CO-OPERATIVE BANK

সমবায় ব্যাঙ্কে ১৭৭ ভুয়ো অ্যাকাউন্ট অনুব্রতের পাচারের টাকা লেনদেন

রাজ্য জেলা

anubrata mondal cbi

কোনটি সনাতন বাস্কের নামে তো কোনটি কৃষ্ণা মুর্মুর নামে। আবার কোনটি রয়েছে স্বাধীন ছাপড়ার নামে, তো কোনটি ধনেশ্বর দলুইয়ের নামে। মোট ১৭৭টি এরকমই ভুয়ো অ্যাকাউন্টের হদিশ মিলেছে, যাদের নামে অ্যাকাউন্ট, তাঁরা কেউই জানেনই না যে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে বছরের পর বছর ধরে হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন। অ্যাকাউন্ট পিছু যার পরিমাণ ৫লক্ষ থেকে ৭০লক্ষ টাকা পর্যন্ত! গোরু পাচারে ‘প্রোটেকশন’ মানি বাবদ অনুব্রত মণ্ডলের কোটি কোটি টাকা স্রেফ কালো থেকে সাদা হয়েছে এই অ্যাকাউন্টগুলির মাধ্যমেই। তাও হয়েছে একটি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। সিউড়িতে থাকা সেই ব্যাঙ্কের নাম বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। সেই ব্যাঙ্কেই বৃহস্পতিবার সিবিআই’র আচমকা হানায় সামনে এসেছে অনুব্রতের কালো টাকার অনায়াস যাতায়াতের এমনই সংগঠিত পথকে। 


স্থানীয়ভাবে পরিচালিত এই ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে শাসকদলের হাতেই। ব্যাঙ্কের যে সময়ের লেনেদেন রয়েছে, সিবিআই’র র্যাকডারে এসেছে সেই সময় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান ছিলেন নুরুল ইসলাম। যিনি এখনও তৃণমূলের জেলা নেতা, সিউড়ি ২নং ব্লকের সভাপতি এবং অনুব্রত মণ্ডলের একান্ত ঘনিষ্ঠ। সেই ব্যাঙ্কেই এদিন হানা দিয়েছিল গোরু পাচার মামলার তদন্তকারী সিবিআই আধিকারিকরা। মোট ১৭৭টি এমনই ভুয়ো অ্যাকাউন্টের হদিশ মিলেছে একটি ব্যাঙ্কের একটি শাখা থেকেই। সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে ব্যাঙ্কে হানা দিয়ে এই সমস্ত অ্যাকাউন্টগুলির নথি সংগ্রহ করেছে সিবিআই।  


বুধবার কলকাতা হাইকোর্টে অনুব্রত মণ্ডলের জামিন খারিজ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার তাঁকে তোলা হয়েছিল আসানসোল আদালতে। ফের তাঁকে জেল হেপাজতে পাঠিয়েছেন বিচারক। তারপর আচমকাই তিন সদস্যদের তদন্তকারী দল হাজির হয়ে যান সিউড়ির কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে। ছিলেন অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে গোরু পাচার মামলার মূল তদন্তকারী অফিসার সুশান্ত ভট্টাচার্য। ব্যাঙ্কে প্রবেশ করেই তাঁরা ঢুকে যান ম্যানেজারে ঘরে। 

ব্যাঙ্কের একটি সূ্ত্র জানিয়েছে, প্রথমেই সিবিআই আধিকারিকরা এই অ্যাকাউন্টগুলি নিয়ে বিস্তারিত জানতে চান। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ইতস্তত করলে রীতিমতো তাঁকে সতর্ক করেন সিবিআই’র তদন্তকারী আধিকারিক। আধিকারিক ম্যানেজারকে বলেন, ‘সহযোগিতা না করলে সমস্ত লেনদেন বন্ধ করে দেব। আপনাকে অ্যারেস্ট পর্যন্ত করতে পারি।’ শুধু তাই নয়, সিবিআই আধিকারিক রীতিমতো জেরার সুরে ম্যানেজারকে বলেন, ‘কার নির্দেশে এমনটা হয়েছে ?’ 


এই ব্যাঙ্কটি প্রথম থেকেই নিশানায় ছিল সিবিআই’র। ব্যাঙ্কের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘‘অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর ব্যবসায়িক দোসর আহমেদপুরের তৃণমূল নেতা রাজীব ভট্টাচার্যের চালকলের ব্যবসার বড়সড় লেনদেন ছিল এই ব্যাঙ্কে। ফলে গোরু পাচার মামলার তদন্তের গোড়াতেই এই ব্যাঙ্কটি চলে আসে সিবিআই নিশানায়। তখনও অনুব্রত গ্রেপ্তার হননি। ব্যাঙ্ক থেকে বেশ কিছু অ্যাকাউন্টের নথি সিবিআই সংগ্রহ করেছিল তখনই। এমনকি ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছিল অনুব্রতর অ্যাকাউন্ট।’’ ঘটনাক্রমে স্পষ্ট হয়েছে, সেই জাল গোটানোর কাজই প্রায় সম্পন্ন করেছে সিবিআই। এদিন নির্দিষ্ট ১৭৭টি ভুয়ো, বেনামি অ্যাকাউন্টের হদিশ তারই প্রমাণ। সিবিআই’র একটি সূত্র স্পষ্ট দাবি করেছে, ‘অ্যাকাউন্টগুলির সাথে অনুব্রতর লিংক মিলেছে বলেই তো এই তল্লাশি।’ 


আগেই প্রকাশ্যে এসেছে চালকল, জমি-জায়গা, মেডিক্যাল কলেজ, হোটেল রিসর্টে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে গোরু পাচারে বিপুল টাকা অনুব্রত মণ্ডল ‘পার্কিং’ করেছিল। তবে একটি ব্যাঙ্কের একটি শাখাতেই এতগুলো ভুয়ো অ্যাকাউন্টকে ব্যবহার করে কালো টাকা সাদা করার এমন ফন্দি নিশ্চিতভাবেই চমকে দিয়েছে সকলকে। 

ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নিয়ে ওয়াকিবহাল এক বরিষ্ঠ আইনজীবী জানিয়েছেন, ‘‘কর্তৃপক্ষের মদত না থাকলে এটা  সম্ভব নয়। এভাবে অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তাতে টাকা ঢুকিয়ে নানাপথ দিয়ে সেই টাকা আবার নিজের কাছে নিয়ে আসার শৃঙ্খলকেই উন্মোচন করেছে সিবিআই।’’ ওয়াকিবহাল মহলের সকলেরই মত, ওই সমবায় ব্যাঙ্ক তো অনুব্রতের ঘরের ব্যাঙ্ক। গোটা ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ তো তার হাতেই। কারণ পরিচালন সমিতি তো তারই গড়া। ক্ষতির মুখে পড়ে সেই ব্যাঙ্ক দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। বছর দুয়েক হলো তাকে ‘পুনরুজ্জীবিত’ করে ফের খোলা  হয়েছে। তাহলে কি গোরু পাচারের কালো টাকাতেই ব্যাঙ্ক পেয়েছে ‘পুনরুজ্জীবন’? 


এদিন সিবিআই তল্লাশি শেষে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অভিজিৎ সামন্ত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘‘সিবিআই আধিকারিকরা এসেছিলেন। তাঁদের কিছু প্রশ্ন রয়েছে। আমরা যথাসম্ভব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে এর সঙ্গে সাধারণ গ্রাহকদের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।’’


তৃণমূলের জেলা নেতা তথা ব্যাঙ্কের তৎকালীন চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ব্যাঙ্কের লেনদেনের ক্ষেত্রে বোর্ডের কোনও ভূমিকা নেই। যদি ব্যাঙ্কের লেনদেন সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ আমাদের কাছে আসত নিশ্চয় আমরা দেখতাম। ব্যাঙ্কের লেনদেনের ব্যাপার ব্যাঙ্কের আধিকারিকরা বলতে পারবেন। আমার এই বিষয়ে কিছু জানা নেই।’’

Comments :0

Login to leave a comment