Debu Das Usha Das

কাকদ্বীপ হত্যাকাণ্ডের পুলিশি তদন্ত খারিজ হাইকোর্টে

রাজ্য

পাঁচ বছর ধরে তদন্তের নামে শাসক দলের দুষ্কৃতীবাহিনীকে আড়ালের চেষ্টা চলেছে। এরাজ্যের বুকে গত দশ বছরে অন্যতম নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের তদন্তকে পরিকল্পিতভাবে পুলিশই বিপথে চালিত করেছে। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের সময় কাকদ্বীপের বুধাখালিতে সিপিআই(এম) সমর্থক দম্পতি দেবপ্রসাদ দাস ও ঊষারানি দাসকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনায় পুলিশি তদন্ত সম্পূর্ণ ভাবে বাতিল করে দিলো কলকাতা হাইকোর্ট।
সোমবার এই মামলায় বিচারপতি রাজশেখর মানথা পাঁচ বছর ধরে চলা পুলিশের এই তদন্তকে বাতিল করে দিয়ে আইপিএস অফিসার দময়ন্তী সেনকে কাকদ্বীপ হত্যাকাণ্ডের পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। দময়ন্তী সেনের নেতৃত্বে বিশেদ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করে এই তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ওই আইপিএস আধিকারিক নিজে পছন্দের অফিসারদের নিয়ে এই সিট গঠন করে স্বাধীনভাবে তদন্ত করবেন এবং আদালতে চার্জশিট জমা দেবেন। সম্পূর্ণ নতুনভাবে স্বাধীন তদন্তের নির্দেশই দিলো আদালত।


এরাজ্যের বুকে সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকান্ডকে ‘বৈধতা’ দিয়েছিল খাস নবান্ন। প্রশাসনের সদর দপ্তরে দাঁড়িয়ে কাকদ্বীপে সিপিআই(এম) সমর্থক দম্পতিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনাকে ‘বিদ্যুতে তার ছেঁড়ার ঘটনা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা। মুখ্যন্ত্রীর সুরেও ছিল তারই প্রতিধ্বনি।
২০১৮ সালের ১৩ মে। পঞ্চায়েত ভোটের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগের রাতের সেই বর্বরতা। কাকদ্বীপের বুধাখালি গ্রামে সিপিআই(এম)-র সক্রিয় কর্মী দেবপ্রসাদ দাস ও ঊষারানি দাসকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কাকদ্বীপ থানার বুধাখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছাড়িবাড়ি গ্রাম। গ্রাম ছাড়িয়ে একেবারে শেষপ্রান্তে নির্জন জায়গায় বাড়ি ছিল  দীপঙ্করের। দেবপ্রসাদ দাস ও ঊষারানি দাস একমাত্র সন্তান দীপঙ্কর দাস। বাড়ির পিছনেই মুড়িগঙ্গা নদী। বাবা দেবপ্রসাদ দাস কখনও দিনমজুরি, কখনও মীন ধরে ভাতের দাম যোগাড় করতেন। শত দারিদ্র্যের মধ্যেই কেউ কাড়তে পারেনি লালঝান্ডাকে, শেষ দিন পর্যন্ত বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন।
বাবা-মায়ের পুড়ে যাওয়া দেহ দেখেছে। গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল পাঁচ বছর আগেই। সময়ের যাত্রাপথে শহীদ সন্তান দীপঙ্কর দাস এখন আইনে স্নাতক। কালো কোর্ট পড়েই এদিন এই শুনানিতেও ছিল দীপঙ্কর দাস। বিচারপতির কাছে সেই তথ্যও জানান আইনজীবী সব্যসাচী চ্যাটার্জি। 
সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী এদিন বলেন, শহীদ বাবা-মায়ের সুবিচার ও হত্যাকারীদের শাস্তির মামলায় নিজেই সামলা গায়ে আদালতে সওয়াল করার যোগ্যতা লাভ করেছে দীপঙ্কর এই বছরই, তার সিনিয়র আইনজীবীদের হাত ধরে। তৃণমূল সরকারের নির্দেশে সর্বোচ্চ পুলিশ আধিকারিকদের ষড়যন্ত্রে, প্রকৃত হত্যাকারীদের বাঁচাতে মিথ্যা মামলা সাজিয়েছিল স্থানীয় পুলিশ। সাজানো তদন্তে মিথ্যা চার্জশিটও দাখিল করেছিল পুলিশ। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে অনেক বড় জয় পাওয়া গেল ঠিকই, কিন্তু লড়াই শেষ হলো না। চলবে নজরদারি, নতুন তদন্তের গতিপ্রকৃতির ওপর। হত্যাকারীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবেই।


গত পাঁচ বছর ধরে পুলিশি তদন্ত একচুলও এগোয়নি, বরং গোটা ঘটনাকে প্রথমে দুর্ঘটনার মোড়কে সাজাতে চেষ্টা করে পুলিশ। আইনজীবী সব্যসাচী চ্যাটার্জির কথায়, ‘এত সহজ নয় যে আদালতে এসে বোঝাতে পারবে যে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। ফরেন্সিক ল্যাবের রিপোর্টেই সেই মিথ্যা ফাঁস হয়ে যায়। তারপর সাজানো সাক্ষীর বয়ান দিয়ে মামলা সাজানোর চেষ্টা হয়। মূল অপরাধীদের আড়াল করে অন্য কয়েকজনকে ধরা হয়। নাম কে ওয়াস্তে জেরা প্রক্রিয়া হয়। মামলা সাজাতে গিয়ে পুলিশ নিজেই ফেঁসে গেছে। নজিরবিহীন রায়। পুলিশের পাঁচ বছর ধরে চলা তদন্তকে বাতিল করে দিল আদালত’। 
২০১৮ সালের ১৩ মে ঘটনার পরের দিনই লিখিত অভিযোগ করা হয়েছিল বাবা-মাকে হারানো দীপঙ্কর দাসের তরফে। যদিও ১৪ থেকে ১৭ মে পর্যন্ত এফআইআর হিসাবে তা গ্রহণ করেনি পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার বলে দিয়েছিলেন আগে ময়নাতদন্ত হবে, ঘটনাস্থলে তদন্ত করা হবে, তারপরে এফআইআর নেওয়া হবে যা সম্পূর্ণ আইন বিরোধী। যখন ময়নাতদন্তের পরে দীপঙ্কর দাস সিপিআই(এম) নেতৃত্বের সহযোগিতায় বাবা-মায়ের দেহ পুলিশের দখল থেকে মুক্ত করতে চায় তখন পুলিশ জানায় এফআইআর গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও নির্দিষ্টভাবে অভিযুক্তদের নাম জানানো হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, জেরাও করা হয়নি। এরপর ১৩ আগস্ট ফরেন্সিক ল্যাবের রিপোর্ট আসে যে শর্ট সার্কিটে পুড়ে গেলে যে পোড়ার ক্ষত তা ছিল না মৃতদের শরীরে। পুলিশের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যেতেই এরপরে শুরু হয় নতুন কৌশল। হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা প্রত্যক্ষদর্শীকে দিয়ে মামলা বিপথে চালালোর চেষ্টা হয়। জনৈক বিদ্যুত হালদার নামে একজনকে তেলেঙ্গানা থেকে সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তার বয়ানের ভিত্তিতে এরপর কিছুদিন সাধারণ গ্রামবাসীকে গ্রেপ্তার করে মামলা খতম করার চেষ্টা চালায় পুলিশ।
শেষমেষ আদালতে এসে ধাক্কা খেতে হলো মমতা ব্যানার্জির পুলিশ প্রশাসনকে। আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে বিদ্যুত হালদারের বয়ান ধরে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতেই তো গলদ, গোটা মামলাই তো খারিজ হয়ে যাবে। এরপরেই সওয়াল শেষে বিচারপতি পাঁচ বছর ধরে চলা পুলিশি তদন্তকেই বাতিল করে দেন। 
 

Comments :0

Login to leave a comment