Communalism

ভোট শেষ, শেষ হয়নি সংখ্যালঘু বিদ্বেষ

জাতীয় উত্তর সম্পাদকীয়​

গৌতম রায়
 

অষ্টাদশ লোকসভা ভোটের ফলে বিজেপি একক গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়তে পারেনি। জোট শরিকদের নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকার তৈরির ফলে অনেকেই অনুমান করেছিলেন, বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন কিছুটা হলেও স্তিমিত হবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদী শপথ নেওয়ার পর উত্তর ভারত জুড়ে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর গত কয়েকদিনে ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছে গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি। একটা ঘটনাতেও পুলিশ, প্রশাসন অপরাধীদের ঘিরে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
সদ্য সমাপ্ত লোকসভা ভোটের ফলাফল ঘোষণের পর থেকেই দেশ জুড়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালাচ্ছে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির। যেভাবে তারা এই আক্রমণ চলছে, তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করেছে যে, ভোটে বিপর্যয়ের পর মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পর্কে আরএসএস, বিজেপি সহ তাদের সমস্ত ধরনের সঙ্গী সাথিরা আরও ভয়ঙ্কর রকমের প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠেছে। সেই প্রতিহিংসার পথ ধরে তারা মেরুকরণের রাজনীতিকে এই ক’দিনেই উত্তর ও মধ্য ভারতে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে দিতে শুরু করেছে, যার ফলাফল একটা বড় সামাজিক সঙ্কট ডেকে আনবে। ভোটের ফল প্রকাশের পর এমনভাবে আক্রমণ শানানো শুরু হয়েছে যাতে গোটা সামাজিক পরিবেশটাই বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হবার অব্যবহিত পরেই ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরে একটি বলদ নিয়ে তিনজন মুসলমান যাচ্ছিলেন। সেই সময় ওই তিন ব্যক্তিকে আটক করে তথাকথিত গোরক্ষকেরা। ওই তিনজন মুসলমান, গোরু পাচারকারী— এই অভিযোগ তুলে স্বঘোষিত গোরক্ষকেরা তাদেরকে পিটিয়ে মারে । গোটা ঘটনা সম্পর্কে আজ পর্যন্ত ছত্তিশগড়ের পুলিশ কোনোরকম ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, তদন্ত পর্যন্ত করেনি।
উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে একজন মুসলমানকে চোর অপবাদ দিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী যখন একক গরিষ্ঠতা নিয়ে প্রথমবার কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছিলেন, তখন যেভাবে উত্তর প্রদেশের দাদরী গ্রামে শেখ আখলাক, তাঁর বাড়ির ফ্রিজে গোরুর মাংস রেখেছেন— এই অভিযোগে তাঁকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে খুন করা হয়। ঠিক সেই কায়দায়  মধ্য প্রদেশের মাগলায় ১১ টি মুসলমান সহনাগরিকের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। অভিযোগ ওই ১১ টি বাড়ির ফ্রিজে নাকি গোরুর মাংস ছিল। এ কথাটা স্থানীয়ভাবে প্রচার করে একটা নৃশংস মেরুকরণের রাজনীতি  এলাকার ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে, গোটা মধ্য প্রদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা।
উত্তর প্রদেশের  অযোধ্যাতে বিজেপি জিততে পারেনি। সমাজবাদী পার্টি উত্তর প্রদেশে বিজেপি’র থেকে বেশি আসন পেয়েছে। সেই নিরিখে ইন্ডিয়া জোটে  সমাজবাদী পার্টির কদর অনেক বেড়েছে। বিজেপি উত্তর প্রদেশে ভালো ফল করতে না পারায় সেখানকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপরে  অত্যাচার চালাচ্ছে। উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌয়ের আকবর নগর এলাকাটি সংখ্যালঘু প্রধান। প্রায় এক হাজারের ওপর গরিব এবং মধ্যবিত্ত মুসলমান এখানে বসবাস করেন। বিভিন্ন ধরনের পেশার সঙ্গে তাঁরা যুক্ত। এখানকার নদীর উপরে নাকি অবৈধ নির্মাণ হচ্ছে ,আর সেই নির্মাণ কাজ করছে তারা। লোকসভা ভোটের আগের থেকে এমন অভিযোগ তুলে, গোটা এলাকায় একটা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ স্বয়ং ।
     সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ভোটের আগেই এই আকবরনগর এলাকায় মুসলমানদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালানো হয়। বুলডোজার দিয়ে তাঁদের বাড়ি ঘরদোর ভেঙে দেওয়া হয়। এই বুলডোজার দিয়ে আকবরনগরে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার ঘটনাটি  যোগী আদিত্যনাথ ভোটের পরেও অব্যাহত রেখেছেন। যেখানে সংখ্যালঘুদের দ্বারা অবৈধভাবে নদী দখলের অভিযোগ  আদিত্যনাথ এনেছেন । সেখানে সমাজকর্মীদের ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা গেছে, নদীর পাড় বাঁধানোর  নাম করে আসলে সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘরদোর ভাঙছে আদিত্যনাথের প্রশাসন। পশ্চিমবঙ্গে যে এখন বুলডোজাররাজ নতুন করে প্রবর্তন করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেটি উত্তর প্রদেশের দীর্ঘদিন ধরেই অব্যাহত রয়েছে। আর উত্তর প্রদেশের এই বুলডোজার রাজের একমাত্র টার্গেট হলো সহ নাগরিক  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
  ভোটের আগে যে পরিস্থিতি ছিল ভোটের পরেও তার কোনও অন্যথা হয়নি। সিপিআই(এম) গোটা দেশ জুড়ে লোকসভা নির্বাচন উত্তর পরিস্থিতিতে, হিন্দুত্ববাদী শক্তি, কিভাবে মুসলমানদের উপর আর্থিক এবং শারীরিক আর,অবশ্যই সামাজিক যে অত্যাচার চলছে তা নিয়ে সোচ্চার হয়েছে।
সংখ্যালঘু  সমাজের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রায় সব কটি অবিজেপি রাজনৈতিক দলই বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় ,নির্বাচনী ইস্যু হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন পর্ব মিটে যাওয়ার অব্যবহিত পরে, গোটা ভারত জুড়ে মুসলমানদের উপরে যে অত্যাচারের স্টিম রোলার  চালাচ্ছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। সে সম্পর্কে আরও সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। সহ নাগরিক সংখ্যালঘুরা কেমন আছেন, বেঁচে থাকার মতো সামাজিক পরিবেশ তাঁদের সামনে রয়েছে কিনা, দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাওয়ার মতো পরিস্থিতি তাঁদের জন্য রয়েছে কিনা তা নিয়ে বামপন্থীরা যেমন সরব তেমনই সকলকেই সোচ্চার হতে হবে, রাজনৈতিক পরিসর ছাড়িয়ে নাগরিক সমাজকেও প্রতিবাদী হতে হবে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের নিজের রাজ্য গুজরাটের ভাদুদারাতে মুখ্যমন্ত্রী আবাসন প্রকল্পে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য যে ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে সেই ফ্ল্যাট যাতে কোনও অবস্থাতেই মুসলমান সমাজের কাউকে না দেওয়া হয় তার জন্য গোটা ভাদোদরা জুড়ে একটা সামাজিক প্রচার চালাচ্ছে সঙ্গ পরিবার। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য তৈরি হওয়া ভাদো তারার ওই ফ্ল্যাটের আশপাশের হিন্দু সমাজের লোকজনকে খেপিয়ে তুলছে। হিমাচল প্রদেশের নাহানে এক মুসলমান নাকি পবিত্র ঈদুজ্জোয়  কুরবানি দিয়েছিল এই অভিযোগ তুলে তার দোকান লুট করা হয় ভাঙচুর করা হয়। তার বাড়ি দোকান লুট করা হলো,  যার বাড়ি ভাঙচুর করা হলো সেই মুসলমান ব্যক্তিটির বিরুদ্ধেই হিমাচল প্রদেশের সরকার গোহত্যার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেছে। এখানেই শেষ নয়, নাহান সহ সেই এলাকার ১৬ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দোকানদারকে বাধ্য করা হয়েছে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে এই মানুষগুলি এখন রুটি-রুজি এবং আশ্রয়হীন হিসাবে হয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে। ভারতের রাজনীতি রাজধানী দিল্লির সঙ্গম বিহার এলাকাতেও ভোটের পরে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। ভয়াবহ উসকানিমূলক প্রচারের ফলে ওই এলাকা ছেড়ে বহু বাসিন্দা চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। গোটা ব্যাপারটি পরিচালনা করেছে আরএসএস’র ছত্রছায়ায় থাকা নানা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এভাবেই গোটা ভারত জুড়ে নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর সহ নাগরিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের শায়েস্তা করতে নতুন কৌশলে নেমে পড়েছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। এই বিষয়গুলি এখনো মূল ধারার প্রচার মাধ্যমে তেমনভাবে উঠে আসছে না। সমাজকর্মীরাও এখনো পর্যন্ত গোটা ব্যাপারটিকে ঘিরে সেভাবে সরব হননি। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে আরএসএস-বিজেপি-কে জনবিচ্ছিন্ন করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও বিক্ল্প নেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment