নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ২৫ নভেম্বর- আশঙ্কা মতই বিকাশ মিশ্রের হঠাৎ গ্রেপ্তারির জেরে ফের একবার পিছিয়ে গেল কয়লা পাচারকাণ্ডে চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া। কলকাতা পুলিশের হাতে বিকাশ মিশ্রের গ্রেপ্তারির কারনেই এদিন তাকে আসানসোল আদালতে পেশ করতে পারেনি সিবিআই। চার্জশিটে সকল অভিযুক্ত আদালত কক্ষে হাজির না থাকায় সোমবার এই চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেন আসানসোলে সিবিআইয়-র বিশেষ আদালতের বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী।
২০২০ সালের নভেম্বরে একটি এফআইআর-র ভিত্তিতেই কয়লা পাচারকাণ্ডের তদন্ত শুরু হয়। করোনা কালে সে সময় কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার পুরুলিয়া ও আসানসোলের একাধিক ঠিকানায় সিবিআই-র তল্লাশি নিয়ে রীতিমত সাংবাদিক বৈঠক করে ক্ষোভ উগরে দেন মুখ্যমন্ত্রী। একজন কয়লা মাফিয়ার অফিসে কেন্দ্রীয় সংস্থার তল্লাশি নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকে বক্তব্য কার্যত নজিরবিহীন।
২০২২ সালের জুলাই মাসে আসানসোলে সিবিআই’র বিশেষ আদালতে প্রথম চার্জশিট দায়ের করা হয়। অনুপ মাজি ওরফে লালা, বিকাশ মিশ্র, রত্নেশ ভর্মা জয়দেব মণ্ডল, নারায়ণ খার্গে সহ মোট ৫০ জনের নামে চার্জশিট। একজন ইসিএল সিকিউরিটি কনস্টেবলের মৃত্যু হয়েছে। কয়লা মাফিয়া গুরুপদ মাজি অন্য একটি মামলায় তিহার জেলে বন্দি। বাকী ৪৮ জনকেই আদালতে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বিকাশ মিশ্রকে কলকাতা পুলিশ চার্জ গঠনের আগের দিন যৌন হেনস্থার একটি মামলায় হাতে নেওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই সেই চার্জ গঠন সম্ভব হয়নি এদিন।
সোমবার মামলাটিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটিতে ২৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হবে। আর একটিতে চার্জ গঠন হবে ২৭ জনের বিরুদ্ধে। প্রথম ২৩ জনের মধ্যে রয়েছেন অনুপ মাঝি ওরফে লালা, রতনেশ বর্মা এবং বিকাশ। এই তিন জনের বিচার প্রক্রিয়া আলাদা ভাবে হবে। কয়লা পাচার মামলায় যত অভিযোগ উঠেছে, সবেতেই তাদের নাম রয়েছে। বাকী ২৭জনের মধ্যে ইসিএল-র মতো সংস্থার সরকারি আধিকারিক রয়েছেন ১২ জন, বেসরকারি কোম্পানি বা কারখানা রয়েছে এমন ১০জন রয়েছে। একাংশের ইসিএল-র আধিকারিক, রেলের আধিকারিক, পুলিশ, সিআইএসএফ-র আধিকাকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মদতেই চলেছে এই কয়লা পাচার। রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের মদতে সুবিধা মিলতো, বিনিময়ে বিপুল টাকার ভাগ যেত তাঁদের পকেটে।
কয়লা মাফিয়া লালার থেকে মেলা তথ্যে নাকি বিস্মিত গোয়েন্দা আধিকারিকরাও। কার্যত গোটা প্রশাসনের একটা অংশের সঙ্গে সরাসরি প্রকাশ্য যোগ রেখেই চলতো এই কয়লা পাচারের কাজ। লালার যে ডায়েরি আদালতে পেশ করেছে সিবিআই তাতে একাধিক চমকে ওঠার মত প্রভাবশালীর নাম রয়েছে বলে জানিয়েছিল সিবিআই।
অথচ সিবিআই-র চার্জশিটে প্রভাবশালীদের নাম নেই। কয়লা পাচারকাণ্ডে ১১বার তলব করার পরেও হাজিরা দেননি মন্ত্রী মলয় ঘটক। তৃণমূলের অন্যতম ক্ষমতাবান এক শীর্ষ সাংসদের নাম বারেবারে সামনে এসেছিল তবে চার্জশিটে নাম নেই। অভিষেক ব্যানার্জিকে একাধিকবার জেরাও করা হয়েছিল।
সিবিআই-র একটি সূত্রের দাবি, কয়লা পাচারকাণ্ডে বিকাশ মিশ্রের বয়ান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ফেরার বিনয় মিশ্রের ভাই বিকাশ মিশ্র। বিনয় মিশ্রের সংস্থার হিসাবরক্ষকের কাজও করতো সে। একাধিক প্রভাবশালীর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বিকাশ মিশ্রের সাক্ষ্য বিচার পর্বেও গুরুত্বপূর্ণ।
আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে চার্জ গঠনের ঠিক আগেই কলকাতা পুলিশের হাতে বিকাশ মিশ্রের গ্রেপ্তারি নিয়ে। নাবালিকার ওপর যৌন হেনস্থার মতো গুরুতর ঘটনা। অভিযোগ এনেছেন খোদ পরিবারের এক সদস্যা। বিকাশ মিশ্রের দাদা বিনয় মিশ্র। গত চার বছর ধরে সে ফেরার, সিবিআই’ও হাত গুটিয়ে। লুক আউট নোটিস জারি করেও কেন দেশে ফিরিয়ে আনতে পারছে বিনয় মিশ্রকে, গত চার বছর ধরে তা নিয়ে ধোঁয়াশা। বিনয় মিশ্রের তত্ত্ববধানেই টাকা পাচার হয়েছে এক প্রভাবশালীর স্ত্রীর থাইল্যান্ডের অ্যাকাউন্টে। ফেরার বিনয় মিশ্র যদিও এখন আর ভারতের নাগরিক নয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দ্বীপরাষ্ট্রের বাসিন্দা!
সেই একই পরিবারের এক সদস্যা এমন গুরুতর অভিযোগে এফআইআর করলেন । তার ভিত্তিতে রবিবারই গ্রেপ্তার করল পুলিশ। রবিবারই আলিপুর আদালতে তোলা হলে একদিনের জেল হেপাজত হয়। এরপর সোমবার তাকে ফের পকসো আদালতে তোলা হয়। ২৮ পর্যন্ত পুলিশ হেপাজতের নির্দেশ। রবিবার আদালতে দাঁড়িয়েই বিকাশ মিশ্র ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিল। সে মুখ খুললে সরকার পড়ে যাবে- এমন বিস্ফোরক অভিযোগও মিডিয়ার সামনে করে। তাহলে যৌন হেনস্থার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলে পুলিশি হেপাজতে রেখে বিচার পর্বে বিকাশ মিশ্রের ওপর চাপ বাড়াতে চাইছে কোন মহল? বিকাশ মিশ্র বিচার পর্বে সাক্ষ্য দিলে কী কোনও প্রভাবশালী মহল চাপে পড়তে পারে? স্বাভাবিক উঠছে প্রশ্ন। ঐ গ্রেপ্তারির জেরে চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া ফের পিছিয়ে যাওয়ায় সেই প্রশ্নই সামনে আসছে।
আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক এদিন এজলাসে জানান, আগামী ১০ ডিসেম্বর মামলার চার্জ গঠন হবে। ঐ দিন সকল অভিযুক্তকে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্সি জেল কর্তৃপক্ষকে ‘ই-মেল করে বিকাশ মিশ্রের পরিস্থিতি জানতে চেয়েছেন বিচারক। পুলিশ হেপাজতে থাকাকালীন কালীঘাট থানাতেও তিনি ই-মল করবেন বলে জানিয়েছেন। করেছেন বিচারক। আগামী ১০ ডিসেম্বর সশরীরে উপস্থিত না করতে পারলেও যাতে অন্তত ভার্চুয়ালি হাজির করানো যায় আসানসোল আদালতে, সে কথাও বলেছেন বিচারক।
Comments :0