Post Editorial Upendranath Brahmachari

বিস্মৃতির অতলে আজও উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী

রাজ্য উত্তর সম্পাদকীয়​

ডাঃ শঙ্করকুমার নাথ
 

সময়টা ১৯৩৬ সাল। জায়গাটা ইন্দোর, মধ্যপ্রদেশ। এই শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেসের ২৩তম অধিবেশন ২ থেকে ৮ জানুয়ারি। এই অধিবেশনের প্রধান বক্তা বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি তাঁর দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করা শুরু করলেন। আমরা এখানে তার সামান্য অংশ উল্লেখ করব। এবারের সভাপতি একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক।
তিনি বললেন:
‘‘কালাজ্বর একটি ভয়ঙ্কর রোগ, বিশেষ করে ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে। একসময়ে অ্যান্টিমনি নিষিদ্ধ হয়ে গেছিল, এতটাই যে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকদের শপথ নিতে হত যে তাঁরা কোনদিন অ্যান্টিমনি ব্যবহার করবেন না। কিন্তু এখন দেখা গেল এইটাই কালাজ্বরের নির্দিষ্ট ওষুধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে কালাজ্বরে মানুষ শতকরা ৯৯ জনই মারা যেত, সেখানে এই ওষুধ ব্যবহার করেই দেখা গেল মৃত্যুর হার নেমে এল শতকরা ১ বা ২ জনে সাধারণভাবে....
কোনও সন্দেহ নেই, কালাজ্বরের চিকিৎসায় ডাক্তার রজার্স কুইনাইন এবং টারটার এমেটিক-এর অতিরিক্ত ডোজ প্রয়োগ করেছিলেন এদেশে। বর্তমান বক্তা এই রোগের চিকিৎসায় খুব শীঘ্রই ব্যবহার করতে শুরু করলেন সোডিয়াম অ্যান্টিমনিল টারট্রেট। ফলে টারটার এমেটিক-এর ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেল।
এই রোগের চিকিৎসার পরের ধাপটি শুরু করলেন বর্তমান বক্তা। তিনি ধাতব অ্যান্টিমনিকে ক্ষুদ্র কণাতে পরিবর্তন করে রোগীর শিরায় প্রবেশ করিয়ে চিকিৎসা করতে শুরু করলেন এবং উল্লেখযোগ্যভাবে সুফল পেলেন। পর্যবেক্ষণ করে জানা গেল, অ্যান্টিমনির এই ক্ষুদ্র কণাগুলি রক্তের মধ্য দিয়ে প্লীহার (Spleen) সেই সমস্ত শেষে ঢুকে পড়ে যেখানে কালাজ্বরের পরজীবীগুলি অবস্থান করছে। কোষের ভিতর এই দুইয়ের মধ্যে লড়াই এবং পরিণামে পরজীবীগুলির সম্পূর্ণরূপ ধ্বংসপ্রাপ্তি।
পরবর্তী ধাপে কালাজ্বরের চিকিৎসায় আরও খানিকটা এগনো গেল আরও কিছু অ্যান্টিমনির জৈব যৌগের ব্যবহার করার ফলে। আর এইটাই ছিল বর্তমান বক্তার বহু বছরের গবেষণার বিষয় এবং এই প্রথম ভারতে ১৯২০ সালে এইসব প্রস্তুত করা গেল কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল হাসপাতালে।
১৯২১ সালের প্রথম দিকে এই বক্তা কালাজ্বরের চিকিৎসায় আবিষ্কার করলেন ইউরিয়া অ্যান্টিমনি যৌগ। এই আবিষ্কার এবং বক্তার অ্যান্টিমনিয়াল যৌগ সম্পর্কিত অন্যান্য গবেষণাগুলি ভারতে এই রোগের চিকিৎসায় এক নূতন দিগন্ত খুলে দিল। এই ইউরিয়া যৌগটির নাম হল ‘ইউরিয়া স্টিবামাইন’ 
ইউরিয়া স্টিবামাইন-এর আবিষ্কারের ঘটনা যতই কৌতূহলোদ্দীপক হোক না কেন, সে-সব ইতিহাস বলে আমি আপনাদের এখানে অধিক্ষণ বসিয়ে রাখব না। কিন্তু আমি আনন্দের সঙ্গে অবশ্যই বলব, শিয়ালদহে অবস্থিত কলকাতা ক্যাম্পবেল হাসপাতালের সেই স্মরণীয় রাতের কথা। সেদিন, সারাটাদিনের গবেষণায় কঠোর পরিশ্রমের পর, তখন প্রায় রাত দশটা, ছোট্ট একটা ঘর, কেরোসিন তেলের লম্ফ জ্বলছে, হালকা আলো, ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে গেছে। বর্তমান বক্তা দেখলেন, পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলে তাঁর আশাপ্রদ যৌগটির প্রস্তুতি সম্পূর্ণ সফল হয়েছে, সার্থক হয়েছে। হ্যাঁ, সেই ঘরটি আজও রয়েছে, কিন্তু তার ভিতরে গবেষণাগারের সমস্ত চিহ্নই উধাও হয়ে গেছে।”
হায়, আবিষ্কারক বক্তার কী আক্ষেপ। বক্তার আবিষ্কার (১৯২১) থেকে বক্তব্য পেশের (১৯৩৬) মধ্যে মাত্র ১৫টি বছর গেছে, তাতেই ইতিহাসকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বক্তা এরপর বলছেনঃ
“আজ ভারতে কালাজ্বরের প্রধান চিকিৎসা হল ইউরিয়া স্টিবামাইন এবং এটি এই রোগের একটি শক্তিশালী প্রতিষেধকও বটে এবং অত্যন্ত সুখের কথা যে, এই চিকিৎসাই অসংখ্য রোগীর প্রাণরক্ষার প্রধান উপায়।.....
আসামে আগে সেখানে ১০০ জনের মধ্যে এই রোগে ৯৮ জন মারা যেত, সেখানে ১৯২৩ সালে প্রায় ৩২৮৫৯১ জন কালাজ্বর রোগীকে এই চিকিৎসা দেবার ফলে জীবন রক্ষা পায় ৩২৫০০০ জন। লিস্‌ম্যানিয়া ডনোভ্যানি দ্বারা সংক্রামিত কালাজ্বর রোগীর চিকিৎসায় আরও অগ্রগতি দরকার, কেননা, খুব কম হলেও কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিমনি চিকিৎসা পুরোপুরি কাজ করে না।
কালাজ্বর সেরে ওঠার পর, রোগীর চামড়ায় যে-কালো রঙের সংক্রমণ দেখা যায়, তা সে এই রোগের জন্যই, তা প্রথম বর্ণনা করেন এই বক্তা, যাকে বলা হয় চামড়ার লিস্‌ম্যানয়েড (Dermal Leishmanoid)। এর চিকিৎসা এখনও সন্তোষজনক নয়।
এরপর বক্তা বলতে থাকেন বিজ্ঞান-সম্পর্কিত অন্য বিষয়ে। কালাজ্বর নামের এক কালান্তক প্রাণহরণকারী রোগের প্রতিকারক ওষুধের আবিষ্কারক উপরোক্ত বক্তার নাম ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। উপেন্দ্রনাথের জন্ম সরকারিভাবে ৭ জুন, ১৮৭৫ হলেও, তিনি নিজে বলতেন, তাঁর জন্ম ১৯ ডিসেম্বর, ১৮৭৩, বিহারের মুঙ্গের জেলার জামালপুরে।

পড়াশোনা
ফার্স্ট আর্টস পাশ করে ১৮৯৩ সালে উপেন্দ্রনাথ হুগলি কলেজ থেকে বিএ পাশ করলেন গণিত এবং রসায়নে অনার্সসহ। হ্যাঁ, গণিতে তিনি প্রথম হয়েছিলেন এবং ‘থোয়েটস্‌ পদক’ পেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন রসায়ন পড়তে ও সাথে সাথে ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে। ১৮৯৪ সালে অর্জন করলেন রসায়নবিদ্যায় এমএ ডিগ্রি, পেলেন পদক। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি শিক্ষকরূপে পেয়েছিলেন আলেকজান্ডার পেডলার এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে।
১৮৯৯ সালে উপেন্দ্রনাথ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এলএমএস পাশ করলেন, পরের বছর এমবি ডিগ্রি। ১৯০২ সালে পেলেন এমডি ডিগ্রি। ১৯০৪ সালে অর্জন করলেন শারীর বিদ্যার পিএইচডি। এইভাবেই প্রতিভা ও মেধার সংমিশণে তৈরি হল ভবিষ্যতের একজন আবিষ্কারকের ভিত।

কালাজ্বরের পরজীবী
১৯০০ সালের নভেম্বরে প্যাথলজির চিকিৎসক উইলিয়াম বুগ লিসম্যান (১৮৬৫-১৯২৬) আবিষ্কার করে ফেললেন কালাজ্বরের পরজীবী। আলাদাভাবে ১৯০৩ সালে আরও একজন গবেষক চার্লস ডনোভ্যান (১৮৬৩–১৯৫১) একই পরজীবী আবিষ্কার করলেন। ডাঃ রোনাল্ড রস পরে কালাজ্বরের এই পরজীবীর নাম দুই আবিষ্কারকের নামে রাখলেন, “লিসম্যান-ডনোভ্যান বডিজ”।
উপেন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল না
১৯২৯ সাল। ভারতের ঝুলিতে তখন একটি মাত্র নোবেল পুরকার, পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে। সুইডিশ অ্যাকাডেমির দুজন সদস্য Hans Christian Jacobaeus এবং Goran Liljestrand-কে বলা হল ভারত থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে
নোবেল পুরস্কারের জন্য একজন বিজ্ঞানীর নাম সুপারিশ করতে। তাঁরা সবদিক বিবেচনা করে ঐ বছর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর নাম সুপারিশ করলেন এক নম্বর বাছাই হিসেবে, যুগান্তকারী ইউরিয়া স্টবামাইন আবিষ্কার এবং ‘Dermal Leishmaniasis’ আবিষ্কারের কারণে। সে বছর কলকাতা থেকে উপেন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেছিলেন নোবেল পুরস্কারের জন্য অধ্যাপক সুধাময় ঘোষ।  ইনি স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের শিক্ষক ছিলেন। এর কিছু আগে এই সুধাময় ঘোষ, রামনাথ চোপড়া এবং এনআর চ্যাটার্জি উপেন্দ্রনাথের আবিস্কারের দাবিকে উপেক্ষা করে জার্নালে প্রতিবেদন লিখেছিলেন— অবজ্ঞা এসেছিল লিওনার্ড রজার্স-এর পক্ষ থেকেও।
অতীব দুঃখের যে, তিনি বাছাই পর্বে এক নম্বর থাকলেও, তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল না। সে-বছর নোবেল পুরস্কার পেলেন নেদারল্যান্ডের christian Eijxman এবং ইংলন্ডের Frederick Gowland Hopkins, তাঁদের ভিটামিন সংক্রান্ত কাজের জন্য।
এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই সে, ঐ সময় উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কৃত ইউরিয়া স্টিবামাইনের ব্যবহারে সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ কালাজ্বর রোগী প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। সে-সব কতটা বিবেচনা করা হয়েছিল?
১৯৪২ সালে আরও একবার উপেন্দ্রনাথের নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। এবার পাঁচজন তাঁর নাম সুপারিশ করেছিলেন, ড. ইউপি বসু (কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিনের অধ্যাপক), ড. এমএন বসু (কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমির অধ্যাপক), ড. এসসি মহলানবিশ (কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের শারীর বিজ্ঞানের অধ্যাপক), ড. সুধাময় ঘোষ (স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন-এর পদার্থবিদ্যা ও রসায়ণবিদ্যার অধ্যাপক) এবং ড. সিসি বসু (কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের প্যাথলজির অধ্যাপক)।
এবারও তিনি বঞ্চিত হলেন নোবেল পুরস্কার থেকে।
শেষের দিকে মেঘনাদ সাহা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, যাতে উপেন্দ্রনাথ রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হতে পারেন— অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও যে-সময় চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভারতের প্রথম রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিল, তার কিছু পরেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে যায় ৬ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ সালে।
শেষে কিছু কথা
চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষকে যিনি বাঁচিয়েছিলেন, তাঁর নাম ড. এডওয়ার্ড জেনার— গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করে। সমগ্র বিশ্ব তাঁকে মাথায় তুলে রেখেছে। আর ভারতে সবচেয়ে বেশি মানুষকে যিনি বাঁচিয়েছিলেন কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করে, তাঁর নাম ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। তাঁকে আমরা বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিয়েছি। তাঁর জন্মের দেড়শো বছরে আমাদের আবেদন, ভারতে অন্তত একটি বড় মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের নাম তাঁর নামে চিহ্নিত করা হোক।

Comments :0

Login to leave a comment