লীলা পুরকায়স্থ
আজি নব বসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ,
আজিকার কোন ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব কি পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শত বর্ষ পরে?
১৪০০ সালে লেখা কবির মনের ঐ ভাবনাকে সহস্রকোটি রবীন্দ্র প্রেমিক যে মেনে নিতে পারেননি তা আজকের সমাজচেতনায় আলোকিত বিদ্বজ্জনের অন্তরে অন্তরে তাঁর সেদিনের ভাবনা তাঁদের হৃদয়কে আলোড়িত করে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে সমাজ মানসের চেতনা বিবর্তনের ইতিহাস পুঞ্জিভূত করে রেখে গিয়েছেন, তাকে বাণীমূর্তি দিয়েছেন অমূল্য কাব্য সম্পদে। সমাজের চেতনা যে প্রসার লাভ করবে কবির বিভিন্ন লেখনিতে তা স্পষ্ট। বস্তুত কবির নিজের ভাবনার জগতে সমাজের মানুষ যে বিশেষ ভূমিকায় চর্চিত ছিল, যত তাঁর বয়স বেড়েছে ততই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা প্রকাশ লাভ করেছে। সমাজের আমূল পরিবর্তন যে পৃথিবীর মানব সমাজের পূর্ণ মুক্তি সম্ভব করবে, রবীন্দ্রনাথের দিব্যদৃষ্টি তা লক্ষ্য করেছে।
রবীন্দ্রনাথের নাটক রক্তকরবী আমাদের সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নের সঙ্গে এক অপূর্ব সামঞ্জস্য নিয়ে এসেছে। রক্তকরবী শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নাটক, রঞ্জনের মৃত্যুর পরে নন্দিনীর উক্তি আমাদের প্রণিধান যোগ্য। রঞ্জনের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের নন্দিনীর উক্তি ‘তোমার জয়যাত্রা আজ থেকে শুরু হয়েছে’। বিপ্লবীর মৃত্যু লড়াইয়ের শেষ নয়, লড়াইয়ের সূত্রপাত। নন্দিনীর কথায় রঞ্জনের মৃত্যু হতে পারে না, সে ক্ষেত্রে বলা যায় বিপ্লব ও বিপ্লবীর মৃত্যু নেই। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ রঞ্জনকে উপলক্ষ্য করে বলেছেন তার মৃত্যু বিপ্লবের বাণী বহন করে; এই সত্য প্রতিভাত করছে যে শোষণবাদী সভ্যতার বিরুদ্ধে শ্রমিকের লড়াইয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতই বহন করছে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ধনতন্ত্রের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির শেষ বোঝাপড়ারই আহ্বান এখানে ঘোষিত হয়েছে — এই রক্তকরবী নাটকে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি যে কত বাস্তব ও বস্তুনিষ্ঠ তারই সাক্ষ্য বহন করছে রক্তকরবী নাটক। ড. অজয় কুমার ঘোষ অতি বাস্তবতার পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন রক্তকরবীতে। ডাঃ ঘোষের মতে নানা চুক্তি ও মুক্ত বাণিজ্যের নামে নুতন করে সাম্রাজ্যবাদী বিপদ তথা ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং তাদের দোসর ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেনী সংঘবদ্ধ প্রতিবাদে মুখর হচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী অবশ্যই এক বিরাট প্রেরণার উৎস — একথা স্বীকার করে নিয়ে সমাজকে অনুধাবন করতে হবে। বর্তমান সময়েও রক্তকরবী নাটকের প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি গুরুত্ব নিয়ে বিচার করার প্রয়োজনীয়তা আছে। কথাসাহিত্যিক নারায়ণ চৌধুরি অপসংস্কৃতির সমস্যা নিয়ে যে আলোচনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ বহু বছর আগেই সেই সমস্যা নিয়ে তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেছেন। নারায়ণ চৌধুরি বলেছেন, রাজনীতি ও অর্থনীতি পরস্পর অসম্পর্কিত ব্যাপার নয় দুটোর মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে যতই দূরত্ব আছে বলে মনে হোক না কেন, এ দু’য়ের মধ্যে ভেতরে ভেতরে নিগুঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সমাজের মূল বুনিয়াদ হলো অর্থনীতি, সংস্কৃতি হলো তার উপরতলাকার সৌধ। এই সঙ্গে আমরা নারীজাতির অবস্থান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার উল্লেখ করব। কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা এটা জানে বলেই নানাভাবে সমাজে অপসংস্কৃতি ছড়ানোর চেষ্টা করে এবং নারীসমাজকে নানাভাবে ব্যবহার করতে চায়।
পলাতক কাব্যে রবীন্দ্রনাথের নারী জীবন সম্বন্ধে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ পেয়েছে এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল প্রেরণা আছে বলাকা কাব্যগ্রন্থে। ‘মুক্তি’ও ‘ফাঁকি’কবিতায় উল্লিখিত বধূদের জীবন যে কত কঠিন ছিল, নিজের সত্তাকে প্রকাশ করার কোথাও অধিকার বা সুযোগ ছিল না, একথা স্পষ্ট।
রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ দৃষ্টি সমাজজীবনে সে-কালের মহিলাদের অবস্থা নিয়ে যে ভাবনা প্রকাশ করেছেন, আজকের নারী প্রগতির জয়গানে কেউ কেউ মুখরিত হলেও সেই জীবন থেকে মুক্ত হয়নি মহিলা সমাজ। অনেক ক্ষেত্রেই মহিলারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে নিজেদের সত্তাকে, নিজেদের প্রতিভাকে প্রস্ফূটিত করার কোনও সুযোগ পান না। নারীজীবনের নানা দিক নানা অনুভূতির টানাপোড়েন কতভাবে যে কবির কাব্যে প্রকাশলাভ করেছে — এক জন্মে বোধহয় কোনও সাহিত্য বা সমাজ সচেতন মানুষের পক্ষে তা অনুধাবন করা অসম্ভব। রবীন্দ্রপ্রেমী সাহিত্যিকদের কলমে সবদিক বিচার করা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও আমরা সাহসিনী চিত্রাঙ্গদার কথা উল্লেখ করতে চাই। নারীর যথার্থ স্থান এর মধ্যে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে।
“ আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্র নন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে
পাবে তবে চিনিতে মোরে।’’
সহজাত প্রেমের অনুভূতি চিত্রাঙ্গদার মধ্যে অত্যন্ত প্রবলই ছিল। কিন্তু সেটা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের নয়। কবি চিত্রাঙ্গদার মুখে নারীর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে যা বলেছেন — তা প্রত্যেক নারীর জীবনে সত্য হলে সমাজে যথার্থ সম্মান পাবে নারী।
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ প্রেমের পরিচয় পাই আমরা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্যে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ যখন প্রবল পরাক্রমে দেশের পর দেশে অধিকার বাড়ানোর জন্য ব্যগ্র, তখনই ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলাদেশকে বিভাজিত করার সিদ্ধান্ত নিল। সেই সময় বাংলাকে বিভাজিত করা কোনোমতেই মানা যেতে পারে না, এই আন্দোলন উত্তেজনার সৃষ্টি করল। বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন এক অভিনব ঘটনা। ইংরেজরা কিন্তু অনেক দিনের প্রস্তুতি নিয়েই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যের বিস্তার করে লাভবান হওয়া। পুঁজির সন্ধান ছিল বিশেষ লাভবান হওয়া। এটা তো সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম কৌশল। এই স্বদেশি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালির ইংরেজ বিদ্বেষ। এখানেই আবার রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেমের আর একটি উজ্জ্বল রূপ দেখা গেল। তখন এ সত্য বোঝা কঠিন ছিল যে, এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী ধনবাদ বিকাশের অনিবার্য পরিণাম। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পুরোভাগে রবীন্দ্রনাথ যোগ দেওয়াতে যে আবেগ সৃষ্টি হয়েছিল, মনে হয়েছিল ইংরেজদের পিছু হটতেই হবে। বাস্তবে তাই ঘটেছিল। এই আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য অবদান তাঁর গানে। এই গান বন্যার মতো তরুণ চিত্তকে প্লাবিত করল। ইতিমধ্যে কবির সঙ্গে যে রাজনৈতিক প্রশ্নে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল, সেকথা আলোচনার ক্ষেত্র অন্যত্র।
মানুষের দ্বারা মানুষের নানা ধরনের লাঞ্ছনা কবির অন্তরকে এমনভাবে ব্যথিত করেছিল, তাই রবীন্দ্রনাথ মহাকাল সিংহাসনে সমাসীন বিচারকের কাছে শক্তি চেয়েছিলেন, যাতে মানুষকে লাঞ্ছিত হবার বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য শক্তি পান। মানুষের এই কুৎসিত মানসিকতা কবিকে মর্মাহত করেছিল। তিনি জানতেন মানুষ যখন শুভবুদ্ধি হারিয়ে অন্যকে নিপীড়ন করে লাভবান হয় তখন মনু্ষ্যত্ব তাদের কাছে বিচার্যই নয়, তাই তিনি লিখেছেন
“ নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস—
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে। ”
কিন্তু কবি মানুষের প্রতি মানুষের লাঞ্ছনা দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হতাশাকুল হৃদয়ে তাঁর অনুভূতিকে দূরে সরিয়ে রাখেননি। মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাসকে কোথাও হারিয়ে ফেলেননি। যারা পরদেশ লুণ্ঠন করে সুখী হয়, তারা কোনও চিরস্থায়ী আসনে থাকে না। তাদের পরিচয় কবি মাটির পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন যে শ্রমজীবী মানুষই জগতে চিরস্থায়ী আসনে বেঁচে থাকে।
‘‘ বিপুল জনতা চলে
নানা পথে নানা দলে দলে
যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে
জীবনে মরণে।’’
রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণভাবে জানতে হলে এক জীবনে তা সম্ভব নয়। যদিও কবি বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন
“ আমার কবিতা জানি আমি
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই
সে সর্বত্র গামী। ’’
সেজন্য কবির যে সংশয় শতবর্ষ পরে তাঁর লেখনি কতখানি গুরুত্ব পাবে, রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। তাঁরা কবির ভাবনাকে জীবনের সর্বত্র অনুভব করছেন। সব বেদনার ছবি, কুৎসিত সাম্রাজ্যবাদী লালসা আবার মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রহণ করেছেন। তাঁর ভাবনার শরিক হয়ে নিজের বোধকে শাণিত করছেন, চরিতার্থ করছেন।
Comments :0