SURJYA MISHRA

মানুষের কাছে বারবার ফিরে যাওয়াই তাঁর শিক্ষা

রাজ্য

CPIM LEFT FRONT WEST BENGAL PANCHAYAT ELECTION TMC CORRUPTION

১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসেই জ্যোতি বসু বলেছিলেন, রাইটার্স থেকে সরকার চলবে না। সরকার চালাবেন সাধারণ মানুষ। তার জন্য প্রয়োজন শহর এবং গ্রামের সরকার। সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখেই ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়। 

মঙ্গলবার জ্যোতি বসুর ১৪তম প্রয়াণ দিবসে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ। ‘‘পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা- জ্যোতি বসুর ভাবনা, আজকের দূরবস্থা ও ভবিষ্যতের রূপরেখা’’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমনটাই জানান সিপিআই(এম)’র পলিটব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র।

পূ্র্বতন বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ভূমি সংস্কার এবং পঞ্চায়েতী রাজের পদক্ষেপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ কথা বলেছেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে সারা দেশের মাত্র ৩ শতাংশ জমি রয়েছে। অথচ সারা দেশের ভূমি সংস্কারের ২২ শতাংশ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ভূমি সংস্কারের সুফল পেয়েছিলেন ৩০ লক্ষ পাট্টাদার এবং ১৫ লক্ষ বর্গাদার। ৪৫ লক্ষ একর জমি বন্টন করা হয়েছিল হতদরিদ্র গ্রামীণ জনতার মাঝে। এর সরাসরি সুফল পেয়েছিলেন ২ কোটি ২৫ লক্ষ মানুষ। তৎকালীন সময়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু ছিল না। কিন্তু তারপরেও ৭৩ শতাংশ জমির পাট্টা পেয়েছিলেন তপশিলী জাতি, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু মানুষ। কারণ, এই অংশের মধ্যেই দারিদ্রের প্রকোপ সবথেকে বেশি ছিল। 

পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামীণ জনতার ক্ষমতায়নের আগে জোর দেওয়া হয়েছিল ভূমি সংষ্কারে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হয়েছিল ভূমি সংস্কারের কাজ। এতদিন গ্রামের সমস্ত জমি নির্দিষ্ট কয়েকজনের কুক্ষিগত ছিল। ভূমি সংস্কারের ফলে জমির দখলের বিকেন্দ্রীকরণ হল। ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হলেন। মিলল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।

সেই প্রসঙ্গ টেনে মিশ্র বলেন, রাজ্য বামফ্রন্টের সময়ে ভূমি সংস্কার সারা দেশ এবং বিদেশেও আলোড়ন ফেলে। ভূমিহীন কৃষক, বর্গাদারের হাতে যে জোতদার, জমিদারের বেনামি, বেআইনি জমি তুলে দেওয়া যায় সরকারি ভাবে, তা প্রথম করে দেখিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। এই মডেলের কৃতিত্ব জ্যোতি বসুর। 

মিশ্র বলেন, ভূমি সংস্কারের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন সরকার কেবলমাত্র জমি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। যাঁকে জমি দেওয়া হল, তাঁর কাছে স্বল্প মূল্যে সার, বীজ, সেচের জল ইত্যাদিও পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য সরকার। রাজ্যের বিদ্যুতায়নের জন্যও জ্যোতি বসুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাত্র ১৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হত। ২০১১ সালে সেই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। ২০১১ সালে কয়েকশো মৌজা ছাড়া গোটা রাজ্যের সমস্ত প্রান্তে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। 

মিশ্র বলেন যে জ্যোতি বসুর লক্ষ্য ছিল, রাজ্যের সরকারকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে যতটা সম্ভব সুরাহা পাইয়ে দিতে হবে। যেখানে দেখা যাবে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য কাজে সমস্যা হচ্ছে, সেখানে কেন্দ্রের সঙ্গে লড়তে হবে। ১৯৪৭ সালে বাংলা অন্যতম শিল্পোন্নত প্রদেশ ছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের মাশুল সমীকরণ নীতি এবং লাইসেন্স রাজের জন্য বাংলার শিল্পের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই কেন্দ্রীয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সমমনষ্ক রাজ্যগুলিকে নিয়ে লড়াই চালিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। 

রাজ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। ২০১১ সালে এই গোষ্ঠীগুলির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮৫০০ কোটি টাকারও বেশি। এই ব্যবস্থার সুবিধাপ্রাপকের সংখ্যা ১ কোটিরও বেশি। বামফ্রন্টের সময়কালে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পরিচালিত হত গ্রাম সংসদের মাধ্যমে। ১৮ বছরের ভোটাধিকারের দাবিও উঠে আসে পঞ্চায়েত এবং পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। 

মিশ্র বলেন, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার এই গৌরবের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে তৃণমূলের সরকার চালানোর ১১ বছর। এরা গ্রাম সংসদের বৈঠক করে না। গ্রামে গ্রামে উপভোক্তা এবং প্রকল্প প্রাপকদের নাম প্রকাশ করে না। গোটা পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ছেড়েছে এরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? 

তিনি বলেন, এই প্রশ্নেরও উত্তর লুকিয়ে রয়েছে জ্যোতি বসুর দেখানো পথেই। আমাদের মানুষের কাছে বিকল্প নিয়ে পৌঁছতে হবে। অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা, বিগত দিনের সাফল্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা নিয়ে পৌঁছতে হবে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে ‘অ্যাসেট’ তৈরি করা গিয়েছে। জমি তুলে দেওয়া গিয়েছে। সেখানে লক্ষীর ভান্ডারের মাধ্যমে কোনও ‘অ্যাসেট’ তৈরি হচ্ছে না। 

তাহেরপুরে বামপন্থীরা বিকল্পের হদিস দিতে পেরেছেন বলেই মানুষ তাঁদের ফের একবার ভরসা করেছেন। রাজ্যের অন্যত্রও এখনও বেশ কিছু পঞ্চায়েত চালান বামপন্থীরা। সেখানে সম্ভব হলে বাকি রাজ্যে সম্ভব হবে না কেন? 

আমরা দেখেছি সাক্ষরতা প্রসারের সময় সরকারের থেকেও সাক্ষরতা প্রসার সমিতি এবং পঞ্চায়েতের ভূমিকা বেশি ছিল। বহু ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ এবং সাহায্য ছাড়াই কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, নোয়াম চমস্কিও তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন বিকল্প ‘গভর্ন্যান্সের’ ধারণা। মানুষের জন্য কাজ করতে গেলে সরকারেই থাকতে হবে এই ধারণা ভ্রান্ত। কোভিডের সময়ের নানা রঙের ভলান্টিয়াররা সরকারি সাহায্য ছাড়াই বিকল্প গড়ে দেখিয়েছেন। লাতিন আমেরিকা সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে এই মডেলে কাজ হচ্ছে। নিরন্তর বিকল্প পথের সন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। তারজন্য প্রয়োজন বারংবার মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া। তাঁরা কি বলছে মন দিয়ে শোনা, এবং তাকে আত্মস্থ করা। 

সভায় বক্তব্য রাখছেন সূর্য মিশ্র। ছবি : দিলীপ সেন

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment