HINDUTVA RAMAYAN

অপ-হিন্দুত্ব : রামায়ণ, রামসেতু-রামমন্দির

উত্তর সম্পাদকীয়​

আদালত জুড়ে তখন একটা টানটান টেনশন, বাদী-বিবাদী কোনও পক্ষই বুঝতে পারছে না, রায় কোনদিকে যেতে পারে। সবার মুখই থমথমে গম্ভীর। কারণ এটা তো শুধুই একটা রায় নয় — ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি আর সেই সভ্যতার আদিপুরুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন। কি আশ্চর্য! সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় ডিভিসন বেঞ্চও তো রায়দানের শুরুতে সে কথাটাই বললেন: ‘‘শ্রীরাম স্রিফ এক ব্যক্তি নহি, ভারত কা সংস্কৃতি।“ ওদিকে আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-ভারতীয় জনতা পার্টিও তো কবে থেকে এই কথাটাই বলে এসেছে। রাম ভারতের আত্মা— তিনি ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’। সনাতন ধর্মে আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা যায় না, রামের ঐতিহাসিকতাও তেমনই সব বিতর্ক, সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। এই বিশ্বাস বুকে নিয়েই তো হাজার হাজার করসেবক, নাস্তিক-অবিশ্বাসী মার্কসবাদী আর ছদ্ম সেকুলারদের নাকের ডগা দিয়ে বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে, রাম-মাহাত্ম্য প্রমাণ করে ছেড়েছিল। আর আজ স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বললেন, রাম যে স্রেফ এক কল্পনা, এটা প্রমাণ করার দায় যাঁরা শ্রীরামকে মানেন না, তাঁদের — যাঁরা মানেন, কিছুতেই তাঁদের নয়। তাই প্রভু শ্রীরাম ছিলেন না, এর সপক্ষে সরকার যতদিন না কোনও প্রমাণ পেশ করতে পারবে ততদিন রামসেতুর গায়ে কেউ হাত ছোঁয়াতে পারবে না। ‘জয় শ্রীরাম!’
না, চক্ষু লজ্জার খাতিরেই ডিভিসন বেঞ্চ এমন কোনও স্লোগান তোলেনি! কোর্টের ভেতরে বা বাইরে রামভক্তরাও না। তবে হিন্দুত্ব-ব্রিগেডের এমন একটা জবরদস্ত নৈতিক ও আইনি জয়ের দিনে কোর্ট চত্বরে এরকম জয়ধ্বনি উঠলেও বলার কিছু ছিল না। পর্দায় হিন্দুত্ব রাজনীতি এতবড় সাফল্যের গল্প বলেও ২০২২ সালের ছবি ‘রামসেতু’ অবশ্য ডাহা ফ্লপ করেছিল। এমনটা হয় মাঝে মাঝে। বলিউডি অপ-হিন্দুত্বের সব তীরই যে ‘কাশ্মীর ফাইলস’বা ‘কেরালা স্টোরি’-র মতো বক্স অফিসের ‘ষাঁড়ের চোখে’ বিঁধবেই এমন কোনও কথা নেই। কখনো-সখনো তাক্ ফস্কাতেই পারে! কিন্তু এই ছবির নির্মাতা বা কুশীলবদের চেষ্টার কোনও কসুর ছিল না। থাকার কথাও নয়। কারণ এ ছবির মূল ভাবনা আর ‘‘সৃজনশীল পরিচালনা”র দায়িত্ব ছিল যাঁর, সেই ড. চন্দ্রপ্রকাশ দ্বিবেদী চিরকালই আরএসএস ঘনিষ্ঠ। আর ছবির নায়ক অক্ষয়কুমারই তো বলিউডের সেই বিরল ‘ভক্ত’ তারকা, স্বয়ং মোদীজী যাঁকে যেচে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন! সুতরাং বলিউডি রাম-প্রকল্পকে ওঁরা ইচ্ছে করে ঘেঁটে দেবেন, এমনটা হতেই পারে না। বরং ২০০৫-৬ সালের প্রথম ইউপিএ সরকাররের আমলের ‘সেতুসমুদ্রম’ জাহাজ পরিবহণ পথ নিয়ে বিতর্কের পটভূমিতে তাঁরা বেশ কায়দা করেই হিন্দুত্ব তথা রামভক্তির রাজনৈতিক চিত্রনাট্য তথা ছকটা সাজিয়েছিলেন। শুরুতেই ভক্তির বান না ডাকিয়ে যুক্তির একটা রাংতা জড়িয়েছিলেন। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রাখা হয়েছিল একজন ঘোর নাস্তিক, যুক্তিবাদী, প্রত্নতাত্ত্বিক ডক্টর আরিয়ানকে। ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণ ছাড়া যিনি কিছুই বিশ্বাস করেন না। তাই রামায়ণ-রামসেতু-শ্রীরামচন্দ্র সবটাই তাঁর কাছে গল্প বা পুরাণকথা! তিনি প্রাথমিকভাবে রিপোর্টও দিয়ে দিয়েছিলেন যে তামিলনাডুর দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের ‘পম্বন’ বা রামেশ্বরম দ্বীপ থেকে শ্রীলঙ্কার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে মান্নার দ্বীপ অবধি ভারত মহাসাগরের তলায় চুনাপাথরের লম্বা একটা সেতুর মত বস্তু দেখা যায়। সনাতন ধর্মবিশ্বাসী অনেকেই যেটাকে রামায়ণে বর্ণিত রামসেতু বলে বিশ্বাস করেন, সেটা পুরোপুরি বহু হাজার বছর আগেকার একটা প্রাকৃতিক ঘটনামাত্র।
ছবির শেষে সেই তিনিই আবার রীতিমতো তথ্য-যুক্তি জড়ো করে, শীর্ষ আদালতে রামসেতু বা অ্যাডামস ব্রিজের ‘রামায়ণত্ব’-র পক্ষে সওয়াল করেন। সমুদ্রের তলায় ডুবে থাকা রামসেতুর গা থেকে তিনি যে ভাসমান রামসিলার এক টুকরো ভেঙে বা কুড়িয়ে এনেছিলেন, তার কার্বন-ডেটিং জানিয়ে দিচ্ছে যে, এই রামশিলা মোটেই ১৮ হাজার বছরের পুরানো নয়। বড়জোর ৭ হাজার বছর আগেকার। ওদিকে পুষ্কর ভাটনগর সাহেব তো হিসেব কষে দেখিয়ে দিয়েছেন শ্রীরাম ও রামায়ণের বয়স ওই ৭ হাজার বছরই হবে। ফলে দুয়ে-দুয়ে চার — রামসেতু মোটেই কোনও প্রাকৃতিক নির্মাণ নয়! বরং রামায়ণে যেমনটি বলা আছে, তেমনই রাম ও তাঁর বানর সেনাদের হাতে তৈরি, সাগর পেরিয়ে রাবণ রাজার সোনার লঙ্কায় হানা দেওয়ার সেতু বা ফুটব্রিজ! সুতরাং এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়— রাম, রামায়ণ, রামসেনা, রামসেতু সব সত্যি! তাই যাঁরা শ্রীরামের ‘ঐতিহাসিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা আসলে বিজ্ঞান, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, সব কিছুকে অস্বীকার করছেন। তাই কোটি কোটি ভারতবাসীর ‘বিশ্বাস’নয় — এইসব তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদীদের ‘অবিশ্বাসই আসলে অবৈজ্ঞানিক, অন্ধ, ইতিহাস বিরোধী। ডক্টর আরিয়ানের এহেন সওয়াল শুনেই তো সিনেমার শীর্ষ আদালতের ‘ঐতিহাসিক রায়’— যেটা আমরা আলোচনার শুরুতেই বলছিলাম।
কিন্তু পুরাণ বিরোধী পুরাতাত্ত্বিক আরিয়ান একটি মাত্র বইয়ের দৌলতে রাতারাতি ‘ডিগবাজী খেলেন’, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের যে ডিভিসন বেঞ্চ রামসেতু বাঁচাও কমিটির দায়ের করা মামলা প্রায় খারিজ করে দিচ্ছিলেন, তাঁরাও ইউটার্ন করে শ্রীরামচন্দ্রের ঐতিহ্য-মহিমা রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুষ্কর ভাটনগরের সেই মহান বইটায় আসলে এমন কি গুপ্তকথা আছে? একটু খুলেই বলা যাক। ইন্ডিয়ান রেভেনিউ সার্ভিসের অফিসার পুষ্কর ২০০৪ সালেই ‘ডেটিং দ্য এরা অফ লর্ড রাম’নামে আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছিলেন। সে এক মারাত্মক ‘জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক’গবেষণা-কর্ম! প্ল্যানেটোরিয়াম গোল্ড নামে এক বিশেষ সফ্টওয়ার ব্যবহার করে, বাল্মীকির রামায়ণে রামের জন্ম সময়ে, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের যে অবস্থান বর্ণনা করা আছে, সেইসব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে এই পুষ্কর ভাটনগর জানিয়েছেন, শ্রীরামের জন্মদিন আসলে খ্রিষ্টপূর্ব ৫১১৪ সালের ১০ জানুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টায়! একইভাবে, রামচন্দ্র কবে গাছের আড়াল থেকে তীর মেরে, সুগ্রিবের দাদা বালিকে খুন করেছিলেন, কিংবা হনুমান কবে লঙ্কায় অশোকবনে সীতার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে রামের আংটি দিয়ে এসেছিলেন, সেসবের দিনক্ষণও তিনি বের করে ফেলেছিলেন। সে বইয়ে হয়তো রামচন্দ্র ও তাঁর বানর ব্রিগেড কবে নারকোল ফাটিয়ে, শিলান্যাস করে রামসেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন, তার সন-তারিখও দেওয়া ছিল। হয়তো বাহুল্য মনে করেই সিনেমার আরিয়ান ওরফে অক্ষয়কুমার সে সব আমাদের জানাননি। কারণ সুপ্রিম কোর্টে তাঁর কাজ তো হাসিল হয়েই গিয়েছিল।
তবে অমন বিলিতি জ্যোতিষী কায়দায় শ্রীরামের ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ আবিষ্কার বোধহয় হিন্দুত্ববাদীদেরও ততটা নজর টানেনি বা বিশ্বাস হয়নি! নইলে হিন্দু-হৃদয় সম্রাট নরেন্দ্র দামোদর মোদীজী প্রায় এক দশকের রাজ্যপাটেও একবারও কখনও ১০ জানুয়ারি তারিখটাকে রামচন্দ্রের জন্মদিবস হিসেবে ঘোষণা করার বা পালন করার দাবি তুললেন না, ব্যাপারটা একটু কেমন কেমন লাগে না? আসলে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, বিজেপি নেতাদের তত্ত্বাবধানে বা প্রত্যক্ষ ‘অনুপ্রেরণায়’বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পারদ এক-দেড় দশক ধরে ওই ধ্বংসস্তূপের তলাতেই যে রামের ‘জন্মস্থান’ছিল সেটা প্রমাণের জন্য নিত্যনতুন সব ‘প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার’সামনে আসতে থাকে। সবই নাকি ওই ‘বিতর্কিত সৌধের’তলা থেকে পাওয়া! হিন্দুত্ববাদের ছাতার তলায় সেইসব আধা সত্য আর পুরো মিথ্যে মার্কা ‘প্রত্নবস্তু’নিয়ে ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীও চলেছে! পুষ্কর ভাটনগরের এই বইটাও সম্ভবত ওই একই প্রকল্পের অংশ হিসেবে লেখা হয়েছিল। ‘জন্মভূমি’-র পাশাপাশি শ্রীরামচন্দ্রের যদি একটা বিজ্ঞানসম্মত ‘জন্মদিন’ও পাওয়া যায় ক্ষতি কী? অধিকন্তু নঃ দোষায়! রাম-আবেগকে যদি একটু প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের খাতে বইয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ওইসব বাম লিবারাল, ছদ্ম-সেক্যুলার ঐতিহাসিকদের পণ্ডিতি অহংকারে ভরা থোঁতা মুখ বেশ একটু ভোঁতা করা যায়।
কিন্তু তারপরেও ‘রামসেতু’বক্স অফিসে হোঁচট খেল কেন? কারণ রামভক্তরা এই মুহূর্তে অত ঘুরিয়ে নাক দেখানো পছন্দ করছেন না। ভেঙে ফেলা মসজিদের নিচেই মাতা কৌশল্যার আঁতুরঘর ছিল কিনা, ধ্বসংস্তূপে যে পুরানো হিন্দু মন্দিরের চিহ্ন মিলেছে সেটা রামের না শিবের, এমন কি শাবল-গাঁইতি মেরে মসজিদ ভেঙে ফেলাটা সনাতন ধর্মের বীরত্ব না স্রেফ গুন্ডামি, এসব তর্ক নিয়েও এখন আর কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। কারণ ২০১৯ সালে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিসন বেঞ্চের রায়, এই সমস্ত তর্ক-বিতর্কের ওপর মস্ত দাঁড়ি টেনে দিয়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, সংস্কার আর কয়েকশো বছরের মনোবাসনাকে এক তরফা জিতিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, মসজিদ ভাঙার কাজটা ঠিক হয়নি, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে — না হলেই ভালো হতো গোছের বিবেক বাঁচানো মন্তব্য করলেও, অপরাধীদের সাজা দেওয়ার ব্যাপারটায় শীর্ষ আদালত আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থেকেছে। স্বাভাবিকভাবেই আদালত কথিত ‘সংগঠিত অপরাধের’দ্বারা দখলীকৃত একটা জমির ওপরে রামমন্দির গড়ার অনুমতি যখন আদালতই দিয়ে দেয়, তখন ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’পন্থীরা আর রাম-রামায়ণে রামসেতু-রামজন্মভূমির ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব বিজ্ঞান নিয়ে খামোখা মাথা ঘামাতে যাবে কেন? প্রত্নতত্ত্ব যতই বলুক ৭০০০ বছর আগে ভারতবর্ষ সবে নব্য-প্রস্তরযুগ পেরবো পেরবো করছে, তাতে পুরাণ বা বিশ্বাসের কী এসে যায় ? সেখানে তো অযোধ্যার ‘রামরাজ্য’আর রাবণের ‘স্বর্ণলঙ্কা’তো পাকাপাকি আসন পেতে বসেই গেছে। তাই সিনেমার পর্দায় ‘রামসেতু’র সত্যতা প্রমাণের জন্য তাদের আর পুষ্কর ভাটনগরের গ্রহ-নক্ষত্রের জটিল হিসেব মেলানো বা অভিষেক শর্মা-চন্দ্রপ্রকাশ দ্বিবেদীদের গবেষণামূলক চিত্রনাট্যের প্রয়োজন নেই।
২০১৯-এ আদালতের রায়ে রামমন্দির নির্মাণ অনিবার্য হয়ে ওঠার ফলে রামভক্তরা ২০২২-এর ছবি ‘রামসেতু’কে ‘অপ্রাসঙ্গিক’বলে পাত্তা দেননি। আবার বাহুবলীখ্যাত প্রভাসকে রাম বানিয়ে ২০২৩-এর বলিউডি রামায়ণ ‘আদিপুরুষ’নিয়ে গোড়ায় সঙ্ঘ-পরিবারের ব্যাপক উৎসাহ ছিল। সেই হিন্দুত্ববাদী জোশে ‘আদিপুরুষ’র অগ্রিম বুকিং খুব তেজী ছিল! এমনকি মাল্টিপ্লেক্সে হনুমানের জন্যেও প্রতীকী সিট রাখা হয়েছিল! রামমন্দির নির্মাণ-আবেগে এই ছবির একটা জবরদস্ত ‘যোগদান’ থাকবে বলেই হিন্দুত্ব-ব্রিগেডের আশা ছিল। কিন্তু ছবি মুক্তির পরে দেখা গেল নির্মাতারা বাল্মীকির রামায়ণ বা রাম, কাউকেই বিশেষ সিরিয়াসলি নেননি। তাই মহাকাব্যের ‘মহান ঐতিহাসিক’চরিত্রদের কেমন যেন মার্ডেল-এর কমিক্স সিরিজের কার্টুন-কার্টুন দেখাচ্ছিল। রামায়ণ নিয়ে এতটা ছেলেখেলা স্বাভাবিকভাবেই ভক্তকুলের পোষায়নি। তাই সঙ্ঘ-জনতার ‘পারিবারিক’সংগঠিত রোষে ‘আদিপুরুষ’র বক্স অফিস ভবিষ্যৎ ভস্ম হয়ে যায়। আসলে এখন এটাই ঘটছে। রাম বা রামায়ণ নিয়ে প্রচলিত ধারণা বা বিশ্বাসের পান থেকে একফোঁটা চুন খসলেও সঙ্ঘ-পরিবারের নানান কিসিমের রামসেনা একেবারে রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বিনোদন বা জনপ্রিয় সংস্কৃতির এলাকায় এদের চৌকিদারি সাংঘাতিক কড়া আর নির্মম।
তাই শারদ পাওয়ার গোষ্ঠীর এনসিপি নেতা তথা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী জিতেন্দ্র আওহাদ যখন বলেন, বনবাসে গিয়ে শ্রীরাম দলিত-বহুজন সমাজের জীবনযাপন করতেন, শিকার করে পশু মাংসে পেট ভরাতেন, তখন বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে বড়জোর রাজনৈতিক আক্রমণ সানায়। কিন্তু নেটফ্লিক্স-এ তামিল ছবি ‘অন্নপুরাণি: দ্য গডেস অফ গড’-এ একটি চরিত্র যখন ছবির নায়িকা দক্ষিণী তারকা নয়নতারাকে হুবহু প্রায় একই সংলাপ বলে, তখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেট ফ্লিক্সের অফিসের সামনে ধর্নায় বসে যায়। বয়কটের ভয়ে কর্তৃপক্ষ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘অন্নপুরাণি’-কে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কারণ রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার মেগা ইভেন্টের আগে সঙ্ঘ পরিবার কোনও রকম ঝুঁকি নিতে নারাজ। জনপ্রিয় স্ট্রিমিং মাধ্যমের একটি ছবির এক চিলতে সংলাপেও যদি বনবাসী, ক্ষত্রিয় যোদ্ধা-শিকারী রামচন্দ্রের মাংসাশি-আমিষভোগী ছবিটা গণ-পরিসরে এসে গেলে পুরুষোত্তমের ভাবমূর্তি-মর্যাদায় নাকি কালি পড়বে! তার চেয়েও বড় কথা এনডিএ’র ভোটার লাখো লাখো নিরামিষাশী ভারতবাসীর ভাবাবেগে আঘাত লাগবে!
হ্যাঁ, আসলে ওটাই মাথাব্যথার প্রধান কারণ। সঙ্ঘ-পরিবার এমন একজন রামচন্দ্রকে চাইছে, যাঁর শুধু আরএসএস’র সদস্যপদটুকুই নেই। বাকি সবদিক থেকেই তিনি নাগপুর-সম্মতভাবেই ‘সর্বগুণসম্পন্ন’। তিনি নিরামিষাশী, প্রজাতান্ত্রিক। পাবলিক ডিমান্ডেই তিনি শুদ্র শম্বুককে হত্যা করতে পারেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নির্বাসন অবধি দিতে পারেন। এই ‘নির্মিত’শ্রীরামের সঙ্গে যদি সাম্প্রতিকতম কোনও ভারত শাসকের জনমোহিনী মূর্তির মিল খুঁজে পান, জানবেন, সেটা অনিচ্ছাকৃত নয়! বাল্মীকির রামায়ণ কোনও একজন মহাকবির কয়েক বছরের সৃজন নয়। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের মধ্যে বহু লিখক-কথকের কলমে-কথনে গড়ে ওঠা এক রামকথা। তাছাড়াও ভারত ও বহির্ভারতে আজও অন্তত ৩০০ রকমের রামকাহিনি আছে। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার এক রাষ্ট্র, এক ভোট, একই ধর্ম (হিন্দু), এক ভাষা (হিন্দি)-র মতোই একটাই রামায়ণ, একথাও কর্মেই বিশ্বাস করে। সেটা শুধু ভক্তি আর বিশ্বাস দিয়ে তৈরি। কোনও যুক্তি বিশ্বাস সেখানে নেই। ২২ জানুয়ারি সেই ভক্তির রাম মন্দিরের একজন নিতান্তই ভোট ও রাজনীতি আর রাষ্ট্রশক্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। জনগণ কেউ ব্যবস্থা করবেন না — সবাই নিন্দা জানান।

Comments :0

Login to leave a comment