দেবাশিস চক্রবর্তী
হাসপাতালে বোমা, শরণার্থী শিবিরে বিমান হানা, শিশুদের ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্তস্রোত, মায়েদের আর্ত চিৎকার, আগুন আগুন এবং সব সময়ে কালো ধোঁয়ায় ঢেকে থাকা আকাশ। সাত মাস ধরে আর কত বর্ণনা দেওয়া যাবে এর? আর কোন শব্দ খুঁজে আনা যাবে অভিধান থেকে?
লেখক-সাংবাদিক জামাল কানজ গাজার এই বীভৎসার দৃশ্য ধরতে বলেছেন টেলিভিশনে দেখা এক গাধার কথা। গাড়ি টানার চেষ্টা করছে গাধা, তার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অবশিষ্ট একটি মাদুর, তিন ক্ষুধার্ত শিশু এবং এক মধ্যবয়সি মা’কে টেনে নিয়ে যাবে ততোধিক ক্ষুধার্ত ওই গাধা। কিন্তু গাধা বিভ্রান্ত। তাকে যেদিকে যেতে বলা হচ্ছে সেদিক থেকেই তো তিন-চারদিন আগে তারা ফিরে এসেছিল, নিরাপদ জায়গায় আসছে বলে। গাজার কোনও অংশই ‘নিরাপদ’ নয়, ছিল না গত কয়েক মাসে, একথা পশ্চিমী নেতারা না বুঝলেও গাধা বোঝে। গাজার গাধাদের স্মৃতি পশ্চিমী রাষ্ট্রনেতাদের থেকে অনেক ভালো।
গাজায় এখন আর কেউ মৃত্যুকে সংখ্যায় গোনে না। তবু, এই লেখা পর্যন্ত ৩৮ হাজার মানুষ মারা গেছেন ইজরায়েলী আক্রমণে। ৮৪ হাজার মানুষ গুরুতর জখম ( কোনো কোনো হিসাবে সংখ্যা এক লক্ষের বেশি)। সকলেই জেনে গেছেন গাজার মাটিতে ধুলো হয়ে মিশে যাওয়া এই সংখ্যার বিরাট অংশই শিশু। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকাদের উদ্ধারের আর কোনও চেষ্টাও তেমন হচ্ছে না, কেননা না আছে হাসপাতাল, না আছে সমাধিক্ষেত্র। এই গণহত্যাকে ‘গণহত্যা’ বলা হবে কিনা, তা নিয়ে একশোবার বসেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিবেশন, আন্তর্জাতিক আদালত। বিবৃতির সমুদ্র তৈরি হয়েছে কিন্তু ইজরায়েলকে কেউ নিরস্ত করেনি, করতে পারেনি এবং করতে চায়নি। সমগ্র গাজাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে, চিরকালের জন্য বাসের অযোগ্য করে তুলে জমির দখল নেওয়ার ইজরায়েলী অভিযান যে চলতে পেরেছে তার কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা।
এক সময়ে রাফায় চলে আসতে ইজরায়েলী নির্দেশ গিয়েছিল গাজার অধিবাসীদের কাছে। তারপর রাফায় শুরু হয় বর্বর আক্রমণ। ইজরায়েল এবং ওয়াশিংটন বলে ‘হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে’। আল মাওয়াসি, বুরেজি এবং সর্বশেষ নুসেইরাতে শরণার্থী শিবিরে বোমা-ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের পরেও ইজরায়েল যে কোনও অপরাধ করছে তা বলতে পশ্চিমী নেতারা রাজি হননি। নুসেইরাতে আক্রমণ সাত মাসে সবচেয়ে মারাত্মক। ৬৫০ জনের বেশি শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থীকে সেখানে এক রাতে হত্যা করা হয়েছে। ৬৪ জন শিশু। প্রত্যেকটি আক্রমণের লক্ষ্য— হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির, রাষ্ট্রসঙ্ঘের দপ্তর, স্কুল— ইজরায়েল বলেছে তারা ‘তদন্ত’ করছে। পশ্চিমী মিত্ররা সমস্বরে বলেছে ইজরায়েল যখন ‘তদন্ত’ করছে তখন আর এত চেঁচামেচি কেন? প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই নতুনতর আক্রমণ হয়েছে। অথর্ব, বোধহীন, ধান্দাবাজ পশ্চিমী রাষ্ট্রনায়করা গাজাকে পুড়তে দেখে হয়ত আনন্দই পেয়েছেন।
গাধার কথায় ফিরে আসা যাক। কানজকে একটু ধার করেই বলা যেতে পারে, গাধা পশ্চিমী পুঁজিবাদী সভ্যতার ফসল না। ২ হাজার পাউন্ডের বোমা দুনিয়ার অন্যতম ঘনবসতির জাবালিয়া শিবিরে ফেলার মতো মন তার নেই। আমেরিকার পাঠানো বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে হাসপাতালের রোগীদের মেরে ফেলার মতো বুদ্ধি তার নেই। গাধা ঔপনিবেশিক ইতিহাসেরও ফসল নয় যে শ্বেতাঙ্গ জাতিবিদ্বেষের মর্ম সে বুঝবে। গাধা মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন, ফ্রান্সের ম্যাক্রঁ, ব্রিটেনের ঋষি সুনকের মতো হত্যাকাঙ্ক্ষী নয়। বরং সে মরে যেতে চাইবে। যাঁরা দেখেছেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে বিধ্বস্ত জাবালিয়া শিবিরের পথে পড়ে থাকা মৃত সেই গাধাটির ছবি।
এই লেখার সময়েই রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এই নিয়ে চতুর্থবার। এবারের প্রস্তাবটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনা, তারা দাবি করছে ইজরায়েল এই প্রস্তাবে সম্মত হবে। রাশিয়া ভোটদানে বিরত থেকেছে, অন্যরা সমর্থন করেছে। বহুবার সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাবে বাধা দেওয়ার পরে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপে ওয়াশিংটন এই প্রস্তাব পেশ করেছে। প্রস্তাবে সংঘর্ষবিরতিকে তিন পর্বে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্ব ছ’সপ্তাহের। এই সময়পর্বে আটক ইজরায়েলী বন্দিদের মধ্যে বয়স্ক, মহিলা এবং আহতরা মুক্তি পাবেন, বিনিময়ে ইজরায়েলের জেলে থাকা প্যালেস্তিনীয়দের একাংশ ছাড়া পাবেন। গাজার ‘বসতি এলাকা’ থেকে ইজরায়েলী সেনারা সরে আসবে। গাজার সর্বত্রই প্যালেস্তিনীয়রা নিজেদের বাড়ি ফিরতে পারবেন। গাজায় সাহায্য পাঠানো যাবে। দ্বিতীয় পর্বে সমস্ত সংঘর্ষ বন্ধ হবে, সব ইজরায়েলী বন্দিরা মুক্তি পাবেন, বিনিময়ে আরো প্যালেস্তিনীয় মুক্তি পাবেন। ইজরায়েলী সেনা পূর্ণ প্রত্যাহার হবে। তৃতীয় পর্বে কয়েক বছর ধরে গাজার পুনর্গঠন পরিকল্পনা রূপায়িত হবে।
হামাস সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছে। মধ্যস্থতায় বসতেও তারা রাজি। কিন্তু ইজরায়েল কি এই প্রস্তাব মেনে নেবে? গত বছরের অক্টোবর থেকে এযাবৎ ইজরায়েল যা করেছে তা গাজাকে প্যালেস্তিনীয়-মুক্ত করার অভিযান। প্যালেস্তাইনের প্রায় পুরো ভূখণ্ডই ইজরায়েলের দখলে। প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র তো দূরের কথা, দেশের স্বীকৃতিও দেয় না ইজরায়েল। গাজা পূর্ণ দখলে চলে এলে প্যালেস্তাইনের অস্তিত্ব কার্যত থাকবে না। উপরন্তু এখন তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, ভূমধ্যসাগর ঘেঁষে গাজার মাটির তলায় প্রচুর পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস রয়েছে। ইজরায়েল এবং তার মূল পৃষ্ঠপোষক মার্কিনীরা এই প্রাকৃতিক সম্পদের দখলও চায়। গাজা থেকে সেনা সরানোর কোনও ইচ্ছাই ইজরায়েলের নেই। সাময়িক সংঘর্ষবিরতি হতে পারে কেননা ইজরায়েলী বন্দিদের সকলকে মুক্ত করা যায়নি বলে ইজরায়েলের মধ্যেই বিক্ষোভ বিরাট মাত্রা নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন ভূমিকা দাঁড়িয়েছে গণহত্যা ও সংঘর্ষবিরতির মধ্যে ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা।
কেন? এর অন্তত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, দুনিয়াজুড়ে প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতি অভূতপূর্ব মাত্রা নিয়েছে। ইউরোপেও একের পর এক জনস্রোত আছড়ে পড়ছে রাস্তায়। আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র-শিক্ষকরা শিক্ষাঙ্গনেই বসে পড়েছেন। কলম্বিয়া, হার্ভার্ড, শিকাগো, বোস্টনের মতো নামী-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র ঘেরাও করেছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। ‘ইন্তিফাদা দীর্ঘজীবী হোক’ ফেস্টুনে ভরে উঠেছে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন। অনেকেই বলেছেন, আমেরিকার আরেকটি ‘ভিয়েতনাম মূহূর্ত’। বিশেষ করে অল্পবয়সিদের মধ্যে মার্কিন সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা তৈরি হয়েছে। সামনে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। নেতানিয়াহুর গণহত্যার সপক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে বাইডেনের গদি টলমল।
দ্বিতীয় কারণটি আরও প্রবল। এই তথাকথিত যুদ্ধে ইজরায়েল জিতছে না। আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেনের সমবেত শক্তি এবং ইজরায়েলের প্রভূত সামরিক সম্ভার সত্ত্বেও গাজার মাটিতে ইজরায়েল হারছে। হাজার-লক্ষের মৃত্যু, ৬০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস করেও গাজায় ইজরায়েলী সেনারা মার খাচ্ছে। প্যালেস্তাইনের প্রতিরোধ বাহিনীর সামনে স্থলযুদ্ধে নাকাল হচ্ছে ইজরায়েল। শুধু হামাসই না, অন্যান্য প্যালেস্তিনীয় রাজনৈতিক শক্তি এখন ঐক্যবদ্ধ। ইজরায়েলের ভূখণ্ডে রোজ আছড়ে পড়ছে হেজবুল্লাহ, ইরাক, ইয়েমেন থেকে উড়ে আসা ক্ষেপণাস্ত্র। এক প্রস্থ আঘাত করে ইঙ্গিত দিয়েছে ইরানও। আরব দুনিয়ার জমানা প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষে যেমনভাবে দাঁড়ানো উচিত ছিল তা দাঁড়ায়নি। কিন্তু প্যালেস্তাইনের মাটিতে প্রতিরোধ কত শক্তিশালী, তা টের পাচ্ছে ইজরায়েল। টের পাচ্ছেন তাদের মদত দেওয়া রাষ্ট্রনেতারাও।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি শুধু এইসব মৃত্যু আর তার মধ্যে থেকে বেড়ে ওঠা আশ্চর্য প্রতিরোধের কাহিনি শুনেই চলব? বরফশীতল আত্মঘাতী উদাসীনতার গহ্বরেই দিন কাটাবো আমরা? আমরা, যারা গাজা থেকে একটু দূরে এই ভারতে থাকি?
Comments :0