Adieu Godard

গদারের খোঁজে এক পরিচালক

ফিচার পাতা

Adieu Godard

ছবি: অ্যাডিউ গোদার
অভিনয়ে: চৌধুরি বিকাশ দাস, সুধাশ্রী মধুস্মিতা, স্বস্তিক চৌধুরি, চৌধুরি জয়প্রকাশ দাস।
চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা ও পরিচালনা: অমর্ত্য ভট্টাচার্য
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এ ছবির নামকরণের সঙ্গে গদারকে চিরবিদায় জানানোর অবশ্যই কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু ছবিটার সর্বভারতীয় মুক্তির সময়টা আজ জাঁ লুক গদারের নিষ্কৃতি-মৃত্যুর দিনক্ষণের একটা সমাপতন ঘটে গেছে। একেবারেই ঘটনাচক্রে। তবে সমাপতনটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যে মানুষটা সারাজীবন বড় বাজেট, বড় বাজার, বাণিজ্যের উলটো স্রোতে বিকল্প সিনেমার কথা বলে গেলেন, করে দেখালেন, তাঁর ছবির প্রতি নিবেদিত একটা আঞ্চলিক ভাষায় সিনেমা এভাবে রিলিজ করার সাহস দেখালো, এটাই তো বড় জিত। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা ভালো, ওডিয়া সিনেমা কিন্তু আঞ্চলিক ইন্ড্রাস্ট্রিজ হিসাবেও দক্ষিণের ৪টি ভাষা, এমনকি টিমটিমে টালিগঞ্জের চেয়েও পিছিয়ে। সেদিক থেকেও নির্মাতাদের ঝুঁকির দিকটা একটু মাথায় রাখবেন।
গদার দিয়ে গ্রাম ঘেরা: গদারের সঙ্গে বাঙালি সিনেমাপ্রেমীদের সম্পর্কটা বলিউডি সিনেমার ভাষায় ‘কভি দূর, কভি পাস’! গদার তাঁদের কাছের মানুষ। তাঁদের মতই গদারও স্বভাব-বামপন্থী মার্কসবাদী কিছুদিনের জন্যে মাওবাদীও বটে। তিনি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, ক্ষমতার-বিরোধী। তিনি আলজিরিয়ায় ফরাসি, ভিয়েতনামে মার্কিনী, প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ করেন। এবং তিনি আমৃত্যু পুঁজিবাদ, পণ্যবাদ, আর বাজারবাদের মুখোমুখি, সিনেমার রাংতার তলোয়ারটা উঁচিয়ে তাঁর নকল বুঁদির গড় সামলে থাকেন। এই অবধি সব ঠিকই আছে। কিন্তু বাঙালি সিনেমাকে ‘বই নয় ছবি’ ভাবতে শিখলেও, ফর্ম নিয়ে গদারের ডাকাবুকোপনা— গল্প বলা ন্যারেটিভকে তছনছ ছারখার করে। সেই ধ্বংসস্তূপে তাঁর ‘আভাগাঁর্দ’ নৃত্যনাচন— বাঙালির পুরো হজম হয় না। বাঙালি তাই গদারকে ফেলতেও পারে না, গিলতেও পারে না। বরং ফেলেনি-ক্রুফো-সত্যজিৎ রায়দের সঙ্গে তাঁকে কুলুঙ্গিতে ‘ঠাকুর’ বানিয়ে পেন্নাম ঠুকে ম্যাটিনি শোয়ে ‘বই’ দেখতে চলে যায়! অথবা ফিল্ম স্কুলের ছাত্র ডেঁপো ডিপ্লোমা সিনেমায়, তাঁকে নিয়ে মেধাবী দুষ্টুমি করে।
কাজের সূত্রে ওডিশা-প্রবাসী বাংলার অমর্ত্য কোনও পুজোপুজো ভাব করে গোদারকে তাকে তুলে রাখেননি। আবার ভয়ানক আঁতলামোর উড়ানে চাপিয়ে তাঁকে দর্শকের মাথার ওপর দিয়ে পার করে দেওয়ার চেষ্টাও করেননি। বরং গদার তাঁর ছবি জুড়ে যেমন নানান বাগ্‌-বিভূতি ছড়িয়ে রাখতেন, দর্শকদের সঙ্গে চোখা-তেতো-কষটা রং-তামাশা করতেন অমর্ত্য তাঁর ছবিতে সেই ধরনটা আনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ন্যারেটিভের কাঠামোতেই তো একটা স্ববিরোধক মজা আছে। গদারের ঘোর নাগরিক ইন্টেলেক্টচুয়ালপনাকে তিনি ওডিশার একটা গন্ড গ্রামে এনে ফেলেছেন। ছবি শুরুতেই সেই গ্রামেরই এক প্রৌঢ় সাইকেল চালিয়ে গঞ্জের বাজার থেকে নীল ছবির নতুন ভিডিও কিনে আনে। আর তা নিয়ে বাড়ির বসার ঘরে পর্ণো-ছবি দেখার আসর বসায়। সেখানে পাকা চুল-দাড়িওয়ালা আনন্দের সঙ্গী তার মতই দু’জন আধবুড়ো হরি আর দুগ্গা— আর তাদের পেছন পেছন গ্রামেরই হাবাগোবা যুবক যতীন। সস্তা টিভির পর্দায় বিলিতি থ্রি-এক্স ভিডিও’র শ্বেতাঙ্গ নারী-পুরুষেরা অবিশ্বাস্য সব রতিক্রিয়ার দুর্দান্ত সার্কাস দেখাচ্ছে। দর্শকদের শরীরে চোখে মুখে উত্তেজনা আর লোভ চনমন করে বেড়ায়। আর টেলিভিশনের পর্দা থেকে ছিটকে আসা কৃত্রিম, অতি নাটকীয় শীৎকারের শব্দ, বসার ঘরের দেওয়াল-দরজা টপকে আনন্দের বউয়ের বিষণ্ণ বিছানায়— স্কুলপড়ুয়া কিশোরী মেয়ের পড়ার টেবিলে চলে-ফিরে বেড়ায়। এভাবেই ভারতের এক অজ পাড়াগাঁয়ের মলিন একঘেয়ে বিকেল-সন্ধের গায়ে গ্লোবাল-পুলক লাগে!
তারপর একদিন পর্ণো-ছবির ছদ্মবেশেই আনন্দের সন্ধ্যা-আসরে এসে পড়ে ‘ব্রেথলেস’— খিড়কির দরজা দিয়ে গেরিলা কায়দায় ঢুকে পড়েন গোদার। ব্যাপারটা দোকানদারের ভুলও হতে পারে, আবার প্রায়ই দাম বাকি রাখা আনন্দকে একটু টাইট দেওয়ার কৌশলও হতে পারে। তবে ফল যেটা দাঁড়ালো সেটা চমৎকার। ‘ব্রেথলেস’-এ বালিকা বিছানায় যেতে, জামাকাপড় খুলতে এত সময় নিচ্ছে বলে, দুগ্গা-হরিরা চরম ‘বোর’ হয়ে কেটে পড়ল। কিন্তু আনন্দ সাব-টাইটেল ছাড়াই ফরাসি চোরের সঙ্গে আমেরিকান সাংবাদিক মেয়ের অদ্ভুত প্রেমের কাহিনি বড় বড় চোখ করে দেখল! গোদারের বিখ্যাত জাম্পকাট ছাড়াও নীল ছবির সঙ্গীদের ‘গরম’ দৃশ্য দেখার তাড়ায় মাঝে মাঝেই ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দেখা। তারপরেও ছবিটা তার ‘ইন্টারেস্টিং’ লেগেছিল!
কিভাবে? তথাকথিত ‘দুর্বোধ্য’, ‘মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া গদার, ওডিশার এক গ্রাম্য, স্বল্পশিক্ষিত, নুডোলভাগ বা ইউরোপীয় সিনেমার ইতিহাস-ভূগোল কিচ্ছু না জানা মানুষকে ঠিক কোথায় ধাক্কাটা দিলেন, যাতে লোকটা ব্লু-ফিল্ম ছেড়ে নেশার মতো আরও কয়েকটা গোদারের ছবি পরপর দেখে ফেলল? আসলে ছবির মাথামুন্ডু সেভাবে না বুঝলেও আনন্দের মনে হয়েছিল, লোকটা একটা অচেনা-অন্যরকম কিছু করতে চাইছে। হৃদয় নয়, বুদ্ধি-মগজের গোড়ায় ঘা দিতে চাইছে। লোককে ভাবাতে চাইছে। সেজন্যেই তার এই নতুন আবিষ্কারটা সে গাঁয়ের আর পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায়। গ্রামের লোককে একটু ভাবা প্র্যাকটিস করাতে চায়, যাতে ব্যবহার না করে করে ল্যাজের মতই মগজটাও একদিন মানুষের মাথা থেকে খসে না পড়ে যায়! তাই তার কাছে গদারের যে পাঁচটা ভিডিও ছিল, তাই দিয়েই সে গ্রামের মাঠে একটা আস্ত ‘ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ বা গদার রেট্রসপেকটিভ-এর বন্দোবস্ত করে ফেলে। ‘ফরেন ফ্লিম’ খাটো পোশাকের ‘ফরেনার’ দেখার লোভে গোটা গ্রাম ঝেঁটিয়ে আসে। কিন্তু তারপর?
গদার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর: পাবলিক গোদারের নাচ-গান-রোমান্স চেনা নায়ক নায়িকা কিচ্ছু দেখতে না পেয়ে, আনন্দের সঙ্গী বোকাসোকা যতীনকেই ব্যাপক ঠেঙিয়ে হাতের সুখ করে নেয়। শো বাতিল। গদারের ইমেজ-মন্তাজ আনন্দকে নাড়া দিলেও গ্রামের লোকের ভাবনা-চিন্তার একটুও এদিক-ওদিক হয় না। অমর্ত্য এই জায়গাটায় আরেকটা গদার-অনুপ্রাণিত খেলা খেললেন। তিনি আনন্দদের গ্রামের গল্পের সমান্তরালে, তার মেয়ে শিল্পা আর শহুরে ফিল্ম স্কুল-পড়ুয়া বা পাশ করা বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসেন। এরা দু’জনে মিলে চিত্রনাট্য লেখার ছলে গ্রামের গল্পটাকে বুনতে বুনতে আর জুড়তে জুড়তে চলে। ফলে গল্পের জীবন কোথাও সিনেমার মতো হয়ে ওঠে— আবার সিনেমা কখন কাহিনির বাস্তবের অন্দরে ঢুকে পড়ে। এভাবেই শিল্পা আর তার বয়ফ্রেন্ডের শয্যাদৃশ্য ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ পর্ণো-ছবি হয়ে গঞ্জের দোকানে আছে আনন্দদের ব্লু- ফিল্মের আসরে এসে পড়ে। সেই ধাক্কা সই‍‌তে না পেরে আনন্দ আত্মহত্যা করে। পর্দাজু‍‌ড়ে তার ঝুলন্ত পায়ের ক্লোজআপ মৃত্যুটা নিশ্চিত করে।
কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত, আনন্দের এই এত মেলোড্রামা-প্রবণ মৃত্যুটা সত্যি সত্যি বাস্তবে হয়, নাকি সিনেমায়? যেমন ব্রেথলেস-এর শেষ দৃশ্যে পুলিশের গুলিতে নায়কের মৃত্যুটা বাস্তবের নাকি হলিউডি গ্যাংস্টার সিনেমার, সেটা নিয়ে আমাদের ধন্দ থা‍কে। এখানে অবশ্য গ্রামের মস্তান-মাতব্বর গোছের লোকেরা এসে ঘোষণা করে যায়, গদার নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়েই আনন্দ মারা পড়েছে। তাই এ গাঁয়ে আজ থেকে গদারের নাম উচ্চারণও নিষিদ্ধ। কারণ গদার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক! ছবির একেবারে শেষ দৃশ্যে গ্রামের বাইরে কাকতাড়ুয়া-বেশী গদারের সঙ্গে আনন্দের দেখা হয়ে যায়। গদার বিদ্বেষী ব্যানারগুলো একধারে পড়ে থাকে। চাইলেও গদারকে বিদেয় করা বোধহয় অত সহজ নয়!

Comments :0

Login to leave a comment