EKUSHE and Anti Imperialism

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনারও প্রকাশ

আন্তর্জাতিক

গৌতম রায়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর বিশ্বে সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ,মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে '৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম এবং সেই প্রবাহমান চেতনা একটা ব্যতিক্রমী নতুন মাত্রা মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাসে সংযোজিত করেছে। ধর্মাশ্রয়ী যে কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তি জাতীয়তার ধর্মীয় প্রকাশ ঘটিয়ে হিন্দু জাতীয়তা আর মুসলিম জাতীয়তার যে ভয়ঙ্কর খেলার ভিতর দিয়ে উভয় সম্প্রদায়েরই উচ্চ বর্ণের অভিজাতদের শ্রেণিস্বার্থ সুরক্ষিত করবার তাগিদে ভারত ভাগ করেছিল, সেই বিভক্ত দেশের দুই প্রান্তেই সাম্রাজ্যবাদ তাদের নখদন্ত বিস্তারের চেষ্টা '৪৭ থেকেই চালাতে সচেষ্ট ছিল। 

ভারতের সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এদেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নতুন আঙ্গিককে প্রয়োগ করতে সমর্থ হয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বরং স্বাধীন ভারতে প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পন্ডিত জওহরলাল নেহরু নেওয়ার ফলে খানিকটা প্রমাদ গোনে আমেরিকা। পন্ডিত নেহরুর কল্যাণকর অর্থনীতির পক্ষে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলার নীতি দক্ষিণ এশিয়াতে সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তিত চরিত্রের ব্যাটনধারী আমেরিকাকে দক্ষিণ এশিয়াতে দাদাগিরি করার মানসিকতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ফলে ধর্মীয় জাতীয়তার উপর তৈরি হওয়া নতুন দেশ পাকিস্তানকেই আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়াতে তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অতি বিশ্বস্ত দাবার বোড়ের চাল হিসেবে ধরে নেয়। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের ধর্মীয় জাতীয়তা আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক সম্পদের উপর লোলুপ দৃষ্টিই তাদের সম্পর্কে আশান্বিত করে তোলে মার্কিন প্রভুদের।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেখানকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রথম থেকেই কুক্ষিগত করেছিল পশ্চিম অংশের রাজনৈতিক নেতারা। রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলিম জাতীয়তাকে সামনে রেখে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ঘটিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক শোষণ করে সমৃদ্ধি সাধন ছিল এই নেতাদের মূল লক্ষ্য। জিন্না, লিয়াকত আলির লোকদেখানো গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে বিপন্ন করে, কৃষিক্ষেত্র থেকে (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ভৌগলিক কারণেই কৃষিজ উৎপাদন প্রায় হতই না) টাকা লুঠ করে ঐশ্বর্য নগরী হিসেবে নতুন রাজধানী রাওয়ালপিন্ডির নির্মাণ।

ধর্মীয় জাতীয়তাকে সম্বল করে পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও ভারতে ধর্মীয় জাতীয়তার প্রসারে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি অত্যন্ত তৎপর থাকা সত্ত্বেও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে নতুনভাবে বিকাশমান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ খুবই হতাশ হয়। কংগ্রেসের ভিতরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডনের মতো নেতারা নেহরু সরকারের উপর খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে না পারা, জাতীয় সরকারে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই যে সরকার হয়েছিল এবং '৫২ র প্রথম সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সেই সরকারে চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থাকা সত্ত্বেও নেহরুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সেই সরকারকে কোনোরকম সাম্প্রদায়িক খাতে পরিচালিত করা যায়নি। দক্ষিণ এশিয়াতে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধিতে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের উপরেই বেশি ভরসা করতে শুরু করে আমেরিকা। তাছাড়াও ভারতের সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমেরিকাকে আতঙ্কিত করে। সেখান থেকেও পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করবার কাজ আমেরিকা জোর কদমে চালায়।

পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনেরা বাঙালির উপর নামিয়ে আনে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সেই আগ্রাসনেরই একটা কৌশল ছিল উর্দুকে গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা। পাকিস্তানের সংবিধান সভাতে জিন্না যে বক্তৃতা করেছিলেন, সেটা ছিল আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে নিজের ভাবমূর্তি তৈরির জন্যে জিন্নার একটি নিষ্ফল প্রচেষ্টা। নিজে সাম্প্রদায়িক তো দূরের কথা, ধর্মপ্রাণ না হয়েও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করে জিন্না ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সহায়তায় হিন্দু-মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির অভিন্ন শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার তাগিদ থেকে, যার পরিণতি ছিল পাকিস্তান হাসিল। তাই পাকিস্তান কায়েমের পর যে স্বল্প সময় জিন্না জীবিত ছিলেন, সেই সময়কালে পূর্ব পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা ' উর্দু' কে করবার পক্ষে তাঁর ওকালতির ও অর্থ ছিল দক্ষিণ এশিয়াতে ভাষা-ধর্ম-জাতিসত্তা কেন্দ্রিক সংঘাত জিইয়ে রেখে অস্থিতিশীলতাকে চিরস্থায়ী করা।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাংলাদেশের মানুষের যে লড়াইকে তাই নিছক মায়ের মুখের ভাষার আবেগ হিসেবে ধরলে চলবে না, গোটা ঘটনাক্রমের পিছনে বাংলাদেশের মানুষের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদী মানসিকতার জীবন্ত প্রকাশকেই আমাদের সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে তখন পশ্চিম পাকিস্থানের ক্ষমতাসীনদের খুশি করবার মানসিকতা সম্পন্ন অনেক নেতাই বেশ ক্ষমতাবান।বাঙালির ভাষার প্রশ্নে ভাষাবিজ্ঞান, ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বোধ-- এসব কোনো কিছুকেই গুরুত্ব দিতে তাঁরা নারাজ। প্যান ইসলামিক চেতনার সঙ্গে ভাষার প্রশ্ন টিকে জুড়ে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্থান এবং আড়ালে মার্কিন প্রভুদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের আড়ালে, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিমের একটি উপনিবেশে পরিণত করতে তারা উন্মুখ। ভারতেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে ‘হিন্দুর ভাষা’ আর ‘মুসলমানের ভাষার’ বিতর্ক তুলতে তখন শুরু করে দিয়েছে জোরদার ভাবে। এপার বাংলায় তখন ভাষার শুদ্ধতার নামে বাংলা ভাষা থেকে আরবি, ফার্সী শব্দ বর্জনে চলছে মহা তোড়জোর।

হায়দরাবাদের ভারত ভুক্তির কালে তৎকালীন নবাব ওসমান আলির প্রধানমন্ত্রী লায়েক আলির নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল ' রাজাকার' বাহিনী। কাসেম রিজভি ছিল এই রাজাকার বাহিনীর প্রধান। পরবর্তীকালে '৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের কালে বাংলাদেশে যে রাজাকার বাহিনী গড়ে উঠেছিল পাকিস্থানের সাহায্যার্থে, সেই রাজাকার মানসিকতার উন্মেষ বাংলাদেশে ঘটেছিল '৪৭ উত্তর সময়েই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাঙালিদেরই একাংশের ভিতরে উর্দুর পক্ষে ওকালতির ভিতর দিয়ে।

একেবারে ব্রিটিশের ভেদনীতির কায়দাতে বাঙালির মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন এবং বাঙালি-অবাঙালির সংঘাতকে বল্গাহীন করে পূর্ব পাকিস্তানের উপর লাগামহীন অর্থনৈতিক শোষণের উদ্দেশ্য নিয়েই অবিভক্ত পাকিস্তানের জনসংখ্যার নিরিখে বাংলা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পশ্চিমের শাসকদের 'উর্দু' কে ঘিরে ছিল ভয়ঙ্কর গাজোয়ারি।

মহান ভাষা দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে '৫২ র মহান ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার এই রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট টি স্মরণে রাখা আমাদের বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। আজ যখন ভারতে ধর্মান্ধ হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির একদম ফ্যাসিস্ট মানসিকতায় এক দেশ, এক ভাষা- এই মানসিকতা নিয়ে চলছে , তখন এটাও আমাদের মনে রাখা দরকার, নিছক বাংলা ভাষার রাষ্ট্রিক মর্যাদার প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষ '৫২ তে মহান ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করেননি। আমার মাতৃভাষার স্বীকৃতির অর্থ কখনো অপরের মাতৃভাষাকে অপমান, অমর্যাদা নয়- এই মানসিকতাকে বীজমন্ত্র করে সংগঠিত হয়েছিল মহান একুশ। গোটা বিশ্বের কাছে একুশের চেতনা মানে তাই আমার মাতৃভাষার স্বীকৃতির ভিতর দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতিই সম্মান, মর্যাদা প্রদর্শন।

অলঙ্করণ: মনীষ দেব

Comments :0

Login to leave a comment