি বিষয়।
কন্যাভ্রূণ হত্যা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি। নারী শিক্ষায় গুরুত্বদান, নাবালিকা বিবাহ বন্ধ করা ও কম বয়সে মা হওয়া আটকানো। নারী পাচার বন্ধ করা, সমাজে ও পরিবারে নারীদের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি। পথেঘাটে ও কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম নিশ্চিত করা। সর্বক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য নির্মূল করা, সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত করা।
একটা সুসভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে নারীদের যোগ্য অবস্থান নিশ্চিত হতে পারে এই বিষয়গুলি পরিপূর্ণতা পেলে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী দর্শনে যে সভ্যতা ও সমাজ কাঙ্ক্ষিত সেখানে নারীর সমানাধিকার স্বীকৃত নয়। হিন্দুত্ববাদের গোড়াতেই শেকড় গেড়ে আছে পুরুষতন্ত্র। শুধু পুরুষতন্ত্র বললেই সবটা বলা হয় না, উচ্চ বর্ণের পুরুষতন্ত্র। তাই আরএসএস কর্তাদের মুখে শোনা যায় নারীর আসল স্থান গৃহকোণে।
বিবাহ হলো এমন একটি চুক্তি যেখানে পুরুষকে সুখ দেবার বিনিময়ে নারী তার ভরণ পোষণের উপকরণ পায়। এমনও বলা হয় নারীর কাজ সংসার সামলানো, সন্তান উৎপাদন, সন্তানদের লালনপালন এবং পুরুষদের সেবা করা। এহেন হিন্দুত্ববাদী, আদর্শে চালিত বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগান দিয়েছেন। জুমলাবাজির এটাও একটা নমুনা।
শুধু স্লোগান দেননি ২০১৬ সালের অলিম্পিকে পদক জয়ী মহিলা কুস্তিগির সাক্ষী মালিককে করা হয় ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’-র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার। প্রধানমন্ত্রীর নারী দরদের যেন তুলনা হয় না। এই সাক্ষী মালিক সহ মহিলা কুস্তিগিররা যারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক পেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন তারা যখন যৌন লাঞ্ছনার গুরুতর অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীরই ঘনিষ্ট দলীয় সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার দাবিতে প্রায় এক বছর ধরে লড়াই করেছন তখন নারী প্রেমী প্রধানমন্ত্রী একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি বরং তাঁর সরকার সবদিক থেকে অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে রক্ষা করারই ব্যবস্থা করেছে।
উত্তর প্রদেশে বিজেপি’র প্রভাবশালী নেতা ব্রিজভূষণ ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সর্বময় কর্তা হিসাবে নারী কুস্তিগিরদের যৌন নির্যাতনের আখড়ায় পরিণত করেছেন ফেডারেশনকে।
ন্যায় বিচারের দাবিতে বিশ্বসেরা ভারতীয় কুস্তিগিররা রাস্তায় বসে প্রতিবাদ অবস্থান করেছেন দিনের পর দিন। ফিরেও তাকায়নি মোদী সরকার। এফআইআর হলেও তদন্ত এগোয়নি। শেষে নিয়মরক্ষার তদন্ত হলেও তার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। নেওয়া হয়নি ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাও।
মহিলা কুস্তিগিরদের যন্ত্রণা ও আর্তিতে মোদী সরকার সাড়া না দিলেও আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ভারতকে বহিষ্কার করে। অবশেষে চাপে পড়ে পদত্যাগ করতে হয় ব্রিজভূষণকে। কিন্তু নারীরা ন্যায় বিচার পাননি। নতুন করে নির্বাচন হয় ফেডারেশনে। যথারীতি জয়ী হয় ব্রিজভূষণেরই জনৈক পাদুকাবাহী।
তথাপি আন্তর্জাতিক ফেডারেশন নিষেধাজ্ঞা তোলেনি। জানিয়ে দেয় নারী নির্যাতনের সাজা না হলে বহিষ্কার বহাল থাকবে। বিশ্বের কাছে দেশের মান মর্যাদা ধূলিসাৎ হতে থাকায় শেষে নির্বাচিত নতুন কমিটিকে বাতিল ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু ব্রিজভূষণ থেকে যায় বহাল তবিয়তে।
তাঁরা তাঁদের পদক, দেশের দেওয়া সম্মান-পুরস্কার ফেরত দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। পুলিশ মোদীর কাছে তাদের পৌঁছাতে না দেওয়ায় রাস্তার ফুটপাতে সযত্নে পদক রেখে এসেছেন প্রধানমন্ত্রীকে দেবার জন্য। যথারীতি প্রধানমন্ত্রী নীরব। তিনি এখন অযোধ্যায় ধর্মোম্মাদনায় ব্যস্ত। গরিবের ভগবান হতে প্রাণপাত করছেন ভোটের লোভে।
Comments :0