AIDWA conference Kerala

মহিলাদের ওপর অত্যাচারকেও হাতিয়ার করে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াচ্ছে বিজেপি

জাতীয়

সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়: তিরুবনন্তপুরম 

‘‘কুড়ি বছর ধরে গুজরাট শ্বাস নিতে পারছে না। শ্বাসরোধ হয়ে গিয়েছে গুজরাটবাসীর। আমায় অনেকে প্রশ্ন করেন, আপনি একজন শিল্পী, তা-ও কেন শাসকের বিরুদ্ধে আঙুল তোলেন? ঠিকই, আমি একজন শিল্পী। কিন্তু আমি একজন মানুষও। তাই কখনোই চাইব না, কোনও মানুষ, কোনও পশু বা এই পৃথিবীর আর কেউ ধ্বংস হয়ে যাক।’’ সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির ত্রয়োদশ সর্বভারতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করে শুক্রবার বিজেপি’র কড়া সমালোচনা করলেন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী মল্লিকা সারাভাই। তিনি বিভিন্ন সময়ে আওয়াজ তুলেছেন বিজেপি-আরএসএস’র বিরুদ্ধে। এদিন তিনি বললেন, ‘‘একশো বছর আগে লাভ জিহাদ থাকলে, আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। আমার দাদা-দাদী, নানা-নানি, মা-বাবা ভিন্নধর্মে বিয়ে করেছেন। যদি তাঁরা লাভ জিহাদের শিকার হতেন, তাহলে আমি কোথায় থাকতাম?’’ 
তিনি বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষের সমানাধিকারে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের নিজেদের জীবন, আর রাজনীতিকে একপথে না চালিত করি, তাহলে যে দুনিয়া আমরা দেখতে চাইছি, তা কোনোদিন পাব না। আমরা বলি, মনুস্মৃতি আমাদের অনেক পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এখনও লাখো মহিলার মনে মনুস্মৃতি বিরাজমান। ধর্ম মানেন তাঁরা। মানেন জাতপাত। ছোট থেকে আমরা যদি আমাদের ঘরের বাচ্চাকে এই ধর্মে বিয়ে কোরো না, এই ধর্মে বন্ধু রেখো না, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আমরা গরিব মানুষদের পক্ষে লড়াই করি, আমরা সেই মানুষগুলোর সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করি তো?’’ আবেগপ্রবণ হয়ে তিনি বলেন, ‘‘মন্দির নয়, মসজিদ নয়। একটি সভাকক্ষে এতজন মহিলাকে একসঙ্গে দেখে আমার গলা কাঁপছে। আপনারা সবাই এখানে এসেছেন, একটি আদর্শে বলীয়ান হয়ে। আমরা তো এমনই এক দুনিয়ার স্বপ্ন দেখি, যেখানে গরিব নেই। যেখানে সমানাধিকার আছে, যেখানে মর্যাদা আছে প্রত্যেকের। আমি প্রত্যেকের কাছে আবেদন করছি, নিজের প্রতি সৎ থাকুন, এআইডিডব্লিউএ যে আদর্শের কথা বলে, তা জীবনের পাথেয় করুন। এই লড়াই শুধু রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে নয়, সামাজিক শক্তির বিরুদ্ধেও।’’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মল্লিকা সারাভাইয়ের সঙ্গেই ছিলেন চে গুয়েভারার কন্যা অ্যালাইদা গুয়েভারা, সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত, সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদ এবং অধ্যাপক মধুরা স্বামীনাথনকে।
আরএসএস-বিজেপি’র ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে বৃন্দা কারাত বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত করতে এবং পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শাসকের চোখে চোখ রেখে যখন লড়াই করছেন মহিলারা, তখন ধর্মের নামে তাঁদের একতা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধর্মকে হাতিয়ার করে পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচারও সীমা ছাড়াচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আরএসএস প্রচারক হিসাবেই জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে ফেললেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি সেই কাজই করে চলেছেন। এই সরকারের নীতি কোন চিন্তাধারা পরিচালিত হতে পারে, তা আমরা মহিলা আন্দোলনের কর্মীরা ভালোই বুঝতে পারছি।’’ মহিলাদের উপর অত্যাচারকে হাতিয়ার করেও কীভাবে বিজেপি সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াচ্ছে তার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘শ্রদ্ধা ওয়াকারের নৃশংস হত্যার ঘটনায় আমরা প্রত্যেকে শোকস্তব্ধ। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত আফতাবের নাম নিয়ে বিজেপি প্রচার চালাচ্ছে, আর কোনও আফতাব না তৈরি করতে চাইলে, বিজেপি’কে ভোট দিন। প্রতিদিন যে গড়ে দেশে ৮৬ জন মহিলার ধর্ষণ হচ্ছেন, সেই ঘটনায় সব ছেলেরাই কি আফতাব? প্রতি বছর ছ’হাজারের বেশি মহিলার মৃত্যু হয় পণের দাবিতে, তারাও সবাই আফতাব?’’ তিনি বলেন, ‘‘ঘৃণা, পুঁজিবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আমরা আরও শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলব। সঙ্ঘ পরিবারের সংবিধানের উপর আক্রমণ, মেয়েদের উপর অত্যাচার, সমস্ত অবিচার রুখে দিতে হবে।’’ তৃণমূল কংগ্রেসের অত্যাচারের মুখে পশ্চিমবঙ্গের লড়াই এবং বিজেপি রাজত্বে ত্রিপুরার সংগ্রামকে আলাদা করে অভিবাদন জানান তিনি। 
বিলকিস বানোর ধর্ষকদের গুজরাটের বিজেপি সরকার মুক্তি দেওয়ার পরই গ্রেপ্তার করা হয় সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদকে। তাঁর অপরাধ, তিনি বিলকিসের হয়ে লড়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আদালতের ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যেও তিস্তা তাঁর আন্দোলনের সাথীদের ডাক ফেরাননি। তিনি বলেন, ‘‘সবরমতী জেলে যখন বন্দি ছিলাম, প্রথম প্রথম খুব একলা লাগত। কিন্তু আস্তে আস্তে আমার কাছে চিঠি আসতে লাগল। দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা, গ্রাম গঞ্জ থেকে মেয়েরা চিঠি পাঠাতেন। দু’শো, তিনশো, পাঁচশো থেকে তা বাড়তে বাড়তে পৌঁছায় দু’হাজার সাতশোতে। তিন-চার ঘণ্টা ধরে আমি শুধু পরপর চিঠিই পড়তাম। আর একলা লাগত না। আমার সঙ্গে জেলে যে অন্য মহিলারা ছিল, ওরা জিজ্ঞাসা করত, চিঠিতে কী আছে? আমি ওদের আমাদের কথা বলতাম। সিপিআই(এম), এআইডিডব্লিউএ সহ অন্যান্য মহিলা সংগঠন, প্রত্যেকের লড়াই-সংগ্রামের কথা বলতাম। আমাদের এই লড়াই তো ব্যক্তিগত নয়। সবার লড়াই।’’ জোরালোভাবে তিস্তা বলেন, ‘‘বিজেপি সরকার—এই কথাটা আমি বলি না। এটা সরকার পরিচালনা নয়। এটা রাজত্ব। একথা ঠিক যে আগেও দেশে অপরাধ হতো। এখনও হচ্ছে। কিন্তু এখন অপরাধ দেখে এরা আনন্দ পায়। অপরাধীদের আড়াল করে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনে মহিলাদের ব্যবহার করে।’’ 
অ্যালাইদা গুয়েভারা এদেশের বামপন্থী মহিলা আন্দোলনকে সংহতি জানিয়ে কিউবার পরিস্থিতি, সংগ্রাম, মহিলা ক্ষমতায়নের পরিসংখ্যান তুলে ধরে সম্মেলনকে আরও উজ্জীবিত করেন। 
সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় এদিন সকালে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে। টেগোর থিয়েটার হলে মশাল হাতে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা প্রতিনিধিরা মুহুর্মুহু স্লোগান তুলছেন, ‘‘মোদী-শাহ তানাশাহি নেহি চলেগি, নেহি চলেগি।’’ সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি মালিনী ভট্টাচার্য পতাকা উত্তোলন করেন। ছিলেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মারিয়ম ধাওয়ালে, মহিলা আন্দোলনের নেত্রী সুভাষিণী আলি, সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাতও। পতাকা উত্তোলনের পর শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন নেতৃবৃন্দ। সংগঠনের ১৩তম সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষে যে ১২টি জায়গা থেকে মশাল আনা হয়েছে, তা-ও জ্বালানো হয় এদিন। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন শুরু করেন মারিয়ম ধাওয়ালে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন পর্ব পরিচালনা করেন মালিনী ভট্টাচার্য। শুরুতেই আনন্দের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ধীরে ধীরে কাশ্মীরেও এআইডিডব্লিউএ সংগঠন গড়ে উঠছে। এখন যথার্থ অর্থেই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সংগঠনের শাখা বিস্তার হয়েছে।’’ মালিনী ভট্টাচার্য আরও এক ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, যে হলে এখন সম্মেলন চলছে, সেই হলেই ১৯৭০ সালে এসএফআই’র প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন হয়েছিল। যার উদ্বোধন করেছিলেন এ কে গোপালন।
এদিন সম্মেলন মঞ্চে ‘প্রতিরোধের প্রতীক’ হিসাবে তিস্তা শীতলবাদকে সম্মান জানানো হয়েছে। এরই সঙ্গে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গের ফুল্লরা মণ্ডল, হরিয়ানার কমলেশ, শিলা গোহানা,  তামিলনাড়ুর রেবতী, ওডিশার সংযুক্তা শেট্টি এবং কেরালার মনজিয়াও এই সম্মান পেয়েছেন।

 

ছবি অচ্যুত রায়

Comments :0

Login to leave a comment