NOVEMBER REVOLUTION

নভেম্বর বিপ্লবের আলোকে আজকের সময়

সম্পাদকীয় বিভাগ

November Revolution communism CPIM

নভেম্বর বিপ্লবের পর দুনিয়া ১০৫ বছর অতিক্রম করেছে। এই সময়ের মধ্যে দুনিয়া জুড়ে ঘটনার ঘনঘটা। সমাজ, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, অর্থনীতি, মনন জগৎ - সব বিষয়েই। ঘাত-প্রতিঘাতে ওলট পালট হয়েছে নানারকম। পুঁজিবাদের দাপট-সংকট, সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি-বিপর্যয় বহু কিছু। উৎপাদন, মুনাফা, বন্টন, বৈষম্যের নতুন নতুন রূপ। সব কিছু সত্বেও নভেম্বর বিপ্লব বিশ্বের ইতিহাসকে যে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। এই যুগান্তকারী ঘটনা মার্কসবাদের সৃজনশীল-বিজ্ঞানকে সুষ্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাসের অনিবার্য গতি যে শোষণমুক্ত মানব সমাজের দিকেই তা ক্রমশই স্পষ্ট হয়েছে।
বিশের শতকে নয়ের দশকে সোভিয়েতের বিপর্যয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তার ‘দ্য এন্ড অফ হিষ্ট্রি অ্যান্ড দি লাস্ট ম্যান’ গ্রন্থে ‘কমিউনিজমের শেষ’ ঘোষণা করেছিলেন। পরে তাকেও সরে আসতে হয়েছে। ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া আর্থিক মন্দার এখনও নিরসন হয়নি। এই আর্থিক মন্দার কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজতে তাবড় তাত্ত্বিকদের কার্ল মার্কসের দাস ক্যাপিটালে মুখ গুঁজতে হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা জানালো - বিশ্বমন্দার ছ মাসের মধ্যে মার্কস-এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহারের বিক্রি বেড়েছে নয় গুণ। আর ‘দাস ক্যাপিটালের’ তিন গুণ।


[২]
পুঁজির সর্বগ্রাসী চরিত্রকে পরিস্কার করে তুলে ধরতে কার্ল মার্কস ‘ক্যাপিটাল’-এর প্রথম খন্ডে ৩১ তম অধ্যায়ের ফুটনোটে তুলে ধরলেন টি জে ডনিংয়ের একটি মূল্যবান মন্তব্য - ‘যথেষ্ট মুনাফা পেলে পুঁজি খুবই সাহসী  হয়। ১০ শতাংশ মুনাফা হবে জানলে যে কোন জায়গায় ব্যবসা করতে পারে। ২০ শতাংশ মুনাফায় তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ৫০ শতাংশ মুনাফা দেয় ঔদ্ধত্য। ১০০ শতাংশ মুনাফা তাকে মানবিকতার নীতি সমূহকে পদদলিত করার সাহস যোগায়, আর ৩০০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে হেন কোন অপরাধ নেই যা সে করতে পারে না। এমনকি মালিককে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পর্যন্ত পারে’। পুঁজির এই সর্বগ্রাসী চেহারা আজ ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে। দুনিয়া জুড়ে লগ্নিপুঁজির দাপট। ফাটকা কারবারীদের যেন রাজত্ব। নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ সমস্ত কিছু বাতিল করে ধাবিত লগ্নিপুঁজি। তাতে সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্য পূরণ হলেও পুঁজিবাদ তার সংকট থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। সংকটের বোঝা মানুষের উপর চাপিয়ে দেবার নিত্য নতুন কৌশল। আর তার বিরুদ্ধে জীবনের সংগ্রামে মানুষ। একদিকে আরও দক্ষিণপন্থার আক্রমণ এবং অন্যদিকে তাকে রুখে দিতে সংগ্রামের পথে মানুষ। তার প্রতিফলন ক্রমশই বাড়ছে।

 

[৩]
দুনিয়া জুড়েই অর্থনীতির সংকট বাড়ছে। আই.এম.এফ.এর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে দুনিয়া জোড়া আর্থিক বৃদ্ধির হার যা ২০২১ সালে ছিল ৬ শতাংশ, তা কমে ২০২২ সালে ৩.২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ২.৭ শতাংশ দাঁড়াবে। বিশ্বজোড়া মুদ্রাস্ফীতির হার ২০২১ সালের ৪.৭ শতাংশের থেকে ২০২২ সালে ৮.৮ শতাংশে দাঁড়াবে। এরই সাথে রাশিয়ার উপর জারি করা নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলিতে খাদ্য এবং জ্বালানির টান পড়বে। জিনিসপত্রের দাম ক্রমশ বাড়ছে। এ সবের ফলশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম দারিদ্র, ক্ষুধা এবং অপুষ্টির শিকার হতে চলেছে। বিশাল অংশের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার বিপদে পড়তে চলেছে। আমাদের দেশেও জিডিপি বৃদ্ধির হার ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে। মূল মূল পরিকাঠামো ক্ষেত্রের উৎপাদন গত কয়েক মাসেই প্রায় দশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জিনিসপত্রের দামে সর্বকালীন রেকর্ড। টাকার  মূল্য ক্রমশ কমছে। মোদি সরকারের আট বছরে এক ডলারের দাম ৫৮ থেকে বেড়ে ৮৩ টাকা হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ছে। কর্মসংস্থান ভয়ংকরভাবে কমছে। গ্রামীণ ক্ষেত্রে গত ছ’মাসে দেড় কোটি দরখাস্তকারীকে মনরেগায় কাজের ক্ষেত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষায় ২০২২-এ দেখানো হচ্ছে যে ২০২০ তে নতুন করে যে ৭ কোটি মানুষ দুনিয়ায় দারিদ্রের তালিকায় নেমে গেছে, তার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ৫.৬ কোটিই কেবলমাত্র ভারতের। বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭ নম্বরে। ক্ষুধা, দারিদ্র, অপুষ্টি, কর্মসংস্থান সব মিলিয়েই ভারতের হাল ক্রমশই নামছে।


[৪]
একদিকে যখন মানুষের জীবন-জীবিকার সংকট ক্রমবর্দ্ধমান, তখনই ধনীতম মানুষদের পাশে মোদী সরকার দরাজ হস্ত। ধান্দা পুঁজির রমরমা। উচ্চতম এই অংশকে ট্যাক্স ছাড় এবং ঋণ মকুব করেছে প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকা। আর উল্টোদিকে গরিব সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের খাদ্য কিংবা ওষুধে জিএসটি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে লুঠ অব্যাহত। ক্রমশই চওড়া হচ্ছে আর্থিক অসাম্য। আদানি আম্বানিদের জন্য মোদী সরকার। মানুষের জন্য নয়। ব্যাঙ্ক সহ সর্বত্র লুঠ করছে মোদীজীর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। আর লুঠের বোঝা মানুষের ঘাড়ে। এক অসহনীয় পরিস্থিতি। সর্বোচ্চ মুনাফার এই লুঠেরা বাহিনীর পিছনেই ট্রাম্প, বোলসেনারো, মোদীর বাহিনী। সেই পথেই হাজির হচ্ছে ইতালির নতুন সরকার। ফ্যাসিষ্টিক। ক্রমশই আরও দক্ষিণপন্থার দিকে চলতে থাকা। আক্রমণ, অত্যাচার, বিভাজনের পথ ধরেই চলছে। কিন্তু বিপর্যস্ত মানুষ তা মানবে কেন ? বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ বেড়েই চলেছে। বেঁচে থাকার খরচের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না বলে প্রায়শই কর্মবিরতির পথে ইংল্যান্ডের শ্রমজীবি জনগণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা ব্যালটের মধ্য দিয়ে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। নেদারল্যান্ডের বাস চালকরা ধর্মঘট করছেন। সুইজারল্যান্ডের নির্মাণ কর্মীরা প্রতিবাদের রাস্তায়। ফ্রান্সের শ্রমজীবি মানুষ প্রতিবাদ ধর্মঘটে সামিল। এরকমই বিভিন্ন দেশে বিদ্রোহের আঁচ। এটাই স্বাভাবিক। দক্ষিণপন্থার আক্রমণ যেমন বাড়ছে, মানুষের প্রতিবাদও তেমন বাড়ছে। ইতালি কিংবা সুইডেনে নির্বাচনে যেমন দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি এগিয়েছে, তেমনই বিশ্বজুড়ে নানান শহর কিংবা প্রদেশে অথবা ডেনমার্কের মত দেশে বামপন্থার শক্তির অগ্রগতিও স্পষ্ট হচ্ছে।


[৫]
এক্ষেত্রে ব্রাজিলে বামপন্থীদের জয় এবং বোলসেনারোর পরাজয় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সমস্ত আক্রমণ, চক্রান্তকে অতিক্রম করে মার্কিনী দাপট এবং লগ্নিপুঁজির সব ধরনের প্রচেষ্টার পরেও দ্য সিলভা লুলার জয়লাভ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সময়ের বিবেচনায় ট্রাম্প এবং ইজরায়েলের নেতিনেহানুর পর বোলসেনারোর পরাজয় ছিল জরুরী। চিলি কিংবা কলম্বিয়ার পর ব্রাজিলে বামপন্থীদের এই বিজয় ল্যাতিন আমেরিকা তো বটেই গোটা বিশ্বের বামপন্থী শক্তিকেই ভরসা যোগায়। বিকল্প লড়াইকে শক্তি যোগায়। লগ্নিপুঁজির মুনাফার লালসা কিংবা সাম্রাজ্যবাদী ও দক্ষিণপন্থীদের দাপট যে শেষ কথা হতে পারে না - সেই প্রত্যয়কেই সাহায্য করে।


[৬]
বিশেষত সোভিয়েতের বিপর্যয়ের পর দুনিয়াজুড়ে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে নেতিবাচক প্রচার প্রবল হয়েছে। মার্কসবাদ অচল, অসৎ, অপ্রাসঙ্গিক, শেষ - এরকম নানাবিধ। শুনতে শুনতে ক্লান্ত টেরি ইগেলটন ২০১১ সালে একটি বই লিখে ফেললেন – ‘হোয়াই মার্কস ওয়াজ রাইট।  মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে চমৎকার বললেন - ‘এই লোভনীয় দৃষ্টিভঙ্গীর শুধুমাত্র একটিই সমস্যা আছে। মার্কসবাদ হল পুঁজিবাদের সমালোচনা - পুঁজিবাদ সম্পর্কে আজ পর্যন্ত যা যা বলা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে অনুসন্ধানী, কঠোর এবং ব্যাপক সমালোচনা। এটিই একমাত্র সমালোচনা যা পৃথিবীর বড় বড় ক্ষেত্রকে বদলে দিয়েছে। অতএব যতক্ষণ পুঁজিবাদের কারবার থাকবে ততক্ষন মার্কসবাদকেও থাকতে হবে। শুধুমাত্র তার প্রতিপক্ষকে রিটায়ার করিয়ে তবেই এই মতাদর্শ রিটায়ার করতে পারে। এবং এখনো পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদ বরাবরের মতই চনমনে আছে।’
যদিও পুঁজিবাদ শেষ হলেই মার্কসবাদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। সাম্যবাদী সমাজ অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা মানবিক সমাজ গড়ে তোলার পথে মার্কসবাদকে সঙ্গে নিয়েই আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে।


[৭]
মার্কসবাদ কোন গোঁড়ামি নয়, বরং একটি ‘সৃজনশীল বিজ্ঞান’। সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণই তার ভিত্তি। মার্কসবাদ সাধারণভাবে ইতিহাসের এবং বিশেষত পুঁজিবাদের বিশ্লেষনের দৃষ্টিভঙ্গী। এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা সম্পর্কে চিন্তা এবং তত্ত¡কে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করে যেতে হয়। মার্কসবাদ তাত্তি¡ক বিকাশের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
কার্ল মার্কস বলেছিলেন - ‘দার্শনিকরা এ যাবৎ পৃথিবীকে কেবল বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাই করেছেন, কথা হলো তাকে পরিবর্তন করা’। নভেম্বর বিপ্লব দেখিয়েছে যে পৃথিবীকে বদল করা সম্ভব। নানান আক্রমণ, আঘাত সত্বেও নভেম্বর বিপ্লব এবং তার অবদান মানবসভ্যতার অগ্রগতির গতিমুখ নির্ধারনে সবচাইতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে। যুগান্তকারী এই ঘটনা। সমাজবিপ্লবের লড়াইএর অন্যতম অনুপ্রেরনা। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। নভেম্বর বিপ্লবের আলোকে, মার্কসবাদী চর্চায় এবং সমাজবিজ্ঞানের সচেতন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামকে পরিচালিত করাই আমাদের দায়িত্ব। কিভাবে তা কার্যকরী করব, সেটাই আমাদের দায়বদ্ধতা।

 

Comments :0

Login to leave a comment