social justice and Hindutva

ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার

জাতীয় উত্তর সম্পাদকীয়​

অলকেশ দাস


জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া
সদ্য বিধানসভা নির্বাচনে তিন রাজ্যে বিজেপির জয়ে আত্মহারা মোদী ।  বিজয়ের পর মোদীর সবচেয়ে সদম্ভ উক্তি হচ্ছে যে বিরোধীরা নির্বাচনের সময়  জাতপাতের ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করার চেষ্টা করেছিল। তা তিনি নাকি রোধ করেছেন। ইঙ্গিত জাতি ভিত্তিক জনগণনার দাবির প্রতি, শ্লেষ  আর্থ-সামাজিক জনসমীক্ষার দাবির প্রতি।  মোদীর মতে চারটি কেবল জাতি। নারী ,যুবক ,কৃষক এবং দরিদ্র। তিনি নাকি এদেরই কেবল ক্ষমতায়ন চান। সত্যিই কি তাই? ভোটের অভিধানে আরএসএস ,বিজেপি যুক্ত করেছে নতুন বাক্যালঙ্কার। মাইক্রো লেভেল সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ধরা যাক গত বছরের উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। উত্তরপ্রদেশের ওবিসি মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ। ভোটের দিকে তাকিয়ে মোট ৫৪টি জাতিকে নতুন করে ওবিসিভুক্ত করবার প্রক্রিয়া গ্রহণ করে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার। 'লোধা' উত্তরপ্রদেশে ওবিসি। জনসংখ্যার ৫ শতাংশ। সঙ্গে সঙ্গে ভোট পাওয়ার জন্য লোধা সম্প্রদায় থেকে একজনকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করে দেওয়া হয়। 'কুর্মি' উত্তরপ্রদেশে ওবিসি। জনসংখ্যার ৭ শতাংশ। রাজ্যের ৫০টা বিধানসভা কেন্দ্রে কুর্মীদের প্রভাব। রাজ্যের বিজেপির সভাপতিটাও সেইজন্যে মাথা খাটিয়ে 'কুর্মী' সম্প্রদায়ের লোককেই করার সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ করা হয় উত্তরপ্রদেশের তিনজনকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য। তিনজনই ওবিসি ভুক্ত। উত্তরপ্রদেশে তার আগের বিধানসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টির ওবিসি ভোটে থাবা বসিয়েছিল বিজেপি। সেখানেও ছিল এক সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং। যাদব ছাড়া অন্য ওবিসি ভুক্তদের লক্ষ্যবস্তু করা। তখন অযাদব ওবিসিদের ভোট বিজেপি পেয়েছিল ৫৮ শতাংশ। সেই ভোট সমাজবাদী পার্টির কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ২০ শতাংশ। সেইজন্যে শুধু ওবিসি নয়, তার ভাগাভাগির দিকে তীক্ষ্ণ নজর বিজেপির। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বলল যে তেলেঙ্গানায় যদি দল জেতে তাহলে  মুখ্যমন্ত্রী হবে একজন ওবিসি? তাহলে কারা জাত নিয়ে রাজনীতি করে? কারা ক্ষমতা দখলের জন্য জাতপাতকে ব্যবহার করে? যদি এ রাজ্যের চিত্র দেখি তাহলে বিজেপি এখানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করেছে চার জনকে। এর আগে মন্ত্রী ছিলেন রায়গঞ্জের দেবশ্রী চৌধুরি ও আসানসোলের বাবুল সুপ্রিয় আসলে বাবুল বড়াল। দুজনেই সাধারণ জাতিভুক্ত। জাতের অঙ্কে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পর দুজনকেই ঝেড়ে ফেলা হয়। মন্ত্রী করা হয় শান্তনু ঠাকুরকে। লক্ষ্য মতুয়া ভোট। রাজ্যের  জন অংশের ২৩.৩ শতাংশ তফসিলিদের মধ্যে ১৭ শতাংশ নমঃশূদ্র। বিজেপি সেই ভোট দখল করার লক্ষ্যে এগয়। মন্ত্রী হন কোচবিহারের নিশিথ প্রামাণিক। রাজবংশী।রাজ্যের  জন অংশের ২৩.৩ শতাংশ তফসিলিদের মধ্যে ১৮ শতাংশ রাজবংশী। সেই ভোটকে আকর্ষণের জন্য অঙ্ক তৈরি হয়। মন্ত্রী হন আর একজন। জন বার্লো। আদিবাসী। রাজ্যের ৫.৮ শতাংশ আদিবাসীদের কাছে বার্তা দেওয়ার জন্য । চতুর্থ জন সুভাষ সরকার। বাঁকুড়ার এই সাংসদকে মন্ত্রী করা হয়েছে জঙ্গলমহল অংকে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করা হচ্ছে জাত পাতের অঙ্কে! যদি শুধু গরিব মানুষই মোদীর কাছে জাত হয় তাহলে তফসিলি জাতিভুক্ত রামনাথ কোবিন্দকে দেশের চতুর্দশ রাষ্ট্রপতি করবার পর কেন মোদী আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন? কেন জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে দ্যাখো আমরা একজন দলিতকে রাষ্ট্রপতি বানালাম। সেটা কি ভোটের অঙ্ক ছিল না?  দেশের এখনকার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। আদিবাসী। তাকে রাষ্ট্রপতি করবার পর সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি সারাদেশে প্রচার করার চেষ্টা করেনি যে আমরাই প্রথম একজন আদিবাসীকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসালাম। হিমাচল প্রদেশ এবং কর্নাটকে বিধানসভা ভোটে হারার পর বিজেপি কি আক্ষেপ করেনি যে আদিবাসী রাষ্ট্রপতি করেও এই দুই রাজ্যে আদিবাসী ভোট বিজেপির পক্ষে টানা গেল না।২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে মোদীকে কি প্রোজেক্ট করা হয়নি একজন ওবিসি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে। ছত্রিশগড়ে প্রথম আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রী করেছে বিজেপি। উপমুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে ওবিসি তিলি সম্প্রদায়ের একজনকে। মধ্যপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে একজন ওবিসি যাদব সম্প্রদায়ের মানুষকে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের লোহিয়াবাদী ও হিন্দুত্ব বিরোধী রাজনীতির মানুষকে টানার জন্যে। এখানে একজন উপ মুখ্যমন্ত্রী দলিত এবং আর একজন ব্রাহ্মণ। আবার নিজেদের স্বধর্ম উচ্চবর্ণকে ধরে রাখতে রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে একজন উচ্চবর্ণের মানুষকে। এখানেও ভোট শতাংশ ধরে রাখার জন্য উপমুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে একজন দলিত এবং আর একজন রাজপুতকে। কেন মধ্যপ্রদেশে বিজেপি তার ওবিসিভুক্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এসপি বাঘেলকে পাঠালো ওবিসিদের মধ্যে তাদের প্রভাবকে শক্তিশালী করতে? এগুলো জাতের রাজনীতি নয়? যদি জাতির জনসংখ্যার সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি জাতপাত রাজনীতি হয় তাহলে লোকসভায় অমিত শাহ এ'কথা বললেন কেন যে  তাদের মোট সাংসদের ২৯ শতাংশ অর্থাৎ ৮৫ জন সাংসদ ওবিসি জাতিভুক্ত। কেন বললেন যে তাদের ১৩১৮ জন এমএলএ দের ২৭ শতাংশ অর্থাৎ ৩৬৫ জন ওবিসি জাতিভুক্ত। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে বিহারের জাতি গণনার প্রথম দফার ফল প্রকাশিত হওয়ার পরেই বিজেপি তার অবস্থানের থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। জন চাঞ্চল্যের পারদ উপরে উঠছে দেখে তারা ঘোষণা করে তারাও জাতি গণনা করতে চায়। তারা কখনো জাতি গণনার বিরোধিতা করেনি। আরো একটু এগিয়ে বলে যে তারা একটি ওবিসি সমীক্ষাও সংগঠিত করবে। বিহারের বিজেপি নেতা এই জাতিগণনার কৃতিত্ব তাদের বলে দাবি করে। তারা বলতে শুরু করে যে তারা যখন নীতিশ মন্ত্রিসভায় ছিল তখনই এই জাতিগণনার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। মুখ্যমন্ত্রী  নীতিশ কুমার যখন জাতি গণনার ফল অনুযায়ী সমানুপাতিত্ব বজায় রাখতে সংরক্ষণ ৭৫ শতাংশে উন্নীত করে তখনো বেগতিক দেখে বিজেপি তাকে সমর্থন জানায়। অথচ এই বিজেপি বিহারের আর্থ-সামাজিক জাতি সমীক্ষাকে আটকানোর জন্য উচ্চ আদালতে এফিডেভিট দিয়ে বলেছিল যে এটা কেন্দ্রের এক্তিয়ার। সেন্সাস অ্যাক্ট কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারকেই জনগণনার জন্য ক্ষমতা দিয়েছে। জাতিগণনা হলে বর্ণভিত্তিক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। তাহলে সংসদীয় ক্ষমতা আর জাতের রসায়ন  নিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল ও বহুরূপী বিজেপি নয় কি?

সামাজিক পুঁজি: রাজনৈতিক ফায়দা 
বিজেপি অনেক সময় বলতে চায় আসলে তারা পিছড়ে বর্গের ক্ষমতায়ণ চায়। কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না যে পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে তারা সর্বাংশে ব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে। বিজেপির তাত্ত্বিক নেতা গোবিন্দাচার্য বিজেপির এই প্রয়াসকে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল কম প্রাধান্য পাওয়া কাস্ট এবং সাবকাস্টগুলি। অর্থাৎ চালু জাতভিত্তিক রাজনীতির যে ধারা সেই ধারার পরিবর্তে জাতভিত্তিক রাজনীতির অন্য এক ধারা। আসলে ধারণাটা 'সমগ্র হিন্দুত্ব'র। যেখানে ওবিসি এবং তফসিলি জাতিভুক্তদের হিন্দুত্বের বন্ধনে নিয়ে আসা হবে।তাই বিজেপি তার রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য প্রথমে চিহ্নিত করে জনগণের অসন্তোষের প্রকৃতিগুলি। তারপর দেখে এই অসন্তোষের বিষয়ে দলিত এবং ওবিসিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলিকে। যখনই দেখে এদের মধ্যে আধিপত্যকারী প্রভাবশালী অংশের উপর অন্য সাবকাস্টগুলির অসন্তোষ বিরাজমান তখনই সেই ব্যবধানের মধ্যে বিজেপি ঢুকে পড়ে ওই সাবকাস্টগুলির প্রতিনিধিত্ব করা শুরু করে। যেমন ওবিসিদের মধ্যে প্রাধান্যকারী সাবকাস্ট যাদব। দলিতদের মধ্যে জাতভ। এইভাবে সন্তর্পণে, সুকৌশলে নতুন সামাজিক জোট বুনে চলে আরএসএস।  অনন্যভাবে তৈরি এই সামাজিক পুঁজি থেকে তুলে নেয় রাজনৈতিক ফায়দা।

সংরক্ষণ বিরোধী মোদীর হাতেই উচ্চবর্ণীয়দের সংরক্ষণ !
গত লোকসভা ভোটে বিজয়ের পর টিভি চ্যানেলগুলোতে মোদীর সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছিল 'নতুন শতাব্দীর নতুন ন্যারেটিভ' এর কথা। বলেছিলেন যে দেশে দুটো জাতি থাকবে। একটা গরিব। অন্যটা যারা দেশের দারিদ্র দূর করবার জন্য অবদান রাখবে।  বলেছিলেন প্রান্তিক অংশের নেতারা যারা নির্বাচনে সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে লড়াই করে তারা আর জাতি কেন্দ্রিক ইস্যু তুলতে পারবেন না। আসলে তিনি সংরক্ষণের ইস্যুর  কথা বলতে চেয়েছিলেন।  অথচ এই মোদী সংসদে সংরক্ষণের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তবে সেটা পুরোপুরি উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ। মুখে বলেছিলেন অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণ। অথচ অর্থনৈতিক দুর্বলতরের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন ন্যূনতম মাসিক আয় ৬৬,৬৬৬ টাকা আয় ইত্যাদির ভিত্তিতে। লক্ষ্য ছিল উচ্চবর্ণের ভোট। লোকসভার ভোটে তা কুড়োতে মোদীদের বেগ পেতে হয়নি। যেমন উত্তরপ্রদেশের ২২ শতাংশ উচ্চ বর্ণের ভোটের সিংহভাগ ঢুকেছিল বিজেপির পকেটে। তফসিলি জাতি, আদিবাসী জনসংখ্যা নির্ধারণ করা যায় জনগণনার ভিত্তিতে। ওবিসি জনসংখ্যা নির্ধারিত হয়েছিল মণ্ডল কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। কিন্তু উচ্চবর্ণের জনসংখ্যা কোন বিধিবদ্ধ ব্যবস্থায় নির্ণীত হয়নি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে ১০ শতাংশ উচ্চবর্ণের সংরক্ষণের ব্যবস্থা মোদী ঘোষণা করলেন ? ৫২ শতাংশ ওবিসিদের ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সংরক্ষণের পঞ্চাশ শতাংশ সিলিংকে বজায় রাখার জন্য। তাহলে উচ্চবর্ণের সংরক্ষণের ১০ শতাংশের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সেই সিলিং ভাঙা হলো কেন? তাহলে ওবিসিরা যদি এখন তাদের জন শতাংশ অনুযায়ী সংরক্ষণ চায় তাকে জাত পাতের রাজনীতি বলা হবে কেন? স্বাধীনতার পরে মোদী এই প্রথম চালু করলেন উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ। তাহলে তিনি কি করে বলতে পারেন যে স্বাধীনতার পরে যখন কোনও জাতি গণনা হয়নি তখন এবারও তা হবে না।

জাতিগণনার দাবি আকাশ ফুঁড়ে নেমে আসেনি
মোদী জানেন অথবা ইচ্ছা করে জানেন না যে এদেশে জনগণনা শুরু হয় ১৮৭২ সালে। ১৮৮১ সাল থেকে জনগণনা হয় প্রতি ১০ বছর ব্যবধানে। দেশের প্রথম জনগণনা থেকে ১৯৩১ সালের জনগণনা অবধি জাতিভিত্তিক জনগণনা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনোত্তর ভারতে ১৯৫১'র প্রথম  জনগণনা জাতিভিত্তিক হয়নি। তারও কারণ ছিল। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের প্রথম মন্ত্রিসভায় উচ্চবর্ণ জমিদার ও পুঁজিপতিদের আধিক্য ছিল। সেই জন্যই প্রতিশ্রুত ভূমিসংস্কার হয়নি। হয়নি জাতির জনগণনা। তার মানে এই নয় জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি থেমেছিল।১৯৫৫য় কাকা কালেকার কমিশন তার সুপারিশে ১৯৬১ জনগণনায় জাতি এবং নারীকে যুক্ত করতে বলেছিল। মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট গৃহীত হওয়ার পর ১৯৯১ এর জনগণনাকে জাতিভিত্তিক করার জন্য উত্তাল দাবি তৈরি হয়েছিল। ২০০১ এর জনগণনার সময় সেন্সাস রেজিস্টার নিজেই জনগণনাকে জাতিভিত্তিক করার প্রস্তাব দেন। ২০১১ জনগণনার সময় জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি এতটাই তীব্র ছিল যে বাধ্য হয়ে ইউপিএ- টু সরকারকে 'সোশিও ইকোনমিক কাস্ট সেন্সাস ২০১১' এর ঘোষণা করতে হয়। সেই প্রতিবেদন প্রকাশে বাধা দেয় বিজেপি। তা প্রকাশ হলে ঝুলি থেকে দৈত্য বের হয়ে আসত। প্রকাশিত হতো স্বল্প সংখ্যক তথাকথিত উচ্চ বর্ণের সম্পদের পাহাড়। গত লোকসভা নির্বাচনেও ওবিসিদের ৪৪ শতাংশ সমর্থন পাওয়া বিজেপির গাল চুপসে যেত যখন ধরা পড়ত সেই ওবিসিদের জনসংখ্যা এবং সম্পদের মধ্যে বিস্তর বৈষম্য। দলিত এবং আদিবাসীদের থেকে রাষ্ট্রপতি করা এবং তাদের প্রতি নিবেদিত প্রাণ(!) বিজেপি মুষড়ে পড়ত যখন দেখত হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ এরাই। দেশের উচ্চবর্ণের হাতেই ক্ষমতা, উচ্চ অবস্থান, সম্পদ। বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রচার মাধ্যম ইত্যাদি সবকিছুতেই নিয়ন্ত্রণ এবং একচেটিয়াপনা সামাজিক উচ্চবর্ণের। সেখানে দলিত, সংখ্যালঘু, বহুজন একেবারে ক্ষুদ্রাকৃতি তাদের বৃহৎ জনসংখ্যার তুলনায়। এ'সব প্রকাশে ঝুঁকি কেন বিজেপি নিতে যাবে? একই কারণে বিরোধিতা করবে জাতিভিত্তিক জনগণনার কিংবা আর্থ -সামাজিক  জাতি সমীক্ষার।

কাজের বনে মত্ত হস্তীর দাপাদাপি 
যে সংরক্ষণ নিয়ে এত কথা তার উৎস অন্য জায়গায়। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে মোদী সরকারকে সংসদে স্বীকার করতে হয়েছিল স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের শেষ ৪৫ বছরের সেরা বেকারি তার জমানায়। মোদী যখন ক্ষমতায় আসেন তখন দেশে বেকারির হার ৫.৪৪ শতাংশ। এ বছরের অক্টোবর মাস অবধি তা ১০.০৫ শতাংশ। গতবছর ছিল ৭.৩৩ শতাংশ।  যে কারণে দেশের অর্থনৈতিক শিরদাঁড়া মুখ থুবড়ে পড়েছে , নতুন কাজ মুখ দেখেনি, পুরানো কাজ হারিয়েছে মানুষ তা অবশ্যই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, তার ধারাবাহিকতা, নোট বন্দি, জিএসটি’র প্রয়োগ, অতিমারী, মুদ্রাস্ফীতি সর্বোপরি বিকল্পের পথে না হেঁটে নয়া উদার অর্থনৈতিক নীতির কাছে আত্মসমর্পণ। এই সঙ্কটের দায়ভার নিজেরা গ্রহণ না করে তা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া শাসকের পুরানো কৌশল। এরই  একটি সাধারণ জাতির সঙ্গে  তফসিলি, আদিবাসী, ওবিসিদের লড়িয়ে দেওয়া। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রসঙ্গ সংরক্ষণ। সাধারণ জাতির মধ্যে একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়া যেন সব চাকরি এবং শিক্ষার সুযোগ সংরক্ষণের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অংশরা নিয়ে নিল। কিছুই আর পড়ে রইল না সাধারণ জাতির জন্য। সঙ্কট যখন তীব্র হয়, সুযোগ যখন স্বল্প হয় তখন সুযোগ বঞ্চিত মানুষকে এই ধারণার বশবর্তী করতে সুবিধা হয়। আরএসএস, বিজেপি সেই কাজটাই করছে। অথচ সবাই জানে আম্বেদকার প্রণীত সংবিধানে সংরক্ষণের সুযোগ কেবলমাত্র সরকারি চাকরি এবং শিক্ষায়। সেই সরকারি ক্ষেত্র সংকুচিত। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দেদার জলের দরে বিকোচ্ছে। দেশের কাজের ৯৮% অসংগঠিত ক্ষেত্রে। ২ শতাংশ কেবলমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্রে। এদের সবটাই সরকারি ক্ষেত্র নয়। যদি তর্কের খাতিরে ধরি সবটাই সরকারি ক্ষেত্র তাহলে তার মধ্যে অর্ধেক প্রোমোশনের। সেখানে সংরক্ষণের সুযোগ নেই। তাহলে বাকি ১ শতাংশে সংরক্ষণ । সংরক্ষণ আবার সর্বাধিক ৪৯.৫ শতাংশে প্রযোজ্য। তাহলে দাঁড়াচ্ছে মোট কাজের .৪৯৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট। প্রয়োগে দেখা যায় পিছিয়ে পড়া অংশের সংরক্ষণের পদগুলি বছরের পর বছর পড়ে থাকে, পূরণ হয়না। সারা দেশের মোট কাজের ১ শতাংশের এক চতুর্থাংশ (.২৫ শতাংশ)কোন মতে সংরক্ষণে কাজ পায়।অথচ তারই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়- কাজের বনে মত্ত হস্তীর দাপাদাপি হিসাবে!

চালুনি কয় সুচকে......
জাতিভিত্তিক জনগণনা এবং আর্থ- সামাজিক জাতিসমীক্ষা অবশ্যই এক নয়। তবে একই অভিমুখে প্রবাহিত।১৯৩১ এর প্রথম আর্থ-সামাজিক জাতিগণনার লক্ষ্য ছিল বঞ্চনার সূচকগুলি চিহ্নিত করতে গ্রামীণ এবং শহর উভয় ক্ষেত্রেই ভারতীয় পরিবারগুলির অর্থনৈতিক অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করা। এখানে বিভিন্ন বর্ণ গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থার মূল্যায়ন করার জন্য নির্দিষ্ট বর্ণের নামের উপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আর্থ-সামাজিক জাতি-গণনার ব্যক্তিগত তথ্য সরকারি বিভাগগুলি কর্তৃক পরিবারগুলিকে সুবিধা প্রদানের জন্য উন্মুক্ত। আর্থসামাজিক জাতিগণনার এবারের আহ্বান রাজনৈতিক গতিশীলতা পরিবর্তনের জন্য তথ্যের প্রয়োজনে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করতে, সুবিধা বঞ্চিত গোষ্ঠীগুলিকে চিহ্নিত করতে, তাদের নীতি নির্ধারণের সম্মুখে আনতে, সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে জাতিভিত্তিক জনগণনার তথ্য খুবই প্রয়োজন। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বর্ণ ভারতীয় সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যা সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক সুযোগ এবং রাজনৈতিক গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে। এছাড়া আমাদের সংবিধানেও জাতিগণনা পরিচালনার নির্দেশ আছে। জাতিগণনা বা আর্থ-সামাজিক জাতি সমীক্ষার বিরুদ্ধে যুক্তি হল যে এটি বর্ণপ্রথাকে শক্তিশালী করবে। এই দাবির অগ্রভাগে যে সঙ্ঘ পরিবার তারাই এই বর্ণপ্রথার সবচেয়ে বড় সমর্থক। তাদের হিন্দুত্বের মূল বুনিয়াদ মনুবাদের চতুর্বর্ণ। জাতিগণনা নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের আর এক দাবি যে এটি সামাজিক বিভাজন আরো তীব্র করবে। ইতিমধ্যেই আলোচিত যে কিভাবে সামাজিক বিভাজনের প্রকৌশলের মাধ্যমে তারা নির্বাচনগুলিতে অগ্রসর হচ্ছে।

বৈষম্যের পাহাড়ে গাঢ় অন্ধকার
মনুবাদী নীতিতে অগ্রসরমান আরএসএস বিজেপি আসলে উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিত্বকারী। তাদেরই নেতৃত্বে  সমাজের কি ভয়ঙ্কর বৈষম্য বর্ধমান সেই সত্যকেই চাপা দিতে চাইছে তারা। যেমন গত শতকের ছয়ের দশক থেকে এই শতকের প্রথম দশক অবধি ৫ দশকে দরিদ্রতমদের শীর্ষে আদিবাসী ও তার পরেই তফসিলি ও তারপরে ওবিসিরা। আবার ধনীতমদের সর্বনিম্নে আদিবাসী, তার উপরে তফসিলি, তার উপরে ওবিসিরা। দেশের ৪৫% সম্পদ জনসংখ্যায় ২১ শতাংশ  তথাকথিত উচ্চবর্ণীয়দের হাতে। ৫২ শতাংশ জনসংখ্যার ওবিসিদের হাতে দেশের ৩১ শতাংশ সম্পদ। ১৬.৬ শতাংশ তফসিলীদের হাতে ৭ শতাংশ সম্পদ।গড়ে পরিবার পিছু সম্পদের মূল্য দেশে ১৫ লক্ষ টাকা। উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে তা ২৯ লক্ষ, ওবিসিদের ক্ষেত্রে ১৩ লক্ষ, তফসিলি পরিবারের ক্ষেত্রে ৬ লক্ষ। মাথাপিছু আয় গড়ে দেশে ১৬৪৫ টাকা। উচ্চবর্ণীয়দের ক্ষেত্রে তা ২৪১৩ টাকা, ওবিসিদের ক্ষেত্রে ১৫৩১ টাকা, তফসিলিদের ক্ষেত্রে ১২৯৪ টাকা। ২০১২ সালে সরকারি হিসাবে গড়ে দেশে ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্রে ছিল। সেই দারিদ্র বিস্তৃত ছিল উচ্চ বর্ণীয়দের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ, ওবিসিদের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, তফসিলিদের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ। দেশের ৪৮ শতাংশ মানুষের বাড়িতে স্নানের জায়গা নেই। তফসিলিদের মধ্যে এ'রকম ৬৪ শতাংশ , ওবিসিদের মধ্যে ৫০ শতাংশ, উচ্চ বর্ণীয়দের ২৬ শতাংশ। বিহারের জাতি সমীক্ষায় এইরকমই চিত্র বেরিয়ে এসেছে। সমাজের সর্বক্ষেত্রে যারা প্রাধান্যকারী সেই ব্রাহ্মণ ,রাজপুত, ভূমিহার , কায়স্থ জাতির সম্মিলিত জনসংখ্যা ১০.৫৬ শতাংশ। উচ্চবর্ণের মানুষের জনসংখ্যা ১৫.৫ শতাংশ। এর বাইরে প্রান্তিক অংশের মানুষের সংখ্যা ৮৪ শতাংশ। জাতি সমীক্ষায় ওবিসি সংখ্যা নির্ণীত হয়েছে ৬৩.১৫ শতাংশ। তাদের জন্য ৩৪ শতাংশ সংরক্ষণ  ছিল । উল্টোদিকে ১৫.৫২ শতাংশ জনসংখ্যার উচ্চবর্ণদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত সংরক্ষণ ছিল ১০ শতাংশ। প্রতিকারমুলক ব্যবস্থা হিসেবে বিহার সরকার তফসিলীদের ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০, ইবিসি(২৫) ও বিসি(১৮)দের যুক্তভাবে ৩৪ থেকে ৪৩ , আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ১ থেকে ২ শতাংশে সংরক্ষণ  বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ বিহারে সংরক্ষণ ৬০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭৫ শতাংশে। জাতি সমীক্ষা অন্য রাজ্যে সংঘটিত হলে কমবেশি এই ধরনের চিত্রই সামনে চলে আসবে।

ভেসে যাওয়া ছাপিয়ে যাওয়ার তত্ত্ব 
বিহারের জাতি সমীক্ষায় আর এক তথ্য বিজেপির সামনে বিপর্যয়কর হিসাবে নেমে এসেছে। যেমন ১৯৩১ সালের জনগণনায় বিহারে মুসলিম সংখ্যা ছিল ১৪.৬ শতাংশ। প্রায় ১০০ বছর পরে এই ২০২৩ সালে জাতি সমীক্ষায় মুসলিম সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭.৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ১০০ বছরে মুসলিম বেড়েছে ৩.১ শতাংশ। এবং এদের বেশিরভাগটাই অতিরিক্ত পশ্চাৎপদ অর্থাৎ ইবিসি অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৮ শতাংশ। হিন্দুদের তুলনায় কম। এতে দুটো জিনিস প্রমাণিত হলো। মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে দ্রুত ছাপিয়ে যাওয়ার বিজেপির রটনা মিথ্যে। মুসলিমদের তোষণের তত্ত্ব এবং তাদের কল্পিত সমৃদ্ধির বিজেপির গল্পও আষাঢ়ে। সবচেয়ে বড় ধাক্কা বিজেপির ৮১ শতাংশ হিন্দুত্বের ঐক্যের ধারনায়। সব হিন্দু এক হও-এই আহবানে ছিল মুসলিমদের প্রতি তীব্র সাম্প্রদায়িক ঘৃণা সৃষ্টির কৌশল। তফসিলি, আদিবাসী, ওবিসি যখন  দেখবে জনসংখ্যা অনুযায়ী সম্পদ, ক্ষমতায় তাদের পশ্চাৎপদ অবস্থান , উচ্চবর্ণের সঙ্গে  বৈষম্য যা সঙ্ঘ পরিবারের গত ১০ বছরের জমানায় শুধু বেড়েই গেছে তখন সে কেন বিজেপির পাতা ফাঁদ 'হিন্দুত্বে অন্তর্ভুক্তিকরণ' এ যুক্ত হবে? এরাজ্যের সরকারও জাতিগণনার বিরোধিতা করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মুখে বলেছিলেন সম্প্রদায়গত রাজ্যে সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী মাহিষ্যদের ওবিসিভূক্ত করবেন। সঙ্গে ছিল সাহা, তিলি, তাম্বুলি। তা করার জন্য যে প্রক্রিয়া গ্রহণ করা দরকার মুখ্যমন্ত্রী সে পথে হাঁটেননি। সমান তালে চলছে, বিজেপি ও তৃণমূলের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিভিত্তিক নির্বাচনী অংক।

সামাজিক ন্যায়ের মোকাবিলায় হিন্দুত্ব
একদিকে সামাজিক ন্যায়ের জন্য দেশব্যাপী আন্দোলন অন্যদিকে হিন্দুত্বের রাষ্ট্রীয় পোষণায় আগ্রাসন। 'যিতনি আবাদী উতনা হক' অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক অংশীদারিত্বের দাবি হিন্দুত্বের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্রিশগড়, তেলেঙ্গানা-এই চার রাজ্যের তিনটিতে বিজেপি জিতেছে। কিন্তু মোট ভোটে কংগ্রেসের চেয়ে ৯ লক্ষ ৪০ হাজার ১৩৭ ভোট কম পেয়েছে। সুতরাং যত গর্জাচ্ছে তত বর্ষা হচ্ছে না। নয় এর দশকে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ গৃহীত হওয়ার পর আদবানীর সাম্প্রদায়িক রথযাত্রা রক্ত ঝরিয়ে ছিল। সামাজিক ন্যায়ের মোকাবিলায় সেটাই ছিল হিন্দুত্বের অস্ত্র। এবারের সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনের মোকাবিলায় গীতা পাঠ থেকে শুরু করে রামমন্দির। ধর্মীয় আবরণে গোটা দেশকে মুড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনের অভিমুখ তৈরি হচ্ছে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীদের। মোকাবিলার রাস্তাকে চওড়া করতে হবে আদর্শের ভিতকে শক্তপোক্ত করে। পিছনের সাথীদের সামনে টেনে নাও... দুয়ার বন্ধ করে যারা কাঁদছে তাদের একবার ডেকে নাও।
 

Comments :0

Login to leave a comment