CAA ELECTION

রাজ্যের মানুষকে বে-নাগরিক করার চক্রান্ত রুখতে হবে

উত্তর সম্পাদকীয়​

সুজন চক্রবর্তী
লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আবারও মানুষকে নতুন করে বিভ্রান্ত করার কাজে লেগে পড়েছে বিজেপি’র নেতা মন্ত্রীরা। সঙ্গে দোসর তৃণমূল। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিধি প্রণয়ন করে নির্বাচনের আগেই নাকি সবাইকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। ভোট বাগিয়ে নেবার অছিলায় মানুষকে আরও একবার ঠকানোর প্রচেষ্টা। যদি করবেই তাহলে আইন পাশ হবার পর চার বছর ধরে করেনি কেন? আসলে শাসক দলের নেতারাও জানে যে এই সংশোধনী আইন, সিএএ, নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য নয়। বরং এর মধ্য দিয়ে মানুষের নাগরিক জীবন সংশয় ও সঙ্কটের আবর্তে জটিল হবে। আসলে বিভ্রান্ত করে লোক ঠকানোর এই প্রচেষ্টা। সিএএ, এনআরসি এর এই চক্করে মানুষকে বে-নাগরিক করার যে কোনও  চক্রান্ত রুখতেই হবে। এর কোনও বিকল্প নেই। 
(২)
স্বাধীনতার অংশ হিসাবে দেশভাগ এবং বিশেষত বাংলা ভাগের পর ব্যাপক সংখ্যায় মানুষ ছিন্নমূল এবং বাস্তুহারা হয়ে এদেশে এবং বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হন। এদের সিংহভাগ তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের এক বড় অংশ মতুয়া মতাবলম্বী। বিশ্বে সবথেকে বেশি উদ্বাস্তু মানুষের বসবাস বাংলায়। এই মানুষেরা বরাবরই নাগরিকের অধিকার এবং পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে চলেছেন। নাগরিকত্ব নিয়ে মানুষের কোনও সমস্যা ছিল না এবং স্বভাবতই এই বিষয়ে সচেতনতার কোনও বাড়তি প্রয়োজন ভারতবাসীর বাস্তবত ছিল না।
(৩)
নাগরিকত্ব নিয়ে সংশয় এবং সঙ্কটের সূত্রপাত বস্তুত পক্ষে এনডিএ সরকারের আমলে। বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ২(১)(বি) ধারা সৃষ্টি করে। এর মধ্য দিয়ে প্রায় সমস্ত বাস্তুহারা মানুষ কার্যত বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে ঘোষিত হয়ে যায়। ৩(এ) ধারা মারফত জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের সুযোগ এবং অধিকারকে কেড়ে নিয়ে বে-নাগরিক সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়। ১৪(এ) ধারায় বাধ্যতামূলক নাগরিক পঞ্জি, এনআরসি, এর বন্দোবস্ত করে। সেই থেকে নাগরিকত্ব নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সমস্যা, দুশ্চিন্তা এবং  আতঙ্ক বাড়তে থাকে।
(৪)
২০০৩ সালের সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেন ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর। তখন ওডিশায় বিজেপি-বিজেডি সরকার ক্ষমতায়। তখনই ওডিশার কেন্দ্রপাড়া জেলার মহাকালপাড়া ব্লকের ১৫৫১ জন বাঙালি উদ্বাস্তু মানুষকে বাংলাদেশি অজুহাতে দেশ ছাড়ার নোটিস দেওয়া হয়। ওডিশা থেকে কিছু উদ্বাস্তুকে ধরে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বলাই বাহুল্য যে, তাঁরা সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। এই সময়ে দেশের নানা প্রান্তে বাংলাভাষী মানুষকে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে হেনস্তা করা চলতে থাকে। বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ হলে সঙ্কট আরও অনেক বেশি। ভিন রাজ্যে এই মানুষদের সঙ্কটের সময়ে বৃন্দা কারাত, হান্নান মোল্লা সহ বামপন্থী নেতারা এদের পাশে থেকে অনেকাংশেই সুরাহা করতে পারলেও, বাংলাভাষী মানুষের দুশ্চিন্তা থেকেই গেল। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু মানুষকে অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম খারিজ করার দাবি করে তৃণমূল কংগ্রেস। পার্লামেন্টে এবং নির্বাচন কমিশনেও তারা বারবার এই সংক্রান্ত দাবি তোলে। এর পরিণতিতে বিভিন্ন অজুহাতে অসংখ্য মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। বহু মানুষের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, অনেকে জেল খেটেছেন, বিভিন্ন অত্যাচার ও অসম্মানের সম্মুখীন হয়েছেন। অসমের এনআরসি'র প্রক্রিয়ার ফলাফল দেখার পর এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের বার বার হুমকির পর, গোটা দেশের উদ্বাস্তু এবং এমনকি ভূমিপুত্র বলে দাবি করা মানুষেরাও উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। 
(৫)
নথিপত্রই যদি নাগরিকত্বের ভিত্তি হয়, তাহলে একটা বড় অংশের মানুষের পক্ষেই তা হাজির করা প্রায় অসম্ভব। যে যত গরিব তার কাছে কাগজপত্র এবং প্রামাণ্য নথিপত্রের সুযোগ তত কম। তাদের আশঙ্কা স্বভাবতই সবচেয়ে বেশি। ফলে দেশের মানুষের নাগরিকত্ব সমস্যা কেবলমাত্র উদ্বাস্তু, মতুয়া কিংবা সংখ্যালঘু মানুষের ক্ষেত্রেই সঙ্কট সৃষ্টি করছে তা নয়, বরং সমস্ত অংশের মানুষের জন্যই দেশের নাগরিকত্ব আইন এখন বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।
(৬)
২০০৩ সালের সর্বনাশা এই সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা তো বটেই, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বরাবরই প্রতিবাদ জানিয়েছে। উদ্বাস্তু, মতুয়া বা অন্যান্য অংশের মানুষ ধারাবাহিকভাবেই আন্দোলন চালিয়ে গেছে। তারই ফলশ্রুতিতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সিএএ ২০১৯ তৈরি করেছে। কিন্তু এটাও কার্যত মানুষকে ঠকানোর আর একটা কৌশল মাত্র। বস্তুত পক্ষে সেই কারণেই চার বছর পার হয়ে গেলেও, এখনও এই আইনের রুলস প্রকাশিত হয়নি। ভোটের মুখে প্রতিবারই বিজেপি মুখে বললেও এই আইন কার্যকর করতে পারেনি। লোকসভা ভোটের আগে আবারও তারা দাবি করছে যে সত্বর রুলস প্রকাশিত হবে এবং উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাবেন। বিজেপি’র এই  ঘোষণা হলো এক মস্ত ধাপ্পা। উদ্বাস্তুদের ভুল বুঝিয়ে ভোট নেওয়ার  এক জঘন্য কৌশল। সত্যি হলো এই যে, চার বছর আগে রুলস প্রকাশিত হলে এতদিনে মানুষ এই ধাপ্পাটা বুঝে যেতেন। তাই প্রায় দীর্ঘ চার বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার রুলস প্রকাশ করেনি। ঠিক ভোটের মুখে বিজেপি হয়তো গোঁজামিল দিয়ে একটা রুলস প্রকাশ করতে চাইবে, যাতে মানুষ এই আইনের সীমাবদ্ধতা বোঝার আগেই নাগরিকত্বর নামে উদ্বাস্তু ও গরিব মানুষদের ভোট হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়।
বস্তুত পক্ষে এই আইনে নাগরিকত্ব প্রদানের নির্দিষ্ট কোনও কথা বলা নেই। কেবলমাত্র তিনটি দেশের ছয়টি সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার সুযোগটুকু দেওয়া হয়েছে।  এই আবেদন করার জন্য এমন সব শর্ত দেওয়া হয়েছে যা পূরণ করা সাধারণভাবে প্রায় অসম্ভব। আবেদনকারীকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি আফগানিস্তান পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। এবং ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে এদেশের বাসিন্দা হয়েছেন। বিদেশ থেকে এই নথি সংগ্রহ করা কারোর পক্ষে কি সম্ভব? উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিনস্টা নির্বিশেষে কাউকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী তকমা দেবার কোনও আইন আগে ছিল না। ২০০৩ সালে বিজেপি-তৃনমূল এনডিএ আমলেই এই অপরাধ সৃষ্টি করা হয়। বাম, কংগ্রেস, উদ্বাস্তু, মতুয়া সহ সমাজের নানা অংশের মানুষের দীর্ঘ লড়াইয়ের চাপে শেষ পর্যন্ত বিজেপি নিজেদের তৈরি করা আইনে নিজেরাই সংশোধনী আনতে বাধ্য হয়। আইনের সীমাবদ্ধতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন। অনুপ্রবেশকারী তকমা মুক্তির পর উদ্বাস্তুরা আবেদন করলেও নাগরিকত্ব পাবার যে কোনও নিশ্চয়তা নেই, মোদী সরকার জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির (জেপিসি) রিপোর্টেও সে'কথা স্পষ্ট স্বীকার করেছে। সেই কারণেই, বরং এখনও দেশে সামান্য যে ক'টি নাগরিকত্ব প্রদান করা হচ্ছে তা সবই পূর্বতন ১৯৫৫ সালের আইনের ভিত্তিতে।
(৭)
অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস ও তাদের নেত্রী ২০০৩ সালের সর্বনাশা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের শরিক। সেই আইনের মধ্য দিয়ে বাংলার গরিব ও উদ্বাস্তু মানুষকে বে-নাগরিক করার চক্রান্ত হয়েছে। মিথ্যা এবং ধাপ্পা দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভোট আদায়ের কৌশল গ্রহণ করছে। ঘটনা পরম্পরায় এটা পরিষ্কার যে তৃণমূল নেত্রী রাজ্যবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করছেন। বস্তুতপক্ষে তিনিই উদ্বাস্তুদের অনুপ্রবেশ কারী হিসাবে দাগিয়ে দিয়েছেন। উদ্বাস্তু মানুষদের নাম সংবলিত গাইঘাটার ভোটার তালিকা পার্লামেন্টের স্পিকারের টেবিলে ছুঁড়ে তাদের অনুপ্রবেশকারী বলে বিষোদ্গার করেছিলেন। এছাড়াও রাজ্যবাসীর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে তৃণমূল সরকার ও প্রশাসন কোনও ক্ষেত্রেই ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদিকে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র হিসাবে মানে না। তফসিলি জাতি শংসাপত্র প্রদানের সময় তারা ১৯৭১ সালের পূর্বে এ রাজ্যে বসবাসের প্রমাণ  চাইছে। এখন ভোটের স্বার্থে আবার মানুষের নাগরিকত্ব নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে চলেছে।
(৮)
নাগরিকত্ব মানুষের অধিকার। তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে না। বাংলার মানুষকে বে-নাগরিক করার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে। নাগরিকত্বের জন্য দরখাস্ত এবং নথিপত্র দেখানোর নাম করে মানুষকে ঠকানো চলবেনা। সিএএ এবং এনআরসি- এর নাম করে মানুষকে ভীতি প্রদর্শন এবং সঙ্কটের মধ্যে ফেলা যাবে না। নাগরিকত্ব আইনের ২০০৩  এর সংশোধনীর বিপজ্জনক ধারাগুলিকে বাতিল করতে হবে। নাগরিকত্ব বিষয়ে অনিশ্চয়তা রেখে কখনোই নাগরিক পঞ্জি হতে পারে না।
মানুষ চায় শর্তহীন এবং সুনির্দিষ্ট নাগরিকত্ব। তার গ্যারান্টি করতে হবে। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলা অথবা ভারতের যে মানুষেরা এখানে চলে এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব এবং পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এদেশের তৎকালীন নেতারা। ব্যক্তি মানুষের চাইতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কোনও অংশেই কম নয়। ১৯৪৮-এর ১৯ জুলাই বা ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ ভিত্তি বর্ষ হতে পারে না। বরং ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বা তার পরের কোন তারিখকে ভিত্তিবর্ষ স্থির করে তার পূর্ব থেকে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সবাইকে ভারতের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতিকরণকে সুনিশ্চিত করতে হবে। ভারতে বসবাসের প্রমাণপত্র হিসাবে সুপ্রিমকোর্ট ইতিমধ্যেই ১৪ টি দলিলকে নির্ধারণ করেছে। এর সঙ্গে আরও কিছু নথিপত্রকে মান্যতা দেওয়া জরুরি। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ নির্বিশেষে তফসিলি, আদিবাসী, মতুয়া সহ উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদান  সহজ, সরল এবং স্বাভাবিক করতে হবে। সিএএ এবং এনআরসি’র নামে বে-নাগরিক করার কেন্দ্রীয় চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে হবে। সুনির্দিষ্ট এবং শর্তহীনভাবেই মানুষের নাগরিকত্ব গ্যারান্টি করতে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রমই সবচাইতে জরুরি।

Comments :0

Login to leave a comment