সাত্যকি রায়
গত প্রায় ১৫ দিন ধরে দেশের বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তির ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে ঐশ্বর্যের বিকট প্রদর্শনী দেশের মানুষকে নিশ্চিতভাবে বিস্মিত করেছে। সমাজ বদলেছে সময় বদলেছে পারিবারিক সম্পদ প্রদর্শনের, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও বোধহয় বদলেছে। সম্পদের উৎকট প্রদর্শনীতে দেশ বিদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে বলিউড টলিউড দক্ষিণী তারকাদের থেকে ছোট, বড়, মেজ নানা ধরনের কীর্তিমান পুরুষ, নারীদের সম্মেলন ও অংশগ্রহণ পুরানো জমিদারি ব্যবস্থার স্মৃতিকে উসকে দেয়। বেসরকারি হিসাব মতো প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে গেল দেশের বিশিষ্ট ক্ষমতাশালী, কৃতী ও ধনী ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে। ইনস্টাগ্রামে ছবির পর ছবি আছড়ে পড়ল, ভারতবর্ষের আমজনতা অবাক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করল তাদেরই দেশের এক সহনাগরিকের বিপুল ঐশর্যের প্রদর্শনী। অনেকে হয়ত একে আবার জাতীয় গর্ব হিসাবেও মনে করছেন! দেশ কত এগিয়েছে এ যেন তারই স্বরূপ। গত তিন দশকে নয়া উদারবাদী পরিমণ্ডল আমাদেরকেও যথেষ্ট ভোগবাদী করে তুলেছে। উৎসবের ও সম্পদের বিকট প্রদর্শনী আমাদের আর চোখে লাগে না, বিলাসিতার আড়ম্বরে আজ আর কোনও আড়ালের দরকার নেই। কাজ নয়, আমার ব্যয় করার ক্ষমতা ও সম্পত্তিই আমার পরম সত্তা হিসাবে মনে করতে আমরাও বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, ফলে যার যতটা আর্থিক ক্ষমতা সে ততটা ক্ষমতা দেখাবে এতে অবাক হওয়ার কি আছে?
সর্বোচ্চ বৈষম্য
যে দেশে কোনও একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে আনুমানিক পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচা হচ্ছে, সেই দেশটি সঙ্গত কারণেই এখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ আয় ও সম্পদ বৈষম্যের দেশ হিসাবে চিহ্নিত। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব-এর তথ্য অনুযায়ী ভারতে বর্তমান আর্থিক বৈষম্যের পরিমাণ স্বাধীনতা পূর্ব ১৯২২ সালের পরবর্তী সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। দেশের এক শতাংশ ধনীরা স্বাধীনতার সময় জাতীয় আয়ের ১৩ শতাংশের অধিকারী ছিল যা এখন (২০২২-২৩ সালে) বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২২.৬ শতাংশ। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ ধনী দশ হাজার মানুষের আয়, ভারতীয়দের গড় আয়ের ২০৬৯ গুণ। ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় ১৯৯১ সালে ভারতের একজনের নাম ছিল, যা তিন দশকের উদারীকরণের পর ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ১৬২ জন। ১৯৯১ সালেও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ধনীরা জাতীয় আয়ের এক শতাংশের অধিকারী ছিল যা ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের ১৬২ জন ধনীর মোট আয়, আমাদের দেশের জাতীয় আয়ের সিকি ভাগ। ধনীদের এই আয়ের অংশ বৃদ্ধি পেয়েছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের আযয়ের অংশ কমার মধ্যে দিয়ে। দেশের ১০ শতাংশ বড়লোকের আয় স্বাধীনতার সময় জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশ ছিল, ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ৬০ শতাংশ। অন্যদিকে দেশের নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষের জাতীয় আয়ের অংশীদারত্ব ৯০-এর দশকে ছিল ২২.৪ শতাংশ, যা ২০২০ তে কমে হয়েছে ১৫ শতাংশ। আয় বিস্তৃতির মাঝের ৪০ শতাংশ মানুষ যাদেরকে মধ্যবিত্ত বলা যেতে পারে, তাদের জাতীয় আয়ে অংশীদারিত্ব ১৯৫১ সালের ৪৩ শতাংশ থেকে কমে ২০২২ সালে ২৭.৩ শতাংশ হয়েছে। মধ্যবিত্তের একটি উপরের অংশ তাদের মোবিলিটির কারণে উদারীকরণের প্রথম দিকে যথেষ্ট সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও এই সুযোগ ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। গত তিন দশকে এর ফলস্বরূপ সমাজে আর্থিক মেরুকরণ বাড়তে থাকে এবং মধ্যবিত্তের জাতীয় আয়ে অংশীদারিত্ব কমা শুরু হয়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো আয় বৈষম্যের তুলনায় ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সম্পত্তির বৈষম্য আরও তীব্র হতে শুরু করে। জাতীয় স্তরেও এই ছবি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। আমাদের দেশে সম্পত্তি ও আয়ের অনুপাত ১৯৯৫ সালের ৩.৮৩ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ৫.৭৫ তে পৌঁছেছে। এর অর্থ হলো ধনীরা শুধুমাত্র নিচের তলার মানুষের থেকে দ্রুত গতিতে আয় করছে তা নয়, এই অর্জিত আয়কে তার চাইতেও দ্রুত হারে স্থায়ী সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হচ্ছে। সাধারণভাবে সম্পত্তির বৈষম্য আয়ের বৈষম্যের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে, কিন্তু এই পার্থক্য ভারতের ক্ষেত্রে এই সময়কালে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে রাখতে হবে যে ভারতের ১ শতাংশ ধনী পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি জাতীয় আয়ের অংশ দখল করে রেখেছে। বর্তমানে পৃথিবীতে তা সর্বোচ্চ, যা তুলনামূলকভাবে অধিক আর্থিক বৈষম্যের দেশগুলি যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। আমরা যদি দেশের একেবারে উপরের দিকের ০.০৪ শতাংশ ধনীদের কথা বলি অর্থাৎ যাদের নেট সম্পত্তির পরিমাণ ১০ কোটি থেকে ১০০ কোটির মধ্যে তাদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ দেশের জাতীয় আয়ের চেয়ে বেশি বা ১২৫ শতাংশ। অথচ দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের অধীনে মোট সম্পত্তির মাত্র ৬.৪ শতাংশ রয়েছে। দেশের সবচেয়ে ধনী দশ হাজার মানুষের অধীনে মোট সম্পত্তির পরিমাণ দেশের নিচের দিকের ৫০ ভাগ মানুষের অধীনে থাকা সম্পত্তির প্রায় তিন গুণের কাছাকাছি। এই বিপুল পরিমাণ আয় ও সম্পত্তির কেন্দ্রীভবনের অন্যতম কারণ হলো বিভিন্ন ধরনের ক্যাপিটাল অ্যাসেট থেকে আয়, যা বিপুলভাবে ফাটকা কারবার নির্ভর।
সম্পত্তি ও ইনহেরিটেন্স ট্যাক্স
টমাস পিকেটি সহ ওয়ার্ল্ড ইনিকুয়ালিটি ল্যাব-এর অন্যান্যদের গবেষণা ভারতের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যর উপর বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা আরও দেখিয়েছেন যে শুধুমাত্র একেবারে উপরের দিকের মানুষের আয় ও সম্পত্তির উপরে সামান্য অতিরিক্ত কর আরোপ করেই দেশের ফিস্ক্যাল ডেফিসিটের অর্ধেক পূরণ করা সম্ভব এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব। এই প্রস্তাব অনুযায়ী যাদের সম্পত্তির পরিমাণ দশ কোটি টাকার বেশি সেই সম্পত্তির উপরে ২ শতাংশ কর ও যাদের সম্পত্তির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি তাঁদের সম্পত্তির উপরে ৪ শতাংশ কর বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের মতো দেশে বৈষম্য ক্রমবর্ধমান হওয়ার একটা বড় কারণ হলো অর্জিত সম্পত্তি পরবর্তী প্রজন্মে প্রায় বিনা করেই হস্তান্তরিত হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইনহেরিটেন্স ট্যাক্সের হার ৪০ শতাংশ, জাপানে ৫৫ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ, অথচ ভারতে কোনও ইনহেরিটেন্স ট্যাক্স নেই। এই কর শুধুমাত্র একবারই দিতে হয, সম্পত্তি পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরের সময়। যারা ১০ কোটির বেশি এবং ১০০ কোটির কম সম্পত্তি পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করতে চান তাঁদের উপর ৩৩ শতাংশ কর ও যারা ১০০ কোটিরও বেশি সম্পত্তি হস্তান্তর করতে চান তার উপরে ৪৫ শতাংশ কর চাপালে সম্পত্তি কর ও ইনহেরিটেন্স ট্যাক্স মিলিয়ে সরকারের মোট যা আয় হবে তা জিডিপি’র ৪.৫৯ শতাংশ। খেয়াল রাখা দরকার যে ২০২৩-২৪ সালে আমাদের দেশের ফিস্ক্যাল ডেফিসিটের পরিমাণ ছিল জিডিপি’র ৫.৮ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের আর্থিক ঘাটতির একটা বড় অংশ এই আয়ের মধ্য দিয়েই তুলে নেওয়া সম্ভব। এবং এই কর আদায়ের জন্য দেশের মাত্র ০.০৪ শতাংশ অতি ধনী লোকের ওপরই সামান্য বোঝা বাড়বে এবং দেশের ৯৯.৯৬ শতাংশ মানুষই এই করের আওতার বাইরে থাকবে। বর্তমানে আমাদের দেশের সরকার শিক্ষা খাতে ব্যয় করে জিডিপি’র ২.৯ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দর পরিমাণ জিডিপি’র ১.৪ শতাংশ অর্থাৎ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপি’র ৪.৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের ধনীদের উপর সামান্য করের বোঝা চাপলে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ করা সম্ভব। অথচ সরকার সে পথে না হেঁটে আর্থিক ঘাটতির কথা বলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ক্রমাগত বেসরকারিকরণ করে চলেছে।
প্রতিরোধের রাজনীতি
প্রশ্ন হলো এই বিকট বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাধারভাবে মানুষের কোনও যথাযথ ক্ষোভ বা ক্রোধ প্রতিভাত হচ্ছে না কেন? আসলে আর্থিক বা সম্পত্তির বৈষম্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বোঝাপড়ায় খুব একটা দাগ কাটে না। সাধারণভাবে মানুষ নিজের অবস্থাকে দু’ভাবে বিবেচনা করে থাকে। একটি সময়ের নিরিখে অর্থাৎ গত পাঁচ-দশ বছরের তুলনায় এখন আমি ভালো আছি না খারাপ আছি। আর দ্বিতীয়টি হলো, সমগোত্রীয়দের তুলনায় আপেক্ষিক অবস্থা। অর্থাৎ যাদের সাথে আমার চলাফেরা, ওঠা বসা তাদের নিরিখে আমার নিজের অর্থনৈতিক অবস্থান বদলাচ্ছে কিনা, সেটাই ব্যক্তি মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে। আমি যেখানে কাজ করি, যাদের সাথে কাজ করি তারা কোনও কারণে আমার চেয়ে বেশি আয় করছে কি করছে না, বা নতুন কোনো বাড়ি, গাড়ি, জমি কিনছে কী কিনছে না, সেটাই বিবেচনার বিষয় হয়ে ওঠে। টাটা বিড়লা, আম্বানি, আদানি কত আয় করছে বা কত সম্পত্তি বানালো অথবা এই ধরনের ধনীদের সাথে গরিব মানুষের আয় ও সম্পত্তির পার্থক্য কতটা বাড়ল— সেটা সাধারণ মানুষের কাছে একটি তথ্য মাত্র। আসলে সাধারণভাবে বৈষম্যকে দেখতে পেলেও বৈষম্যের কারণকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। যারা বড়লোক তাদের ভবিতব্যই বড়লোক হওয়া, অথবা ব্যক্তিগত যোগ্যতা, শিক্ষা দীক্ষা, পারিবারিক ঐতিহ্য অথবা কৃতকর্মের ফল ইত্যাদি ইত্যাদি নানা ব্যাখ্যা আমাদের মনের মধ্যে কাজ করতে থাকে।
শ্রেণি বৈষম্য একমাত্র শ্রেণি শোষণের মাধ্যমেই যে বেড়ে ওঠে, এই সহজ সত্য আমরা জানলেও অনুধাবন করতে পারি না। শ্রেণি ব্যবস্থা বা শ্রেণি শোষণ কোনও প্রাকৃতিক নিয়ম নয়, তা একান্তই সমাজ সৃষ্ট। তাই বৈষম্যের বিরুদ্ধের লড়াই শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই হিসাবে দেখতে পারলে তবেই ঐশ্বর্যের আস্ফালন ক্রোধ তৈরি করে, নচেৎ নয়। প্রশ্নটা নৈতিকতা বা ঔচিত্যবোধের নয়, প্রশ্নটা ব্যক্তিগতও নয়। আসলে এক শ্রেণির দ্বারা অপর শ্রেণির সৃষ্ট সম্পদ লুট করার পুঁজিবাদের নিত্য নৈমিত্তিক প্রক্রিয়াটিকে স্বাভাবিকত্বের মোহর লাগানোর যে অর্থনৈতিক সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত কার্যকরী হয়ে চলেছে, তাকে অমানবিক হিসাবে চিহ্নিত করাটাই জরুরি কাজ। এবং সেই অমানবিকতার বিরুদ্ধে লড়াই সবচাইতে বেশি কার্যকরী হয় তখনই যখন মানুষ নিজের জীবনে শোষণকে দেখতে পায়, যখন সে নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে সহকর্মী বা সমগোত্রীয়দের সঙ্গে নিয়ে শোষক এবং ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। সেই লড়াই শ্রেণির নির্মাণ করে— লুটের বিরুদ্ধে, শোষকের বিরুদ্ধে, ক্ষমতাবানদের অন্যায় সুবিধার বিরুদ্ধে এবং শ্রেণি সংগ্রাম মূর্ত রূপ ধারণ করে। বৈষম্যের বিরুদ্ধের লড়াই একমাত্র তখনই বিমূর্ত নৈতিকতার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবের মাটিতে জীবনের রাজনীতিতে পরিণত হয়।
Post Editorial
প্রতিরোধের রাজনীতি
×
Comments :0