শিক্ষাবর্ষ বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্টে মুচলেকা দিয়ে আসা রাজ্যেই কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করার জন্য সরকারের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে শিক্ষকদের!
নিয়োগ দুর্নীতির কারণে এরাজ্যে বিপর্যয়ের মুখে বিদ্যালয় শিক্ষা। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী মিলিয়ে চাকরি বাতিলের সংখ্যা ২৫ হাজার ৭৫২। তাই শিক্ষাবর্ষ বাঁচাতে শীর্ষ আদালতে গিয়ে মুচলেকা দিয়ে এসেছে মধ্যশিক্ষা বোর্ড। আর সেই রাজ্যেই শিক্ষকরা সরকারের কাছে রাজ্যের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে অবিলম্বে ছাত্র ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করার দাবি করছেন। আর সেই দাবির মুখে ঘাপটি মেরে বসে আছে কারিগরি শিক্ষা দপ্তর।
এরাজ্যের চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকরা এখন সরকারের কাছে যোগ্য-অযোগ্যের নথি প্রকাশের দাবি করে আন্দোলনে নেমেছেন। আর সেই রাজ্যের সরকারি পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষক সংগঠন কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে,‘‘২০২৫ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও সম্পন্ন। তাই এখনই হচ্ছে রাজ্যের আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য পলিটেকনিক কলেজগুলির ভর্তির বিজ্ঞাপন দেওয়ার উপযুক্ত সময়।’’ অবিলম্বে ভর্তির বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা জানালেও সরকার নীরব।
সরকার কী চাইছে? ভর্তির ব্যবস্থাকে শিকেয় তুলে দিয়ে কারিগরি শিক্ষা দপ্তর নিয়েছে ‘স্কুল আউটরিচ’ কর্মসূচি। যার মধ্য দিয়ে সরকারি পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষকদের যেতে বলা হয়েছে গ্রাম, শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে ব্যানার টাঙিয়ে পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য অনুরোধ করার কথা বলা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এক শিক্ষক জানান,‘‘ বিদ্যালয়ের অভিভাবকদের মধ্যে ধারণা হচ্ছে, পলিটেকনিক কলেজ উঠে যাবে। তাই শিক্ষকরা চাকরি বাঁচাতে আমাদের ভর্তি করাতে এসেছে। আমাদের ‘ছেলেধরা’ ভাবছেন অভিভাবক থেকে ছাত্ররা!’’
এরাজ্যে সরকারি পলিটেকনিক কলেজে ভর্তির জন্য অতীতে জয়েন্ট এন্ট্রাস বোর্ডের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত হতো জেক্সপো(জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সামিনেশন ফর পলিটেকনিকস)। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে পরীক্ষার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো। ফেব্রুয়ারি মাসে পরীক্ষার জন্য একদফা সতর্কীকরণ করা হতো। তারপর মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্ব মিটে যাওয়ার ১৫ দিন পর মার্চ মাসে নেওয়া হতো পলিটেকনিক পরীক্ষা। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই বের হতো পলিটেকনিক পরীক্ষার রেজাল্ট। ফলে মাধ্যমিক পরীক্ষার পরই ছাত্র-ছাত্রীরা বেছে নিতে পারতো, তারা কারিগরি শিক্ষা অথবা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগকে।
কিন্তু গত তিন বছর ধরে এরাজ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পলিটেকনিকে ভর্তির এন্ট্রান্স পরীক্ষা। এখন এন্ট্রাস বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র মেধা তালিকা তৈরি করে ভর্তির ব্যবস্থা চালু করেছে রাজ্যের কারিগরি শিক্ষা দপ্তর। মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের ওপর ভিত্তি করে মেধা তালিকার মাধ্যমে চালু হয়েছে পলিটেকনিক কলেজের ভর্তির সুযোগ।
কিন্তু সেই ভর্তির বিজ্ঞাপন কখন হচ্ছে ?
কারিগরি শিক্ষা দপ্তর সূত্রের খবর, জুন মাস পার করে তারপর বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। আর ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ করতে সেপ্টেম্বর- অক্টোবর পার হয়ে যাচ্ছে। যার অবধারিত প্রভাব পড়েছে কারিগরি শিক্ষায়। রাজ্যের সরকারি পলিটেকনিক কলেজের এক অধ্যাপক জানিয়েছেন,‘‘ পলিটেকনিক শিক্ষাবর্ষে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে একটি সেমেস্টার। আবার জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত আরও একটি সেমিস্টার। তিন বছরের কোর্সে অতীতে গোটা ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জুলাই মাস থেকে কলেজে পড়াশোনা চালু হয়ে যেত। আর এখন অক্টোবর মাস পার হয়ে গেলেও ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করানো যাচ্ছে না।’’
অথচ তুমুল বেকারিত্বের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার পর চাকরি পাওয়ার সুযোগ এখনও থাকায় এরাজ্যে এখন রমরমিয়ে সরকারি মদতে গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজ। রাজ্যে কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের অধীনে ৭৮টি সরকারি পলিটেকনিক কলেজ। গত ১২-১৩ বছরে তৈরি হয়েছে ৭৮টি বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজ। সমান্তরাল বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজগুলি এখন আগাম টাকার বিনিময়ে ভর্তির আগেই আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছে। ফলে সরকার দেরিতে ভর্তির ব্যবস্থা চালু করা মাত্রই ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হয়ে যাচ্ছে বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজে। কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন,‘‘ সরকারি পলিটেকনিক কলেজে সব মিলিয়ে যখন প্রথম বছরে ২০ হাজার ছাত্রভর্তি হওয়াটাও কঠিন। সেখানে বেসরকারি কলেজে ৪০ হাজার ছাত্রকে ভর্তি করিয়ে নিচ্ছে।’’
তার থেকেও বড় বিপদ ফি বছর সরকারি পলিটেকনিক কলেজ থেকে বাড়ছে ‘ড্রপ আউট’। এন্ট্রাস পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রভর্তি হওয়ার ফলে মেধা ভূমিকা পালন করতো। এখন তা না হওয়াতে সব ধরণের ছাত্র-ছাত্রীরা এসে ভর্তি হলেও পরবর্তী সময়ে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা করতে পারছে না। ফলে দ্রুত বাড়ছে কলেজছুট। প্রায় ৩০ শতাংশ কলেজছুট এখন রাজ্যের সরকারি পলিটেকনিকে।
আসলে এরাজ্যে সরকারি পলিটেকনিক কলেজের হাতে বিপুল পরিমাণ জমি আছে। রাজ্যের সরকারি পলিটেকনিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে সরকারের লক্ষ্য বিপুল জমিকে বিক্রির পথকে খুলে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের সরকারি জমিকে খোলা বাজারে বিক্রি করার নীতি ইতিমধ্যেই গ্রহণ করেছে মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রীসভা। এক আধিকারিকের কথায়,‘‘ রাজ্যের এক একটি পলিটেকনিক কলেজের হাতে ১০ একর থেকে ১৮-২০ একর পর্যন্ত পতিত জমি আছে। সেই জমির মাফজোক তৈরি করা হয়ে গেছে। সরকারি পলিটেকনিক কলেজকে তুলে দিয়ে জমিকে বেসরকারি হাতে বিক্রি করার পথও খুলে দেওয়া হয়েছে।’’
Polytechnic Bengal
পলিটেকনিক কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি নিয়ে রাজ্যের দ্বারস্থ শিক্ষকরা

×
Comments :0