অনিল কুণ্ডু- গঙ্গাসাগর
মকর সংক্রান্তির স্নান সারলেন লক্ষাধিক তীর্থযাত্রী। নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় এবারো নির্বিঘ্নেই কেটেছে দিনভর স্নান পর্ব। গঙ্গাসাগর মেলা প্রাঙ্গণে শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা খোলা আকাশের নীচে সারা রাত সময়ের প্রহর গুণেছেন যাত্রীরা। মঙ্গলবার ভোর হতেই পুণ্যস্নান সারতে বঙ্গোপসাগরের জলে ঝাঁপ দিলেন তাঁরা। সাগর স্নানকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরে জমজমাট ছিল গোটা মেলা প্রাঙ্গণ। সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে যেমন যাত্রীরা ভিড় জমিয়েছেন তেমনি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসেছেন গঙ্গাসাগর মেলায়। স্নান সেরে, কপিল মুনির মন্দির আশ্রম পরিদর্শন, মেলা প্রাঙ্গন ঘুরে যাত্রীরা ঘরমুখী হয়েছেন। এদিন দুপুরের পর থেকেই মানুষের ভিড়ে জমজমাট সেই মেলা প্রাঙ্গণ ক্রমশই ফিকে হয়েছে।
মেলা প্রাঙ্গনে সব ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়েছেন। এটাই গঙ্গাসাগর মেলার ঐতিহ্য। যুগ যুগ ধরে পরম্পরা। এটাই সম্প্রীতির ভারতবর্ষ, পশ্চিমবঙ্গ। মুর্শিদাবাদের আনারুল ইসলাম, স্ত্রী ফতেমা বিবি, নদিয়ার মিলন ব্যানার্জি, স্ত্রী অপর্ণা ব্যানার্জিকে সঙ্গে নিয়ে পাশাপাশি সাগরের জলে ডুব দিলেন। এই ঘাটেই স্নান সেরে ভিজে পোষাকে হাতে মালা জপতে জপতে ফিরেছেন মায়াপুরের বাসিন্দা সুস্মিতা ভট্টাচার্য। মেলা প্রাঙ্গনের ১ নম্বর রাস্তার শেষে সাগর সৈকতে তখন কয়েক হাজার মানুষ জোয়ারের জলে স্নান সেরে উঠে দাঁড়িয়ে। রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ। উধাও ঠান্ডার বাতাস। জলে নামার আনাগোনা চলছে। সাগরের জলে নৌকা, স্পীড বোটে তীক্ষ্ণ নজরদারি করছেন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, উপকূল রক্ষী বাহিনীর কর্মীরা।
মকর সংক্রান্তির দিন গঙ্গাসাগর মেলা জমজমাট হলেও প্রয়াগে মহাকুম্ভমেলা হওয়ায় এবারের মেলায় যাত্রীদের ভীড়ে ভাটা পড়েছে। এমনই অভিমত প্রকাশ করলেন দোকানদার ব্যবসায়ীরা। তাঁদের বিক্রিবাটাও এবারে বেশ অনেকটাই কমে গিয়েছে। সাগরের মায়াগোয়ালিনির বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব গোপাল পন্ডা গত ২০ বছর ধরে মেলা প্রাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করেন। তাঁর কথায়, আমরা সারা বছর এই মেলার দিকে তাকিয়ে থাকি। বাড়িতে পাঁচ জনের সংসার। মেলা থেকে কিছুটা রোজগার তো হয়ই। কিন্তু এবারে বাজার তেমন ভালো হয়নি। মরসুমে সমুদ্রে মাছ ধরা ছাড়াও জনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। রেগার কাজ বন্ধ। কাজের জন্য সাগরদ্বীপের বাসিন্দাদের অনেককেই এখন ভিন রাজ্যে যেতে হচ্ছে।
প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এবারও মেলা প্রাঙ্গনের যাত্রী আবাসে টাকার বিনিময়ে থাকতে হয়েছে যাত্রীদের। যাদবপুরের ৯৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে পরিবার নিয়ে আসা কমল সরকার এদিন অভিযোগ করে বলেন, মাথা পিছু পাঁচশো টাকা করে দিতে হয়েছে। কারো কাছ থেকে সাতশো টাকা করেও নিয়েছে। অনেকেই টাকার কথা শুনে যাত্রী আবাসে না থেকে খোলা আকাশের নীচেই রাত কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, স্ত্রীর সিওপিডি থাকায় বাধ্য হয়েছেন তাঁরা ৫ জন ২৫০০ টাকা দিয়ে থাকতে। তাঁর আক্ষেপ টাকাটা কারো পকেটেই গেলো। পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারি করা উচিত যাত্রীদের স্বার্থে যাত্রী আবাসে। একই অভিযোগ করলেন মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা সুরিন্দর জৈন। তাঁর কথায়, মাথা পিছু সাতশো করে নিয়েছে। কোন বিল দেয়নি। মনে হল ওরা রুলিং পার্টির লোক আছে।
সন্ধ্যার পর মেলা প্রাঙ্গনে দিনের সেই কোলাহল শেষে নিস্তব্ধতা ফিরেছে। সূচনা কেন্দ্র থেকে মাইক্রোফোনের বারবার ঘোষণাও আর শোনা যায়নি। হালকা বাতাস থাকলেও শীতের ঠান্ডা উধাও হয়েছে। সাগর সুন্দরবন সেবা সমিতির স্বেচ্ছাসেবকরা মেলা প্রাঙ্গনে এখনো নিরলস কাজ করে চলেছেন। এবারে ১৪২টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রায় দশ হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক যাত্রীদের পরিষেবায় কাজ করছেন।
এদিকে মেলা অফিসে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস দাবি করে বলেছেন, এদিনই বেলা ৩ টে পর্যন্ত ৩০ লক্ষ মানুষ মেলায় এসেছেন। এবারের সাগর মেলায় মোট ৮৫ লক্ষ তীর্থযাত্রী এসেছেন। মঙ্গলবার উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা রামপ্রসাদ নন্দ (৫৪) নামে যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এনিয়ে সাগর মেলায় আসা মোট ৫ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। মেলায় এদি পর্যন্ত মোট ২৭২টি কেপমারির ঘটনা ঘটেছে। ৬৭২ জনকে বিভিন্ন অপরাধে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
Gangasagar Mela 2025
গঙ্গাসাগর মেলায় পাঁচজনের মৃত্যু, বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার ৬৭২
×
Comments :0