Christmas Cake Bakeries

হারিয়ে যাচ্ছে কেকের গন্ধ, ধুঁকছে ছোট বেকারি

রাজ্য

Christmas Cake Bakeries


দীপাঞ্জনা দাশগুপ্ত


দুদিন আগে শেষ হওয়া ফুটবল বিশ্বকাপের রেশ এখনও কাটেনি। বছরের শেষ দিকে টান টান উত্তেজনার ম্যাচ, আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়। সেই সঙ্গে বড়দিন, বর্ষবরণ। আমজনতা এখন একটা উৎসবের মেজাজে। ঘর সাজানো, পিকনিক, ফিস্ট বা ছোট করে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পাশাপাশি কেক খাওয়াও এই মরসুমের একটা অঙ্গ। বিশেষ করে বড়দিন মানেই কেক। ছোট, বড়, মাঝারি কম দামি বেশি দামি, যে যার সাধ্য মতো কেক কেনেন। শহর থেকে শহরতলি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা বেকারীগুলির আয়ের একটা বড় সুযোগ বড়দিন। তবে অগ্নিমূল্যের বাজারে কেকের মতোই কি মিষ্টি এই বেকারিগুলির বাস্তব চিত্র?
একদিকে জিএসটির খাড়া অপরদিকে কাঁচামালের চড়া দাম। ফলে সঙ্কটের মুখে পড়েছে কলকাতার ছোট ছোট বেকারি। শীতের মরশুমে, বিশেষ করে বড়দিনের আগে, কেকের জন্য বাড়তি টান বাড়ে মানুষের। কলকাতা শহরের এই সাধারণ বেকারিগুলিতে সারা বছর পাউরুটি, বিস্কুট, প্যাটি, ক্রিম রোল বিক্রি হয়। তেমনিই শীতের সময় নভেম্বর থেকে এই বেকারিগুলিতে কেকের চাহিদা বাড়ে। অনেকেই কেক তৈরির উপকরণ দিয়ে যান। তেমনি কেক তৈরিও করে দেয় এই ছোট ছোট বেকারি। 

 

ফয়েলে দেওয়া হচ্ছে কেকের মিশ্রণ। দেওয়া হবে চুল্লিতে।


কিন্তু এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় কম লাভে কেক বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানালেন বেকারি মালিকরা। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের রিগাল বেকারির মালিক আজিজুল রহমান বললেন, ‘‘কেক তৈরির মূল উপকরণ ময়দা, চিনি, ডিম ও বাটার এই সব কিছুরই দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই মতো আমরা কেকের দাম বাড়াতে পারছি না। তার প্রধান কারণ বেশি দাম বাড়ালে মানুষ কিনতে চাইবেন না। আরেকটি কারণ হচ্ছে এখন বহু বেকারি তৈরি হয়ে গেছে, প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। শুধু স্থানীয় বেকারিই নয়, আমাদের বড় বড় নাম করা বেকারির সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিতে হচ্ছে। সুতরাং দাম বাড়িয়ে দিলে কম্পিটিশনের বাজারে টেকা যাবে না।’’
ছোট বেকারির আয়তন বিশাল নয়। তবে যে অঞ্চলে বেকারি রয়েছে সেখানে গেলেই কেক তৈরির একটা আলাদা সুগন্ধ পাওয়া যায়। কুড়ি ফুট বাই পঁচিশ ফুট বেকারিতে একদিকে একটি মেশিনে চলছে ডিম, মাখন ও চিনির মিশ্রণ। ওপর দিকে একটি বড় গামলায় ময়দার সঙ্গে  সেই মিশ্রণটি মেশানোর কাজ করেছেন দু’জন কর্মী। কোনও কোনও বেকারিতে ৪ জন কর্মী। ফ্রুট কেকে মেশানো হয় টুটি-ফুটি, চেরি, ভেনিলা এসেন্স। পাশেই একজন মোরব্বা ছোট টুকরো করছেন, মেশানো হবে কেকের মিশনে। 

 

এভাবেই কাজ করে চলেছেন শ্রমিকরা, কাজের অনিশ্চয়তা নিয়ে।


কেক তৈরির প্রধান ধাপ এটি। যত ভালো মিশ্রণ এবং বেকিং তত ভালো হয় কেক। তবে প্রত্যেকটি উপকরণ সমভাবে মেশাতে হয়। পাশেই তেল মাখিয়ে একজন তৈরি করছে ফয়েল। তাতে ঢালা হবে কেকের মিশ্রণ। হাতা দিয়ে একজন কর্মী ফয়েল কেক মিশ্রণ ঢালছেনও। সেটা ঢুকে যাবে কারখানার এক কোণে থাকা একটি বিশাল ওভেনে। নিচে কাঠ দিয়ে জ্বলছে চুল্লি। ওপরে একটি বিশাল চেম্বার। তাতেই ভাপে তৈরি হয় কেক। ছোট জানালা দিয়ে বড় লোহার একটি বেলচার মাধমে একে একে ফয়েলগুলিকে সেই চেম্বারে ঢুকিয়ে দিলেন আরেক কর্মী। এক সঙ্গে ২৫০টি ফয়েল রাখা যায় ওই চেম্বারে। এই ঘরেই কোণার দিকে দেওয়াল ঘেঁষে রয়েছে তক্তা দিয়ে বানানো খাট। তাতেই কোনও রকমে ঘুমান কর্মীরা। উৎসবের মরশুমে অন্তত পক্ষে এভাবেই কাজ চলে।
বড় বেকারির তুলনায় নেহাতই সাধারণ, সংখ্যায়ও অনেক কম উৎপাদন হয় এই ধরনের বেকারিতে। 
তবে পরিস্থিতির চাপে আগের তুলনায় কম কেক বানাতেও বাধ্য হচ্ছেন বেকারি মালিকরা। ফলে কর্মীসংখ্যাও কমে যাচ্ছে কারখানায়। এমপেরিয়াল বেকারির কর্তা শেখ গোলাম বলছেন, ‘‘৪৫ বছরের পুরনো এই বেকারি। বড়দিনের মরশুমে এক সময় ১২ ঘন্টার হিসেবে দিনে ১২ জন কর্মী কাজ করতেন। এখন তা কমে হয়েছে ৬ জন। বিশেষ করে লকডাউনে পরে বেকারির কর্মীসংখ্যা কমাতে বাধ্য হয়েছে আমার মতো অনেকেই।’’ 

 

তৈরি হচ্ছে ফ্রটু কেকের মিশ্রণ।


শেখ গোলাম জানাচ্ছেন, ‘‘একে তো লকডাউনে বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল কারখানা। তারপর যখন খুলেছে, তখন চাহিদা কমেছে অনেকটাই। গাড়ি বন্ধ থাকায় দূর দূরের জেলায় বিস্কুট, পাউরুটি, কেক পাঠানো সম্ভব হয়নি। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আগের মতো মানুষ কেনাকাটি করতে চান না। তার ওপরে কাঁচা মালের ওপর বসনাো জিএসটি’র জেরে বিস্কুটের প্যাকেট (ছোট,মাঝারি,বড় হিসেবে) আগে যা ছিল ১৭ টাকা বা ২২ টাকা সেগুলো  এখন বেড়ে প্যাকেট প্রতি ২৫ টাকা, ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্তও বিক্রি করতে হচ্ছে। চাহিদা কমছে।’’ তাঁর মতে, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ছোট ছোট বেকারি  হয়ত বন্ধই হয়ে যাবে। 
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেরই সিমলা বেকারি। সারা বছর সেখানে পাউরুটি, প্যাটি, ক্রিম রোল তৈরি হয়। সারা বছর টুকটাক কেক তৈরি হলেও বড়দিনের মরশুমে শুধুমাত্র কেক তৈরির ওপর জোর দেওয়া হয়। কমে যায় প্যাটি ও ক্রিম রোল তৈরির সংখ্যা। এই কারখানার ম্যানেজার সামসুল হক বলেন, ‘‘লকডাউনের পরে বাজার যেমন কমেছিল তেমনি পরবর্তী সময়ে একটু একটু করে উঠছিল। কিন্তু বিজেপি সরকারের চাপানো জিএসটি কেক বিস্কুটের ব্যবসার সাংঘাতিক ক্ষতি করে দিয়েছে। জিনিসের দাম বাড়ালে মানুষ কেনেন না। আবার কাঁচা মালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা ব্যবসা করতে পারছি না। কিন্তু খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে তো হবে। তাই মালিক আগের থেকে অনেক কর্মী কমিয়ে দিয়েছে কারখানায়। অনেক ভালো কারিগরের কাজ গেছে।’

মোরব্বার ছোট ছোট টুকরো করছেন কর্মী।


শহরের এই ছোট ছোট নানা বেকারির হাত ধরেই নিম্নবিত্তের ঘরে সারা বছর আসে বেকারি বিস্কুট, টোস্ট পাউরুটি। সেখানেই সঙ্কট। এমন ছোট ছোট বেকারিতেই কিন্তু বহু লোকের রোজগার, কাজ জড়িয়ে থাকে। চাহিদা কমায় কমছে কর্মী সংখ্যা। জিএসটি’র চাপ বড় সংস্থা হয়ত সয়ে নিতে পারবে, বা সমস্যা কম হবে। কিন্তু ছোট ছোট কারখানা, কাজের জায়গা বন্ধ হওয়ার মুখে। 
অর্থনীতির নিম্নমুখী চোরা স্রোত কেন, তার একটি নমুনা পেশ করছে ছোট ছোট বেকারি। 

 

(গনগনে চুল্লি থেকে বের হচ্ছে সদ্য তৈরি কেক। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে রবীন গোলদারের তোলা ছবি।)
 

Comments :0

Login to leave a comment