PF ESI

কর্পোরেটের স্বার্থে শ্রমিকের ভবিষ্যৎ লুটের ব্যবস্থা পাকা করল নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার

উত্তর সম্পাদকীয়​

গার্গী চ্যাটার্জি
ভারতবর্ষের শ্রমিক আন্দোলনের জয় হিসাবে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের যে কয়েকটি মৌলিক দাবি এদেশের অতীত সংগ্রামী শ্রমিক ও নেতৃত্ব আদায় করে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন, তার মধ্যে ইএসআই ও প্রভিডেন্ট ফান্ড অন্যতম।
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, আইন হিসাবে দেশের সংসদের উভয় কক্ষ থেকে অনুমোদিত হওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ বারে বারে সমস্ত দিক খতিয়ে দেখেছিলেন যাতে, শ্রমিক ও তার পরিবারের সুপার স্পেশালিটি চিকিৎসা সহ সব ধরনের চিকিৎসা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে শ্রমিক ও তার পরিবারের ভবিষ্যৎকে যথাসম্ভব সুরক্ষিত রাখা যায়।
এই প্রশ্নে কোনোপ্রকার সমঝোতা সে সময়ে সরকারের তরফে করার চেষ্টা করা হয়নি বা করা হলেও দেশের সংসদ সর্বসম্মতভাবে শ্রমিক-কর্মচারীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে তাকে কার্যকর করতে দেয়নি। প্রকল্প দুটি আইনে পরিণত হওয়ার পর বহুবার সংশোধিত হয়েছে, কিন্তু তা শ্রমিকদের পক্ষে সংশোধিত হয়েছে। যেমন- এই মুহূর্তে সিআইটিইউ সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি ইএসআই'র বর্তমান বেতনের সিলিং ২১০০০ টাকা থেকে বাড়াবার জন্য দাবি করছে, কারণ বহু শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন ২১০০০ টাকা পেরিয়ে যাওয়ায় তারা এই প্রকল্পের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই মুহূর্তে সিলিং না বাড়ালে- অসংখ্য শ্রমিক-কর্মচারী এবং তাদের পরিবার এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং প্রতিদিন নতুন নতুন কর্মী ও তাদের পরিবার বঞ্চিত হতে থাকবেন।
এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডস এন্ড মিস্লেনিয়াস প্রভিসন্স অ্যা ক্ট, ১৯৫২'র অধীনে শ্রমিক-কর্মচারীর ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সুবিধাকে সুরক্ষিত করা হয়। এই প্রকল্পে শ্রমিকের মাসিক বেতন (বেসিক+ডি.এ.+রিটেইনিং অ্যা লাউন্স)-এর ১২% অর্থ প্রতিমাসের বেতন থেকে কেটে এবং মালিকপক্ষের/কর্তৃপক্ষের সমপরিমাণ অর্থাৎ ১২% অর্থ, সর্বমোট ২৪% অর্থ প্রতিমাসে প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এর সাথে ইডিএলআই বা এমপ্লয়িজ ডিপোজিট লিঙ্কড ইন্সিওরেন্স বাবদ কর্তৃপক্ষকে ০.৫% অর্থ বা সর্বনিম্ন ৭৫ টাকা জমা করতে হয়। এছাড়াও এডমিনিস্ট্রেটিভ চার্জ বাবদ আরও ০.৫% অর্থ বা সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা, যেটি বেশি তা কর্তৃপক্ষকে জমা করতে হয় একই সাথে। প্রভিডেন্ট ফান্ড আইনানুসারে প্রতিমাসের ১৫ তারিখের মধ্যে এই চাঁদার অর্থ অনলাইনে ইসিআর (ইলেক্ট্রনিক চালান কাম রিটার্ন)-এর মাধ্যমে জমা করা বাধ্যতামূলক।
এই পদ্ধতিতে প্রভিডেন্ট ফান্ডের চাঁদার অর্থ প্রতিমাসে কোম্পানির বা সংস্থার মালিকপক্ষের/কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রভিডেন্ট ফান্ড কর্তৃপক্ষের নিকট জমা নিশ্চিত করার জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড আইনে প্রথম থেকেই কড়া কিছু বিধান'র সংস্থান রাখা হয়। এই আইনের ১৪ নং ধারা এবং তার উপধারাগুলিতে ছত্রে ছত্রে শ্রমিক-কর্মচারীর মাসিক বেতন থেকে চাঁদা বাবদ কেটে নেওয়া অর্থ জমা না দিলে মালিকপক্ষ/কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে জেল ও জরিমানার বিধান নথিভুক্ত করা হয়েছে।
এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের জারি করা ২৬.০৮.২০১০-এর নির্দেশ অনুসারে সময়মতো চাঁদার অর্থ জমা না দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে— সর্বাধিক ২ মাস পর্যন্ত দেরির জন্য বার্ষিক ৫%, ২ মাসের অধিক সর্বাধিক ৪ মাস পর্যন্ত দেরির জন্য বার্ষিক ১০%, ৪ মাসের অধিক সর্বাধিক ৬ মাস পর্যন্ত দেরির জন্য বার্ষিক ১৫% এবং ৬ মাসের অধিক সময়ের জন্য বার্ষিক ২৫% অর্থ জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল (এই জরিমানা পরিস্থিতি সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ১০০% পর্যন্ত হতে পারে)।
শ্রমিক-কর্মচারীর কষ্টার্জিত এই অর্থ প্রভিডেন্ট ফান্ড তহবিলে জমা না করে কর্পোরেট মালিকদের যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে নতুন শপথ নেওয়া নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকারের শ্রমমন্ত্রক গত ১৪ জুন, ২০২৪ গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে সব ক্ষেত্রেই বার্ষিক ১২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
এই পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট কর্পোরেটের অর্থে পুষ্ট বিজেপি নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না করে জোড়াতালি দেওয়া সরকার গঠন করেই—  নির্বাচনের পরে কর্পোরেট মালিকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য শ্রমিকের ভবিষ্যতের সঞ্চয়কে নিয়ে যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের সুযোগ করে দিল।
কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের এই ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দেশে প্রভিডেন্ট ফান্ডের তহবিল অর্থ খেলাপি সংস্থার সংখ্যা এক ধাক্কায় বহুগুণ বেড়ে যেতে বাধ্য। বিপুল পরিমাণ জরিমানার বোঝা থাকা সত্ত্বেও ইতিমধ্যে দেশে বহু খেলাপি সংস্থা রয়েছে, যারা বহুদিন যাবৎ প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ জমা দিচ্ছে না।
কর্পোরেটমুখী এবং শ্রমিক-কর্মচারীর স্বার্থের পরিপন্থী এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সিআইটিইউ ইতিমধ্যে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। সময়ের দাবি অনুসারে সিআইটিইউ'র আহ্বানে প্রতিটি কারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আগামীর এই আন্দোলন শ্রমিকের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই। সব অংশের শ্রমজীবী মানুষ এই লড়াইয়ের মধ্যে থেকে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য স্বৈরাচারী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকৃতরূপকে আপামর ভারতবাসীর সম্মুখে উন্মোচিত করবে, এ শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

Comments :0

Login to leave a comment