World Environment Day

বিশ্ব পরিবেশ দিবস আমাদের ভূমি আমাদের ভবিষ্যৎ

উত্তর সম্পাদকীয়​

তপন মিশ্র
 

এবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আহ্বান হলো বন্ধ্যা জমির পুনরুদ্ধার (ল্যান্ড restoration), মরুকরণ (desertification) রোধ এবং এবং ক্রমবর্ধমান খরার সহনশীলতা বৃদ্ধি (droughtresilience)’। এই আহ্বানের উপর ভিত্তি করে যে স্লোগান জাতিসঙ্ঘ এবারের জন্য ঠিক করে দিয়েছে তা হলো ‘আমাদের ভূমি আমাদের ভবিষ্যৎ’। বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে কর্পোরেটদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু হলো বিভিন্ন ধরনের ভূমি যেমন অরণ্য, জলাভূমি সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর দখলদারি। এই জল-জঙ্গল-জমি রক্ষার লড়াই যারা জনসমক্ষে আনার চেষ্টা করেন তাঁরা হলেন পরিবেশ সাংবাদিক। ভারতের পশ্চিম অংশে মরুভূমি থাকলে মরুকরণের প্রক্রিয়া ছড়িয়েছে অনেক রাজ্যে। দেশের ৩২% জমি এখন ভুমিক্ষয়ের শিকার এবং ২৫% জমি মরুকরণের দিকে এগচ্ছে। টেকসই নয় এমন কৃষি ব্যবস্থা,খনিজ সম্পদ তুলে নেওয়ার পর জমিকে বন্ধ্যারত্বর দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘটনায় সরকার নির্বিকার। ঝাড়খণ্ড, রাজস্থানের আরও কিছু অংশ, গুজরাট, গোয়া এবং দিল্লি আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে অনুর্বর হয়ে যাবে। তার পর রয়েছে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের নাম। একথা মনে করলে ভুল হয়ে যাবে যে এই ক্ষয় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। যারা বিভিন্নধরনের ভুমিসম্পদের অপব্যবহার করে মুনাফা লুটছেন তাদের আড়াল করতেই এই ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। একারণে জল, জঙ্গল, জমির লড়াই ইদানীংকালে সব থেকে বেশি আক্রান্ত।

আক্রান্ত পরিবেশ রক্ষার লড়াই 
আমাদের দেশে তো বটেই, সারা পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ রক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করেন, এই সংগ্রামের খবর যারা সংগ্রহ করেন  এবং আমাদেরপরিবেশন করেন তাদের উপর আক্রমণের তীব্রতা দিনে দিনে বৃদ্ধিপাছে। ইউনেস্কো (UnitedNationsEducational,ScientificandCulturalOrganization) অতি সম্প্রতি এক সমীক্ষার মাধ্যমে কয়েকটি খবর সামনে এনেছে। কিন্তু ইউনেস্কো যা বিশ্লেষণ করেনি তা হলো কেন এই আক্রমণের ঘটনা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার লড়াইয়ের এক গুরুত্বপুর্ণ দিক হলো ভূমির অধিকার এবং স্বাস্থ্য রক্ষার লড়াই। ইউনেস্কো এই আন্দোলনের উপর আক্রমণের কিছু খবর আমাদের সামনে হাজির করেছে।  
পরিবেশ সাংবাদিক হত্যর ঘটনার একটি হিসাব পাওয়া যায় ইউনেস্কোর দেওয়া এই তথ্য থেকে। এছাড়াও গুরুতরভাবে আহত বা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা খুব কম ঘটেনি। পরিবেশগত সমস্যা জনসমক্ষে আনার অপরাধে মূলত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে গত এক দশকে মোট ২০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দশজনকে হত্যা করা হয়েছে গত পাঁচ বছরে। এদের মধ্যে ৯ জনের হত্যা হয় অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়। ইউনেস্কোর দেওয়া পাঁচটি দেশের হিসাব হলো নিম্নরূপ।  কলম্বিয়া (২জন), মেক্সিকো (১ জন), ফিলিপাইন (১ জন), মায়ানমার (১ জন) এবং ভারত (৪ জন )। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের সৈনিকের কোনও দেশ নেই, কোনও ধর্ম নেই বা কোনও লিঙ্গ নেই।
কয়েকটি হত্যার কথা 
ভারতের  মধ্যে অধিকাংশটাই ঘটেছে উত্তর প্রদেশে। প্রথম জন হলেন উত্তর প্রদেশের হিন্দি-ভাষায় প্রকাশিত ‘কাম্পু মেল’ নামে এক সান্ধ্য দৈনিকের প্রতিবেদক শুভম মণি ত্রিপাঠি। তাঁকে ২০২০ সালের জুন মাসে ছটি  গুলি করা হয়েছিল— যার মধ্যে তিনটি করা হয় তাঁর মাথায়। তাঁর অপরাধ হলো তিনি মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে একটি ফেসবুক পোস্টে বলেছিলেন যে তিনি ‘বালি মাফিয়াদের’ দ্বারা হত্যার আশঙ্কা করছেন।  অবৈধ বালি উত্তোলনের সাথে জড়িত জমি দখলকে ঢেকে রাখার জন্য। এই ঘটনার ১ বছর আগে শুভম এবং তার ভাইয়ের একটি মোবাইল সারানোর দোকানের উপর আক্রমণ করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক মদতপুষ্ট বালি ও জমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সে কলম ধরতে ছাড়েনি।
তার কিছুদিন আগে অর্থাৎ ২০১৫ সালে জগেন্দ্র সিং নামে কে হত্যা করা হয়। তিনি তৎকালীন এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর উদ্যোগে জমি দখল করে বেআইনি খনি থেকে খনিজ উৎপাদনের কাজ করছিলেন। যোগেন্দ্রর হত্যাকে আত্মহত্যা হিসাবে চালিয়ে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য হত্যা প্রমাণিত হওয়ায় তিনজন গ্রেপ্তার হন। 
বোর্নেওর ইন্দোনেসিয়া অংশের একজন সাংবাদিক মহম্মদ ইউসুফ Kemajuan Rakyat এবং Berantas Newsনামে দুটি বহুল প্রচারিত অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিল। লাগাতার ভাবে একটি পাম চাষ কোম্পানির বিরুদ্ধে সে লিখতে থাকে। এই কোম্পানিটি অরণ্য ধ্বংস করে সেই জমিতে বেআইনিভাবে পাম চাষ করত। সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে কোম্পানিটি বনবাসীদের বঞ্চিত করে বনভূমি দখলের কাজ করত। পাম তেল কোম্পানির সন্মানহানি করা হচ্ছে এই  মিথ্যা অপবাদে ইউসুফকে ২০১৮ সালে আটক করে জেলে রাখা হয়। ওখানেই তার মাথার পেছনে আঘাত করে মেরে ফেলা হয়।    
পরিবেশ সাংবাদিকদের উপর আরও কয়েকটি প্রাণঘাতী আক্রমণের কথা ও তুলে ধরা যেতে পারে। জোসেফ অদুহা নামে একজন সাংবাদিক দক্ষিণ সুদানে একটি আন্তর্জাতিক তেল উৎপাদনকারী সংস্থা পেট্রোনাস-এর সীমাহীন জমি ও জল দূষণের ঘটনা লাগাতরা ভাবে Nation Media Groupনামে একটি পত্রিকায় লিখতেন। তিনি ওই পত্রিকার একজন স্থায়ী সাংবাদিকও ছিলেন। জোসেফকে সে দেশের ‘জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। পরে অবশ্য তাঁকে গা ঢাকা দিয়ে দেশ ছাড়তে হয়। একইভাবে আলবার্টো কাস্টানো ওবন মারিয়া লউরদেস জিমরমান হত্যার হুমকির কারণে দেশ ছাড়েন। এঁদের লড়াই ছিল ভূমির বেসরকারি করণের বিরুদ্ধে লড়াই।Reporters Without Borders (RSF) জানাচ্ছে যে একই খবর লাগাতার ভাবে করার জন্য ২০১৮ সালে মারিয়া এফিজেনা এবং আবেলারর্ডো লিজ নামে ২ জনকে হত্যা করা হয়। আরএসফ’র কথায় পৃথিবী জুড়ে জলের পরই বালি সহ অন্যান্য খনিজ পদার্থের উপর কর্পরেটদের সর্বাধিক লোলুপ দৃষ্টি।   
কারা এই আক্রমণের কান্ডারি?
বামপন্থিরা কর্পরেটদের দোষারোপ করলে পারটিজান মনে হতে পারে কিন্তু অন্যরা কি বলছেন দেখা যাক। চেন্নাইয়ের একজন ফ্রিলান্স সাংবাদিক সন্ধ্যা রবিশঙ্কর। পরিবেশ সাংবাদিকতার জন্য ২০১৯ সালে রামনাথ গোয়েঙ্কা এক্সেলেন্স পুরস্কার পান তিনি। তাঁর মূল কাজ ভারতের খনি এলাকায় কর্পোরেটদের উদ্যোগে সমস্ত খনিজ সম্পদ নিংড়ে নেওয়ার পর সেই জমির বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পুনরুদ্ধার না করে বন্ধ্যাাত্বের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘটনাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসা। তিনি বলছেন “ যখন সাংবাদিকরা এই ধরণের ঘটনা সামনে আনেন এবং এই প্রাকৃতিক সম্পদ যথেচ্ছ লুঠের বিরুদ্ধে সরকারের উপর চাপ দেন তখন শক্তিশালী কর্পোরেটদের স্বার্থে আঘাত লাগে। একারণেই সাংবাদিকদের উপর আঘাত আসে”। এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশেগুলিতে এই ধরণের ঘটনার তীব্রতা অনেক বেশি। 
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে, ২০১৪ সালে, ঘোষণা করেন “স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের পরিবেশ ব্যতিরেকে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না”। আরএসএফ তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে “Hostile climate for environmental journalists”বলছে যে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী আমাদের দেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২ তম স্থানে। আমদের দেশে মাটির নিচের কয়লা, লোহাপাথর, বনজ সম্পদ ইত্যাদির উপর ইদানীংকালে ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট পুঁজির লোলুপ চক্ষু যেমন প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণের কারণ তেমনই দূষণের বড় উৎস। দেশের সর্বত্র বহুজাতিকদের এই আদিম শোষণের জন্য দাপাদাপি অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ কে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য সমস্ত পরিবেশ আইন সরলীকরণের পথে দ্রুত লয়ে চলছে। 
মার্কসের কলমে ভূমিক্ষয় রোধের কথা 
মার্কসের মতে (ThePovertyofPhilosophy, ১৮৪৭ সালে ফ্রান্সে ১৮৪৩ থেকে ১৮৪৯ পর্জন্ত নির্বাসিত থাকাকালীন মার্কসের লেখা) প্রকৃত শ্রম প্রকৃতির কদর (appropriation) করে এবং পাশাপাশি মানুষের চাহিদা পূরণ করতে চেষ্টা করে। এর মধ্যদিয়ে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যেকার বিপাক ক্রিয়া (metabolism) ভারসাম্য বজায় থাকে। অন্যদিকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রকৃতি এবং সহজ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের দখলদারিত্ব (expropriation) নেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। ভূমির অবৈধ দখলের সময় যে ক্ষতিহয় তা পূরণ করার কোনও দায়বদ্ধতা বুর্জোয়াদের থাকে না। মার্কসের কথায় ধনতন্ত্রের উদ্দেশ্য হলো “law of ‘expropriation’ not ‘appropriation'” অর্থাৎ ভূমির কদর করা নয় বরং দখল করা। মার্কস উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত জার্মান রসায়নবিদ লেবিগ (Justus von Liebig-এর “law of replenishment” অর্থাৎ মৃত্তিকার ক্ষয় পূরণ করার তত্ত্বের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। লেবিগ ইউরোপে সেই সময়ে কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষিভূমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস বিষয়টি লক্ষ্য করেন। তখনও কৃষি ভূমির এই ক্ষতি পূরণের জন্য সারের আবিষ্কার হয়নি। প্রশান্ত মহাসাগরের ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে জমে থাকা সমুদ্রের পাখিদের মল (গুয়ানো) নিয়ে এসে কৃষি জমির উর্বরশীলতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো হয়। এই মলকে ‘whitegold’ বলা হতো। কালক্রমে আমরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই সমস্ত দ্বীপের দখল নিয়ে গুয়ানোর একচ্ছত্র বাণিজ্যের ব্যবস্থা করে। এই ব্যবস্থা ‘গুয়ানো সাম্রাজ্যবাদ’ নামে খ্যাত। সেই সময়ে লেবিগের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার সাথে রাসায়নিক সারের আবিষ্কার, ইউরোপের কৃষি ব্যবস্থায় এক ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।
‘আমাদের ভূমি আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্লোগান আসলে আমাদের জল, জঙ্গল, জমি রক্ষার আন্দোলনের আর এক নাম। বামপন্থীরা চিরদিনই এই আন্দোলনের শরিক। কেবল এ বছরের ৫ জুন নয় প্রতিদিন আমাদের লড়াইয়ের স্লোগান হোক জল, জঙ্গল, জমির লড়াই। 
Highlight

‘আমাদের ভূমি আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্লোগান আসলে আমাদের জল, জঙ্গল, জমি রক্ষার আন্দোলনের আর এক নাম। বামপন্থীরা চিরদিনই এই আন্দোলনের শরিক। কেবল এ বছরের ৫ জুন নয় প্রতিদিন আমাদের লড়াইয়ের স্লোগান হোক জল, জঙ্গল, জমির লড়াই। …আর একারণেই জল, জঙ্গল, জমির লড়াই সব থেকে বেশি আক্রান্ত।


 

Comments :0

Login to leave a comment