গল্প | নতুনপাতা
আলপনা
সৌরীশ মিশ্র
সরস্বতী পুজোর সকাল।
সরযূনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পুজোর প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। শিক্ষিকারা থেকে ছাত্রীরা সবাই ব্যস্ত তাদের নিজের নিজের উপর ন্যস্ত কাজে।
ঠিক তখনই, স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রাকা সেনের কাছে খবর এল মহকুমাশাসক এসে উপস্থিত হয়েছেন হঠাৎই স্কুলে। খবরটা শুনেই রাকা দেবী তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চললেন স্কুলের মেন গেটের দিকে। কিন্তু অতটা যেতে হল না তাঁকে। কারণ, কয়েক পা এগোতেই তিনি দেখতে পেলেন এস ডি ও ম্যাডাম স্কুলে ইতিমধ্যেই প্রবেশ করেছেন। এবং, তারই দিকে হাসি মুখে এগিয়ে আসছেন প্যাসেজ দিয়ে। রাকা সেনের সাথে সামান্য হলেও পরিচয় আছে এস ডি ও-র। রাকা দেবী বছর ছয় হোলো এসেছেন এই স্কুলে হেড মিস্ট্রেস হয়ে। আর এই সময়ে বেশ কয়েকবার তাঁকে স্কুলের নানান কাজে দেখা করতে হয়েছে এই এস ডি ও ম্যাডামের সাথে। এবং, কোনোবারই তাঁর কাছে গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়নি রাকা দেবীকে। তাছাড়াও, প্রতিটি সাক্ষাৎেই এই মহকুমাশাসকের ব্যবহার মুগ্ধ করেছে ওনাকে।
"আসুন ম্যাডাম, আসুন।" এস ডি ও তাঁর কাছাকাছি আসতেই বলে উঠলেন রাকা সেন।
"আপনার স্কুলের সরস্বতী পুজো দেখতে এলাম।" একটু হেসে বললেন এস ডি ও।
"খুব ভাল করেছেন ম্যাডাম। আসুন এইদিকে।"
এস ডি ও-কে রাকা দেবী নিয়ে চললেন সেখানে, যেখানে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করা হয়েছে।
কথা বলতে বলতেই দু'জনই এসে দাঁড়ালেন দেবী সরস্বতীর মূর্তির সামনে।
"বড় সুন্দর হয়েছে তো প্রতিমাটি!" মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে অপলকে কয়েকক্ষণ মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থেকে রাকা সেনকে বললেন এস ডি ও।
"যেই দেখছে সেই বলছে ম্যাডাম এ কথা। আসুন ম্যাডাম এদিকে। একটু বসবেন।" ঐখানেই এক পাশে রাখা ছিল কয়েকটি চেয়ার সেদিকেই হাত দিয়ে ইশারা করে কথাটা বললেন রাকা সেন। তারপরই কি যেন ভেবে ফের তৎক্ষণাৎ বললেন, "না কি ম্যাডাম আমার চেম্বারেই বসবেন?"
"না, এখানেই বসি।"
এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন এস ডি ও। তারপর রাকা সেনকে বললেন, "আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন! আপনিও বসুন।"
"হ্যাঁ বসি।"
রাকা সেন বসলেন এস ডি ও-র পাশের চেয়ারটায়।
"ম্যাডাম, একটু চা বলি?"
"না, না। চা খাব না এখন। আর আমাকে নিয়ে এতো ব্যস্ত হওয়ারও কিছু নেই।" এটুকু বলে কয়েকক্ষণ চুপ করে থাকেন এস ডি ও। সামনেই বেশ কয়েকটি ছাত্রী পুজোর যোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত। কেউ ফল কাটছে, কেউ মালা গাঁথছে, আবার কেউ চন্দন বাটছে। ওদের দেখতে দেখতেই এস ডি ও ফের বললেন, "শুধু প্রতিমাই নয়, আর একটা জিনিস দেখেও আমার চোখ যেন জুড়িয়ে গেল এখানে।"
" কি ম্যাডাম?" জিজ্ঞেস করেন রাকা সেন।
"প্রতিমার ঠিক সামনে দেওয়া আলপনাটা। কি সুন্দর, কি নিখুঁত আঁকা!"
"হ্যাঁ ম্যাডাম। সত্যিই ভারি সুন্দর।"
"আপনার ছাত্রীরাই নিশ্চয়ই এঁকেছে?"
"না ম্যাডাম, ছাত্রীরা নয়, এই আলপনা একজন ছাত্রীরই পুরোটা আঁকা। ওই গত চার বছর ধরে প্রতিমার সামনের আলপনাটা এঁকে আসছে। ও এখন ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী। নাম রোকেয়া।"
"আপনার কথা শুনে তো অবাক হয়ে গেলাম। একটি মেয়েই এঁকেছে এতোটা জায়গা জুড়ে এতো সুন্দর, এতো নিখুঁত একটা আলপনা! সেই মেয়েটি কি এখন স্কুলে উপস্থিত? যদি স্কুলেই থাকে ও, একটু কি ডাকা যায় ওকে? বুঝতেই পারছেন, আই অ্যাম ইমপ্রেস্ড উইথ দ্যাট গার্ল। সি ইজ রিয়েলি ট্যালেন্টেড। "
"হ্যাঁ হ্যাঁ, ও এখন স্কুলেই আছে। একটু আগেও তো এখানেই ছিল। ফিনিসিং টাচ দিচ্ছিল আলপনাটায়।"
রাকা সেনের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন শিক্ষিকা। উনি তাঁকেই বললেন রোকেয়া নামের ছাত্রীটিকে ডেকে দিতে।
রোকেয়া এসে পড়ল কয়েক মিনিটের মধ্যেই। জড়সড় হয়ে দাঁড়াল হেড মিস্ট্রেস এবং এস ডি ও-র সামনে।
"ওনাকে চেনো? উনি এস ডি ও ম্যাডাম। তোমাকে কিছু বলবেন।"
এস ডি ও চেয়ার থেকে উঠে এসে রোকেয়ার সামনে দাঁড়ালেন এবার। তিনি রোকেয়ার কাঁধে হাত রেখে বললেন, "রোকেয়া, তোমার আঁকা আলপনা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। তোমার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালবাসা রইল। তুমি অনেক বড় হও।"
রোকেয়া কি বলবে এর উত্তরে। সে শুধুই চুপ করে থাকে। মুহূর্তে, দু'চোখে জল ভরে যায় তার। না, এ আনন্দাশ্রু নয় ওর। তার যে এখন বড্ড ওর মা'র কথা মনে পড়ছে। ওর মা-ই তো ওকে হাতে ধরে শিখিয়েছিল সুন্দর করে আলপনা দিতে হয় কি করে। কিন্তু, আজ যে এস ডি ও ম্যাডাম তার আলপনার এতো প্রশংসা করলেন, সে কথা যে চাইলেও বলতে পারবে না সে তার মা-কে। রোকেয়ার মা যে তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গিয়েছেন না-ফেরার দেশে ন'মাস হোলো।
Comments :0