প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়
শিশুদের বিনোদন কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তরে এখন অনেকেই নীরব। টালিগঞ্জ তো সাংঘাতিক ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে শিশু বিনোদন থেকে। এখন
ছবি ইদানিং তৈরি হয়নি বাংলায় যেটাকে শিশুদের চলচ্চিত্র বলা যায়।
কেন এই অবস্থা? সেই উত্তর পরে।
একটা সময় পূর্ণদৈঘ্যের ছবি তৈরি হত টালিগঞ্জে। বছরে একটা অন্তত ছবি হতই যে ছবিটা শুধু শিশুদেরই। বাড়ির ছোটদের নিয়ে বাড়ির বড়রাও অবলীলায় সেই সব ছবি দেখতে যেতেন এবং পূর্ণ বিনোদন পেতেন। ছোটদের এমনই কিছু সেরা ছবি ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। লালু ভুলু, এক যে ছিল বাঘ, ভোম্বল সর্দার, সত্যজিত রায়ের গুপী গায়েন বাঘা বায়েন, সোন্নার কেল্লা, হীরক রাজার দেশে। তারও আগে অরুণ বরুণ কিরণমালা, বরুণ কাবাসির দৈত্য ইত্যাদি। এই সব ছবি সেই সময় ছোটদের মনে স্বপ্ন আঁকত। তারা দীর্ঘদিন মনে মনে লালন পালন করত ছবিগুলোকে। এমন কি বড়রাও মুগ্ধ থাকতেন।
সেই সময় ছোটদের কথা চিন্তা করেই পরিচালক বা প্রযোজকরা ছবি করতে উৎসাহিত হতেন। প্রযোজকও রাজি হতেন। ছোটদের মনের মতন করে ছবি তৈরি হয়ে পর্দায় চলে আসত। ক্রমে ছোটদের ছবি হারিয়ে যেতে লাগল বাংলা ছবি থেকে। বরং হিন্দিতে ও বিদেশে ছোটদের নিয়ে এখনও জনপ্রিয় ছবি তৈরি হয়। কিন্তু টালিগঞ্জে এখন একটাও ছোটদের উপযোগী ছবির খবর নেই। হয়ত বা সিরিয়াস ছবিতেই ছোটদের আনা হয় অন্যভাবে। কিন্তু ছোটদের সমস্যা নিয়ে বা তাদের আনন্দ দেবার জন্য ছবির কোনও খবর নেই দীর্ঘদিন।
এখন বিষয় ভিত্তিক ছবি হলেও বা সম্পর্ক কেন্দ্রীক ছবি হলেও সেখানে শিশুদের আনা হয় না অথবা আনা হলে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে তাদের জায়গা দেওয়া হয়। যা থেকে শিশুরাই মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারে না। অথচ শিশুদের নিয়ে অনেক রকম ছবিই করা যায়। অতিমারির সময়ে শিশুদের নিয়ে সমস্যা হয়েছিল প্রবল। সেই সময়কালে বড়দের কথা অনেকেই ভেবেছেন, অনেক রকম বিনোদন বাজারে এসে পড়েছিল মূনাফাকে ভিত্তি করে। অথচ শিশুদের মানসিক সমস্যা নিয়ে শুধু আলোচনাই হয়েছে। এখন ঘরে ঘরে যেধারাবাহিকগুলো প্রতিদিন অন্দরমহলে ঝড় তোলে সেখানে শিশুদের মত কিছুই নেই। বরং হাবিজাবি কাহিনি রচনা করে সিরিয়ালগুলোকে জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছে। না আছে নির্দিষ্ট কোনও সমাধান, না আছে ভালো কিছু দেবার উদ্যোগ। আর এই সব সিরিয়ালগুলো থেকে শিশুদের নেওয়ার কিছুই নেই। বরং তাদের শিশু মনকে বিষাক্ত করা হচ্ছে। অথচ কেউ ভাবছেনও না শিশুদের জন্য কিছু করা উচিত।
এই না ভাবনার পিছনে অবশ্য কেউ কেউ অন্য কারণ দর্শিয়েছেন। সেটা হলো, অর্থ। ইদানিং নাকি প্রযোজকরা শিশুদের ছবির জন্য অর্থ খরচ করতে রাজি নন। তাঁরা চাইছেন এমন কিছু ছবি হোক, যাতে তাদের টাকা উঠে আসুক। টাকা উঠে আসার কথা ভাবতেই পারেন প্রযোজকরা। তা বলে একেবারে বিমুখ? কথা যখন উঠল তখন বলা যায় স্কুলগুলোরও কোনও উদ্যোগ নেই এব্যাপারে। একটা সময়ে স্কুলে পড়ুয়াদের নানা রকম তাদের উপযোগী ছবি দেখানো হত। স্কুলগুলো থেকেও এই বিষয়টি ক্রমে সরে গেছে।
কোনও কোনও পরিচালক বলেছেন, তাঁরা নাকি শিশুদের জন্য ছবি করতে চান কিন্তু টাকা পাবেন কোথায়? তাঁরা স্বীকার করছেন, বাংলা সাহিত্যে শিশু বা কিশোরগল্পের অভাব নেই। সেরা সেরা গল্প রয়েছে। সেগুলো পর্দায় তুলে আনতে পারলে লাভ বই ক্ষতি হবে না। অথচ ইদানিংকার এক অস্তির মানসিকতাই যেন শিশু চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে টালিগঞ্জকে।
এনিয়ে অনেকে মতামত দিয়েছেন, টলিউড চাইলেই শিশুদের জন্য ভালো চলচ্চিত্র আবার তৈরি করতে পারে। তবে অভাব হলো, সদ-ইচ্ছার। প্রযোজকরা সাতপাঁচ ভেবে পিছিয়ে রয়েছেন। ছবি চলবে কিনা এই চিন্তাতাঁদের যেমন ভাবাচ্ছে তেমনি সদ-ইচ্ছারও অভাব রয়েছে। সব মিলিয়ে পিছিয়ে গেছেন সবাই। তাহলে ক্রমশ বড়দের বিনোদনেই কি ছোটদের মন বসাতে হবে? তা কোনওদিনই হয় না। শিশুদের অসহায়তার কথা কেউ না ভাবলেও তারা নিজেরাই বিনোদন খুঁজে নিয়েছে। ক্রমশ তাদের মনোজগতে কমিকস
বিশাল জায়গা করে নিয়েছে। তারা এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। ছবির জগত থেকে ক্রমশ যেন তারাও সরে যাচ্ছে।
ছোটদের ছবি নিয়ে বিশিষ্ট অভিনেতা শুভাশিস মুখার্জি বলেন, শিশুদের জন্য এই মুহূর্তে কিছুই হচ্ছে না টালিগঞ্জে। শিশুরা বাত্য বলা যেতে পারে। আমি জানি না কি কারণে ছোটদের চলচ্চিত্র এই সময় কেন তৈরি হয় না বাংলায়। এই মুহূর্তে এমন ছবি তো হতেই পারে যেগুলো ছোটোরাও দেখবে বড়রাও দেখবে। হয়ত প্রযোজক, পরিচালকরা মনে করছেন ছোটোদের ছবি করে লাভ নেই কিন্তু এমন তো হতে পারে, যেসব ছবি ছোটোদেরও আনন্দ দেবে আবার বড়োদেরও আনন্দ দেবে।
যেমন সত্যজিত রায়ের ছবি গুপী গায়েন, বাঘা বায়েন, হীরক রাজার দেশে। আচ্ছা এই সব ছবি ছোটোদেরকে আনন্দ দিয়েছে বড়োদেরকেও আনন্দ দিয়েছে। আমি এই ছবিগুলোকে বলি ছোটোদের দেখার, বড়োদের বোঝার। কারণ এই সব ছবির মধ্যে দিয়ে একটা রাজনৈতিক ব্যাপার যেমন চলে যায় ভিতর দিয়ে তেমনই আবার ছোটোরা এই সব ছবি দেখে একটা আনন্দ পায়, নির্মল আনন্দ। ছোটোরা অতশত বুঝবে না। তারা ভূতের রাজার বর বুঝবে, তাদের মজার কান্ড বুঝবে। এখান থেকে ওখানে উড়ে যাওয়া দেখে মজা পাবে। কিন্তু বড়োরা অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়েছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলু খাগড়ার প্রাণ যায়।
সত্যজিত রায়ের এই দুটো ছবিতে আমরা এই ব্যাপারগুলো প্রকট ভাবে দেখেছি কিন্তু ছোটোরা শুধুই আনন্দ পেয়েছে। আমি মনে করি এরকম ছবি বেশি করে হওয়া প্রয়োজন। দেখো, ছোটোদের হলে নিয়ে যেতে হলে বড়োদেরও তো যেতে হবে। ছোটোরা তো আর একা একা ছবি দেখতে যাবে না? কিন্তু এমন ছবি যদি হয় বড়োরাও বলবে দারুণ ছবি। বোঝার আছে। আর ছোটোরা আনন্দ পাবে। তাহলে ছোটোদের ছবিও হলো আবার ব্যবসাও হলো। কারণ ছবি করতে গেলে ইকোনমির ব্যাপারটাও ভাবতে হবে। শুধু ছবি করলে তো হবে না। তাই তেমনই ছবি বারবার হওয়া দরকার যা ছোটোদের নিয়ে বড়োরা যাবে। দু’পক্ষই ছবি দেখে আনন্দ পাবে। তবে এই সময়ে এই ধরণের ছবি হওয়া সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োজন, কি সামাজিক, কি অর্থনৈতিক। প্রযোজকরা সবসময়ই ভাবেন কি ভাবে ছবিতে টাকা ঢাললে তা উঠে আসবে। এটাই স্বাভাবিক। আবার পরিচালক ভাবেন, প্রযোজকদের এমন ছবির কথা বলি যা বড়োদের। একটু রগরগে হবে, একটু অন্য ভাবনার হবে। যা থেকে টাকা উঠে আসবে। তাছাড়া এখন ছোটোদের ছবি তৈরি করার মত সেই ভাবে কাউকে পাওয়া যায় না। তবে আমি মনে করি ছোটোদের ছবি হওয়া প্রয়োজন।
(অলঙ্করণ: মনীষ দেব)
Comments :0