সমাজতন্ত্র নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথও

বিশেষ বিভাগ

১৯১৭ সালে রুশ দেশে লেনিনের নেতৃত্বে নভেম্বর বিপ্লবের বার্তা এদেশে তথা বঙ্গদেশের মানুষকে সাম্যবাদ-চর্চার দিকে আকৃষ্ট করেছিল। যদিও বিপ্লবের লক্ষ্য, আদর্শ, মার্কসবাদ—  এসব নিয়ে তখনও অনেকের মধ্যেই স্পষ্ট ধারণা সঙ্গত কারণেই ছিল না। তবুও সমকালীন যুগের বাঙালি, বিশেষত সাহিত্যিকদের দৃষ্টিতে, চর্চায়, মূল্যায়নে এই বিপ্লব ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং তরুণ বিপ্লবীদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। একটি বিদ্রোহ, একটি বিপ্লব সফল হয়েছে, একটি দেশকে স্বৈরাশাসন থেকে মুক্ত করা গেছে—  তা সে যতদূরেই হোক না কেন, এটিই ছিল প্রকৃত আনন্দের কারণ। 

প্রকৃত অর্থে এই বিপ্লবী তরুণরা লেনিনের মধ্যে সেদিন দেখেছিলেন প্রবল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা আর রুশ বিপ্লবের মধ্যে দেখেছিলেন স্বৈরাচার ও শোষণ মুক্তির অবসান ও সশস্ত্র বিপ্লবের পথ। পরে বিপ্লবের প্রকৃত উদ্দেশ্য, তার চরিত্র, তার গণরূপ যখন বিপ্লবীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন অনেকেই বিপ্লবের বিলাসিতা ও গুপ্ত সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে কমিউনিজমের পথে চলে আসেন। তারই প্রতিফলন দেখা যায় সমকালীন সংবাদ সাময়িক পত্রপত্রিকায়। রুশ বিপ্লব, বলশেভিকবাদ ইত্যাদি আলোচনার পাশাপাশি শুরু হয় মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিন চর্চা।
সে সময় ‘আত্মশক্তি’, ‘বিজলী’, ‘সৎসঙ্গী’, ‘শঙ্খ’ , ‘দেশের বাণী’ ‘ধূমকেতু’, ‘প্রবাসী’, ‘সবুজপত্র’, প্রভৃতি পত্রিকায় যে চর্চা শুরু হয়েছিল অনেকটাই মনের আবেগে স্বতঃস্ফূর্ততার বশে, সে কাজ সংগঠিত ভাবে শুরু হয়েছিল ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’ পত্রিকার মধ্যে দিয়ে।

বাঙালির সমাজতান্ত্রিক চেতনা
রুশ বিপ্লবের পর এদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের চর্চা শুরু হলেও মার্কস সম্পর্কে যে কোনও আগ্রহ তার পূর্বে ছিল না তা নয়। ১৫ আগস্ট ১৮৭১-এ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কাছে কলকাতা থেকে প্রেরিত একটি চিঠিতে এদেশে আন্তর্জাতিকের একটি শাখা খোলার আবেদন জানানো হয়েছিল। কে এই পত্র লেখক? তিনি ভারতীয় না কোন বিদেশী—  আজও নির্ধারিত হয়নি।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই প্রথম তাঁর লেখায় ‘সোস্যালিস্ট’ ‘কমিউনিস্ট’ ‘কমিউনিজম’ এমনকি ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ কথাগুলি ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর ‘সাম্য’ প্রবন্ধটি পড়লেই বোঝা যায় তিনি ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের খোঁজ খবর রাখতেন। কিন্তু কোথাও মার্কস এঙ্গেলসের নাম করেননি। তরুণ রবীন্দ্রনাথও সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ইত্যাদি নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছিলেন। ১৮৯১ সালে ‘ক্যাথলিক সোস্যালিজম ’ ও  ‘সোস্যালিজম’ নামে দুটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন। তিনিও মার্কস-এঙ্গেলসের কথা কিছু বলতে পারেননি। ১৮৯৬ সালে বিবেকানন্দ অনুমান করেছিলেন যে তিনি রাশিয়া অথবা চীনের কোথাও শূদ্রের (প্রোলেটারিয়েট) রাজ কায়েম হবে। ‘আই অ্যাম এ সোস্যালিস্ট’ প্রবন্ধে নিজেকে তিনি একজন সমাজতন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করে ছিলেন। কিন্তু কমিউনিজম বা কার্ল মার্কসের নাম উল্লেখ করেননি। কারণ অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না। সে সময় ইউটোপিয়ান সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাই ছিল প্রবল। প্রুঁধো, বাকুনিন প্রমুখের প্রভাবই ছিল সমধিক। বুর্জোয়া পত্রপত্রিকায় এঁরাই প্রচার পেতেন। এইসব সূত্র থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকান্দ বা রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষীরা সমাজতন্ত্রের ইউরটোপীয় ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বলে অনেকের ধারণা। সিস্টার নিবেদিতাও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রমে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ছিলেন। তিনি ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অনেক খোঁজ খবর রাখতেন। ১৯০৫ সালে রুশ বিপ্লবের পর নৈরাজ্যবাদী ক্রোপটকিনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হয়। ক্রোপটকিন রুশ বিপ্লব সম্পর্কে অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও একবারের জন্যও বলশেভিক পার্টি বা লেনিনের নাম উচ্চারণ করেননি। 

ফেবিয়ান সোসাইটির প্রভাব
এদেশে ‘ফেবিয়ান সোসাইটি’রও কিছু প্রভাব ছিল। সমাজতন্ত্রের প্রচারে ১৮৯০ সালের অক্টোবরে এই সোসাইটির পক্ষ থেকে পর পর চারটি আলোচনা সভা অনুষ্টিত হয়েছিল। বক্তব্য রেখেছিলেন ডব্লু এ চেম্বার্স এবং ডি গোস্টলিং। আলোচ্য বিষয় — ‘সমাজতন্ত্রের ইতিহাস’, সমাজতন্ত্রের মতবাদ’, সমাজতন্ত্রের নৈতিক দিক’ এবং ভারতীয় সমাজে সমাজতন্ত্র’। ভারতবর্ষের এটাই সমাজতন্ত্রের গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে প্রথম প্রকাশ্য আলোচনা সভা। 
১৯৭১ সালের নভেম্বরে রুশ বিপ্লবের বিজয় অর্জিত হলে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের একাংশ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। বাংলার বুদ্ধিজীবী তরুণ বিপ্লবীদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। অনেকে লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেন। অবশেষে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে দেশের বাইরে রুশ বিপ্লবের তিন বছরের মধ্যে ১৯২০ সালে। তারপর দেশের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা ও মার্কসীয় ভাবধারা প্রচারের কাজে এগিয়ে আসেন গুটিকয় যুবক, তাঁদের অন্যতম ছিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। 
 

Comments :0

Login to leave a comment