ময়ূখ বিশ্বাস
ভারতের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম বারের জন্য ১৬টার বেশি ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদের রাস্তায় নেমেছে। ক্যাম্পাস থেকে রাজপথে আমাদের বার্তা -শিক্ষা এবং দেশ বাঁচাতে হবে। লক্ষ্য জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করা এবং দেশ থেকে ছাত্র বিরোধী সাম্প্রদায়িক-কর্পোরেটের প্লে-বয় এই ছাত্র বিরোধী বিজেপি সরকারকে হটানো। তাই তো এক সময়ের নয়া উদারনীতির সওয়াল করা ছাত্র সংগঠনগুলিও ঠ্যালা বুঝছে। আমাদের সাথে এসেছে। কারণ সংগঠন করা তো দূর, কেন্দ্রের এই ফ্যাসিস্ত সরকার থাকলে আমাদের আগামী প্রজন্মই শেষ হয়ে যাবে।
কিছুদিন আগে মুম্বাইয়ে আম্বানিদের স্কুল, 'ধীরুভাই ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে'র বার্ষিক অনুষ্ঠানের ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছে। ভালো হয়েছে। কিন্তু এ স্বপ্ন তো দেশের সব অবিভাবকদের ও পড়ুয়াদের। আমরা চাই এইরকম ইভেন্ট বানারহাটের রেড ব্যাঙ্কের বন্ধ বাগানের স্কুল বা হিমালয়ের কোণে চাম্বার কলেজেও হোক। আম্বানিদের স্কুলে দেশের নামীদামি সেলিব্রিটিদের ছেলেমেয়েরা সেখানে সেরা শিক্ষাটা পায়। পড়তে গেলে গুনে গুনে মাইনে বছরে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। (জিও বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ভরতুকি দিয়েছে ১০ হাজার কোটি, আমি জানি না আমার আপনার পাড়ার স্কুল কলেজে কতো!)
কিন্তু এসএফআই’র সেই অপ্রিয় প্রশ্ন কেতাদুরস্ত শাসক ও তাঁর ইয়েসম্যানদের প্রতি। শিক্ষাটা কাদের হবে? আর এই আম্বানি মডেলই কি নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির মডেল? মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকেই শিক্ষাকে এক নম্বর দুশমন হিসাবে টার্গেট করেছে। প্রত্যেকদিন শিক্ষায় কমেছে বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ। সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া তফসিলি জাতি, উপজাতি, আদিবাসী,ওবিসি ছাত্রদের জন্য প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রি ম্যাট্রিক স্কলারশিপ প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে ১২০০০ কোটি টাকার এরোপ্লেন চড়া নরেন্দ্র মোদী। সংখ্যালঘুদের জন্য এমএএনএফ স্কলারশিপের ব্যয় বরাদ্দ বন্ধ হয়েছে। ভয়াবহভাবে বন্ধ হয়েছে বিপুল সংখ্যায় স্কুল। বাংলা থেকে মধ্য প্রদেশ সর্বত্র। Unified District Information on School Education (UDISE+) এর ২০২২ রিপোর্ট বলছে ভারতে ১৪,৮৯,১১৫ টি স্কুল আছে। কিন্তু ২০১৪ সালের তুলনা অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকেই স্কুলের সংখ্যা কমেছে। ২০১৮-১৯ সালে ১০,৮৩,৬৭৮ টি সরকারি স্কুল ছিল। ২০২১-২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১০,২২,৩৮৬। সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত স্কুল ২০১৮-১৯ সালে ছিল ৮৪,৬১৪ টি এবং ২০২১-২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮২,৪৮০ তে। অপরদিকে এই সময়ে রমরমিয়ে বেড়েছে বেসরকারি স্কুল। ৩,২৫,৭৬০ থেকে তা বেড়ে হয়েছে ৩,৩৫,৮৪৪। সাথে সোনার পাথরবাটি হয়ে যাচ্ছে মিড ডে মিল।
আমরা এতোদিন জানতাম, শিক্ষা একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। শিক্ষা পণ্য নয়, পরিষেবা নয়। প্রত্যেক নাগরিককে শিক্ষার আওতায় আনবার জন্য সরকার দায়বদ্ধ। যারা পয়সা দিতে অপারগ, তাদের বিনাপয়সায় শিক্ষার আওতায় আনতে সরকার দায়বদ্ধ। কিন্তু আর সবকিছুর মতো বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি এই শিক্ষা ক্ষেত্রেও মুনাফার কথা বলছে। তারা বেঁধে দিচ্ছে নির্দিষ্ট ছাত্র সংখ্যা। তার কম হলে স্কুলগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। হিমাচলের প্রত্যন্ত পাহাড় অথবা বাংলার জঙ্গলমহলের ছোট গ্রাম, যেখানে ছাত্র সংখ্যা এমনিতেই কম। যখন দেখা যাচ্ছে, ছাত্র সংখ্যার অভাবে এই গ্রামগুলোর প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্কুলগুলো আর লাভজনক থাকবে না বিজেপি’র মডেল অনুসারে। ফলে সেই প্রান্তিক গ্রামের ছাত্ররা শিক্ষাব্যবস্থার আওতার বাইরে চলে যাবেন। বড় অংশ আদিবাসী এবং তফসিলি জাতির পড়ুয়ারা।
এরসাথে বাড়ছে জীবন যন্ত্রণা। তৃণমূল রাজে বাংলাতে ২০২৩ সালে মাধ্যমিকে কমল ৪ লাখ পড়ুয়া। কাট অফ কমিয়েও বিজ্ঞান বিভাগ গুলো ফাঁকা পড়ে থাকছে। তাই তো মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের দিনই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ এক ধাক্কায় একাদশে পড়ুয়া ভর্তি ৪৫ শতাংশ বাড়িয়ে স্কুল-পিছু ৪০০ জন করেছিল। একই সঙ্গে বিজ্ঞানে ভর্তিতে আরও বেশি ছাত্র-ছাত্রীকে উৎসাহিত করতে মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরের কাট অফ মার্কস ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশও করেছিল সংসদ। তাও পড়ুয়া খুঁজে পাচ্ছে না। বিজ্ঞান পড়ানোর যোগ্য শিক্ষকই নেই বহু স্কুলে। সরকার উদাসীন। শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে জেলার স্কুলগুলি। এদিকে শিক্ষায় চলছে দুর্নীতি।
পড়াশোনা তো দূর। মালদা বা মুর্শিদাবাদের ছেলেদের কলেজে ভর্তি হয়েও কাজ খুঁজতে পাড়ি দিতে হচ্ছে ভিন রাজ্যে। 'মেক ইন ইন্ডিয়ার' দেশে কারি রেকর্ড ছুঁয়েছে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা আর ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী শিক্ষিত বেকারের সংখ্যায় গোটা পৃথিবীতে সবথেকে এগিয়ে ভারত। ২০১৭-১৮ সালের পরিসংখ্যান বলছে গ্রামীণ অঞ্চলে ২৬% এবং শহরাঞ্চলের ২০% শিক্ষিত যুবরা কর্মহীন। গোটা দেশে বেকারির হার ২০১১-১২ সালের ছিল ২%। ২০১৭-১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬%। সংখ্যাটা কিন্তু আরো বাড়ছে। একদিকে পরিবারের চাপ, অর্থনৈতিক চাপ, অশুভ প্রতিযোগিতা এবং জাতপাত-ধর্মের নামে বঞ্চনায় পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ভয়াবহভাবে।
ভারত চাঁদে পৌঁছেছে। আর পরিবারের আকাঙ্ক্ষাও হয়েছে আকাশচুম্বি। কিছু জায়গায় ক্লাস ফাইভ থেকেই জয়েন্টের কোচিং ক্লাস শুরু হয়ে গেছে যাচ্ছে আইআইটি বা এইমসকে চাঁদমারি করে। পয়সা থাকলে সেরা টিউশন সেন্টার নাহলে 'সিক্সন্থ ফেল' এর অসহায় ছেলেটির দশা। প্রতি বছর প্রায় ছাত্র ভর্তি হয় কোটায় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। আর সবাই সেই সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে পারে না। তাই প্রেসার কুকার ফেটে স্বপ্নের জায়গায় দুঃস্বপ্ন বেরিয়ে পড়ে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০২১ সালে যত ছাত্র আত্মহত্যা করেছে, ৮% কারণ হলো পরীক্ষায় ফেল করা। শুধু গত বছর ২৪ জন পড়ুয়া আত্মহত্যা করেছে কোটাতে। এরা প্রধান কারণ পড়াশুনোর চাপ। কেন্দ্রের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ১.৯৫ লাখ পড়ুয়ার মধ্যে মাত্র ২২% পড়ুয়া পাশ করেছে ২০২৩ সালে। আর অকৃতকার্য পড়ুয়াদের মধ্যে হতাশা বাড়াচ্ছে মানসিক অবসাদ। দেখা যাচ্ছে ২০১১ তুলনায় ৭০% আত্মহত্যা সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ কোচিং শিল্পের রমরমা থামছে না কেন্দ্রের কেন্দ্রীকরণ পরীক্ষা নীতির ফলে। ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি এখন সমস্ত পরীক্ষা নিচ্ছে। মূলত সিবিএসসি এবং আইসিএসসি’র ধাঁচে। ব্রাত্য রাজ্য সরকারি শিক্ষা বোর্ডগুলো। পরীক্ষায় এমসিকিউ প্রশ্নই বেশি আছে। মূলত ইংরেজি এবং হিন্দিকে প্রাধান্য দিলেও অন্যান্য ভাষায় করা হচ্ছে। অনুবাদের মান নিয়ে প্রশ্ন থাক বারবার উঠছে। তামিলনাড়ু সরকার বলছে প্রান্তিক ছাত্ররা এই পরীক্ষা পদ্ধতি বুঝতে পারছে না। ফলে শিক্ষার অঙ্গন থেকে ঝড়ে পড়ছে অসংখ্য প্রতিভা। শুনছি পড়ুয়ারা অভিযোগ করছে নেট পরীক্ষার (প্রাথমিক অধ্যাপক হওয়ার পরীক্ষা) ৫০ শতাংশ উত্তরাবলি ঠিক না। অর্থাৎ বিশাল বড় দুর্নীতি শিক্ষা ক্ষেত্রে বিজেপি করছে কোচিং ব্যবসার মাধ্যমে তা আমরা এখনো ধরতে পারছি না। যতবার ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি পরীক্ষা নিয়েছে ব্যর্থ হয়েছে। কোশ্চেন পেপার আউট হয়েছে। ঠিক যেন মমতা মোদীর ডিগ্রির কম্পিটিশন। ডিগ্রি ফর্ম জর্জিয়া ইউনিভার্সিটি বনাম ইন্টার ডিগ্রি ইন পলিটিকাল সায়েন্স (দুটোই কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি)।
অথচ অনুমান করা হচ্ছে ২০১৮ সাল নাগাদ ভারতে টিউশন শিল্পের বাজার মূল্য হবে ১.৩৪ লক্ষ কোটি। তাই ছাত্ররা মরলো কি বাঁচলো দেশ বেচা সরকারের তাতে কি আসে! আর একটা খবর এই টিউশন ব্যবসা ধরতে নেমে পড়েছে আরএসএস। যদিও গরিব ছাত্রদের জন্যে রাজস্থানের শিকরে (নয়া শিক্ষার হাব) বিকল্প কোচিং-এর ব্যবস্থা করছে এসএফআই’র কমরেডরা।
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংসের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরএসএস’র কর্মীদের ঢোকানো হচ্ছে। বিশ্বভারতী হোক বা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। যোগ্যতা বা মেধা সেখানে বিচার্য নয়। আর রাজ্যের মেধার কেন্দ্রগুলো গৈরিকীকরণ করতে মোদীর হাতিয়ার এখন রাজ্যপাল। সঙ্ঘের আদর্শে অনুপ্রাণিত কেরালার রাজ্যপালের সাথে সরাসরি লড়াইয়ে নেমেছে এসএফআই। লড়াই চলছে অন্যত্রও। যেখানে বাক্ স্বাধীনতা বন্ধ। ছাত্র নির্বাচন বন্ধ। ফর্মুলা ফলো হচ্ছে ত্রিপুরা বা পশ্চিমবঙ্গ সর্বত্র। একটা সময় বিশ্বের অন্যতম সেরা স্নাতক স্তরের পাঠক্রম ছিল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। সেখানে এখন শিক্ষক নেই। সিট কমছে। ফি বাড়ছে ভয়ঙ্করভাবে। যেমন আইটি দিল্লিতে ১১৫ থেকে ১৫০% ফি বেড়েছে। আই আইটি মুম্বাইয়ে ৪৫%। বাংলায় শিক্ষায় খরচ বেড়েছে প্রায় ১৫০%, ২০১১ এর তুলনায়। আন্দোলন তীব্র হয়েছে বারবার। করোনার আগে আমরা জিতেছি। করোনার সুযোগ নিয়ে ওরা ৪৫টা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির মধ্যে কুড়িটাতে বহুগুণ ফি বৃদ্ধি করেছে। আপনি যদি আপনার কলেজ স্কুলে কান পাতেন, তাহলে দেখবেন সেখানেও ফি বৃদ্ধি হয়েছে বহুগুণ।
এদিকে ফান্ড পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শর্ত দিচ্ছে সরকার মহাজনের মতো। সেই গৈরিকীকরণ যদি মেনে নেয় তাহলেই গবেষণা বা অন্যান্য ফান্ড মিলবে। ঠিক যেমন করে বিএসএনএল বা নবরত্ন সংস্থাগুলোকে শেষ করা হয়েছে ভেতর থেকে। একই কায়দায় শেষ করা হচ্ছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এই সুযোগে বাড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা। আগে যারা লোহা লক্কড়, এমনকি মিষ্টির ব্যবসা করতো তেনারা এখন মন দিয়েছে শিক্ষার ব্যবসায়। দেশ-বিদেশ থেকে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর একমাত্র ঠিকানা হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরএসএস’র লোকদের। আমার পরিচিত এক ছাত্র যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিক্স, ফ্রান্সের সোবর্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেষে আইএসআই থেকে পিএইচডি করেও চাকরি পাননি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বাংলার। চপ ভাজার বাংলাতেও ঠাঁই পাননি। একদল ব্যবসায়ী, যারা মূলত এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টাকা দান করেন, তারা একটা গবেষণামূলক কাজও বিচার করেন তাদের পছন্দমত। একটা ছোট্ট উদাহরণ, অশোকা ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক স্তরে কোর্স করতে আপনাকে গুনতে হবে ৩৫ লাখ টাকা। তাহলে বুঝতেই পারছেন ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যা ল এবং অধুনা ডেটা সাইন্স কোর্স করতে আপনাকে কত টাকা খরচ করতে হবে। এখানকার শিক্ষকদের মাইনে আছে, কিন্তু কথা বলার অধিকার নেই, জব সিকিউরিটি নেই এবং গোলামী ভবিতব্য। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বাদ পড়ে বেশিরভাগ ভারতের আসল চিত্র। সত্যি কথা লিখলে বা বললে কাজ হারাতে হয়। তবু এটাই নাকি ভবিষ্যৎ!
আর এই 'মুদ্দে কি বাত' ভুলানোর জন্য ওদের হাতিয়ার ধর্ম। বাজপেয়ী সরকারের আমলের মতো, মোদী জমানাতেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে হিন্দুত্ববাদীদের পরিকল্পিতভাবে বসানো শুরু হয়েছে। শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলির সাম্প্রদায়িকীকরণ কর্মসূচী রূপায়িত করা হচ্ছে। এই কর্মসূচী অনুযায়ী, আর এস এস আর্থিক, শিক্ষা, বিচার (মতাদর্শ), সুরক্ষা, সেবা (পরিষেবা) এবং 'জন' বিষয়ক মোট ছ'টি গোষ্ঠী গঠন করেছে। মোদী মন্ত্রিসভার সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির সদস্যদের সঙ্গে সংঘের নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছে। ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদ থেকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দখল করে নিয়েছে আরএসএস ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসেও বিশেষ অধিবেশন করা হয়েছে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারকে রাজনৈতিক ফয়দা লোটার কাজে লাগাতে। বাদ যাচ্ছে ডারউইনের থিওরি। পিথেগোরাস।পরিবেশ বিদ্যা। মানবাধিকার। বদলানো হচ্ছে আমাদের সিলেবাস। চুপ করে বাদ যাচ্ছে ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবীদের ইতিহাসের সংগ্রাম। বাদ যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রেমচন্দ্রও। পাকিস্তান যেমন করে স্বাধীনতার সংগ্রামকে সিলেবাসে রাখেনি, ইংরেজরা যেমন করে উপনিবেশবাদ কে সিলেবাসে রাখেনি ঠিক তেমনি এরাও বাদ রাখছে মোগল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস।
কারণ আরএসএস এর অবদান ইতিহাসে শূন্য।
ঠিক এই মডেলটাই করেছে জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি, ইজরায়েলের জায়নবাদী নেতাইয়ানহু বা এখনকার তুরস্কের এরদোগানন। আমাদের মনে রাখতে হবে ফ্যাসিবাদের উত্থানের ১০০ বছর হয়েছে ২০২২ সালে। গোটা ইতালি থেকে লোক জোগাড় করে মার্চ টু রোমের ডাক দিয়েছিলেন মুসোলিনি। এদিকে ২০২৫ সালে আরএসএসের ১০০ বছর। এদের ফর্মুলা এক। কাজের ধরন বদলাচ্ছে প্রযুক্তির সাথে। আমাদের তার সঙ্গে পায়ে পা মেলাতে হবে। ভাষা, মেশা, শব্দ চয়ন, পোশাক, রীতি, জীবন ধারণ, লড়াই এর পদ্ধতি সবের সাথে মেলাতে হবে নতুন প্রজন্মকে। প্রান্তিক মানুষকে।আদিবাসী, তপশিলি জাতি, সংখ্যালঘু, মহিলা, প্রান্তিক লিঙ্গ সবাইকে। আমরাই তো প্রান্ত জনের কমরেড। মার্ক্স থেকে ভগৎ সিং এটাই আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। গোটা দুনিয়ায় ছাত্ররা নয়া উদারনীতি,সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। আর্জেন্টিনা থেকে আরামবাগ লড়ছে একসাথে। আমাদের দেশের বেশী চাপ জাতপাত। সাবিত্রী বাই ফুলে থেকে গুরুচাঁদ-হরিচাদ ঠাকুর, বিদ্যাসাগরের এই দেশে চোখরাঙানী দেখালে বিকল্প তৈরী হবেই।
তাই তো নিঃশব্দে তৈরী হচ্ছে এ দেশের পড়ুয়ারা। স্বপ্ন অনেক, আক্রমণ অনেক। তাও। আজ ১২ই জানুয়ারী দিল্লিতে শাসকের মুখের সামনে এসএফআই, এআইএসএফ, পিএসইউ, আইসা, ডিএমকে, ছাত্র রাজদ, সমাজবাদী ছাত্র সভা, পিএসএফ, টিএসইউ,সিআরএলডি, ডিএসএফ, এনএসইউআই, সাত্র মুক্তি সংগ্রাম সমিতি, দ্রাবিডিয়ান স্টুডেন্ট ফেডারেশন, সিওয়াইএসওস,এআইএসবি-র ছাত্র সমাবেশ ও পার্লামেন্ট মার্চ দিল্লিতে। ১লা ফেব্রুয়ারিতে দেশের দক্ষিণে চেন্নাইয়ে আবার। পূর্ব ও পশ্চিম আগে থেকেই আছে। প্রগতিশীলতার অন্যতম ঘাঁটি বাংলা ছাড়া এ লড়াই জেতা যাবে না। আজকেও করোনা কালে ছাত্রদের অভূতপূর্ব লড়াই গোটা দেশ সেলাম করে। সেলাম করে সেই ইনসাফ যাত্রাকে যারা কলকাতা থেকে দিল্লী, তার দ্বিগুণ পথ হেঁটেছে শুধুমাত্র বাংলা বাঁচানোর জন্য।পরিযায়ী শ্রমিক,শিক্ষিত সেই ছেলে মেয়ে যারা ভালো চাকরির প্রত্যাশায় দিন গুনছে তাদের জন্য, শহীদদের জন্য, শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থানের জন্য । এর সাথে ভুলে গেলে চলবে না ছোট্ট ত্রিপুরার আদর্শ গত গুরুত্ব কতখানি তা মোদীর উচ্ছাস প্রকাশ করে । ভারতের অর্থনৈতিক হাবের মুম্বাই জানে খালি পায়ে হাঁটা কিষান আন্দোলনের জোর। মহারাষ্ট্রতেও জোট বাঁধবে। সামিন হন আপনারাও। সময় কম। আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতেই হবে। তাই স্লোগান,
শিক্ষা বাঁচাও। নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি হটাও।
দেশ বাঁচাও। বিজেপি তাড়াও।
Comments :0