সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়: তিরুবনন্তপুরম
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির ত্রয়োদশ সর্বভারতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন করলেন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী মল্লিকা সারাভাই। সমাজসচেতন এই শিল্পী তিনি কেরালা কলামণ্ডলমের চ্যান্সেলরও।
উদ্বোধনী ভাষণে বিজেপি’র কড়া সমালোচনা করেন সারাভাই। তিনি বিভিন্ন সময়ে আওয়াজ তুলেছেন বিজেপি-আরএসএস’র বিরুদ্ধে। ব্যতিক্রম হয়নি এদিনও। সারাভাই বলেছেন , ‘‘একশো বছর আগে লাভ জিহাদ থাকলে, আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। আমার দাদা-দাদী, নানা নানি, আমার মা-বাবা ভিন্নধর্মে বিয়ে করেছেন। যদি তাঁরা লাভ জিহাদের শিকার হতেন, তাহলে আমি কোথায় থাকতাম?’’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসা প্রত্যেকের উদ্দেশে সারাভাই বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষের সমানাধিকারে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের নিজেদের জীবন, আর রাজনীতিকে একপথে না চালিত করি, তাহলে যে দুনিয়া আমরা দেখতে চাইছি, তা কোনোদিন পাব না।’’
আবেগপ্রবণ হয়ে সারাভাই বলেন, ‘‘একটি সভাকক্ষে এতজন মহিলাকে একসঙ্গে দেখে আমার গলা কাঁপছে। আপনারা সবাই এখানে এসেছেন, একটি আদর্শে বলীয়ান হয়ে। আমরা তো এমনই এক দুনিয়ার স্বপ্ন দেখি, যেখানে গরিবী নেই। যেখানে সমানাধিকার আছে, যেখানে মর্যাদা আছে প্রত্যেকের। আমি প্রত্যেকের কাছে আবেদন করছি, মহিলা সমিতি যে আদর্শের কথা বলে, তা জীবনের পথে পাথেয় করুন। এই লড়াই শুধু রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে নয়, সামাজিক শক্তির বিরুদ্ধেও।’’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মল্লিকা সারাভাইয়ের সঙ্গেই ছিলেন চে গুয়েভারার কন্যা অ্যালাইদা গুয়েভারা, সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত, সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদ এবং অধ্যাপক মধুরা স্বামীনাথনও।
আরএসএস-বিজেপি’র ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে বৃন্দা কারাত বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত করতে এবং পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শাসকের চোখে চোখ রেখে যখন লড়াই করছেন মহিলারা, তখন ধর্মের নামে তাঁদের একতা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধর্মকে হাতিয়ার করে পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচারও সীমা ছাড়াচ্ছে।’’
মহিলাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের একাধিক পরিসংখ্যান তুলে ধরেন বৃন্দা কারাত। মহিলাদের উপর অত্যাচারকে হাতিয়ার করেও কীভাবে বিজেপি সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াচ্ছে তার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘শ্রদ্ধা ওয়াকারের নৃশংস হত্যার ঘটনায় আমরা প্রত্যেকে শোকস্তব্ধ। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত আফতাবের নাম নিয়ে বিজেপি প্রচার চালাচ্ছে, আর কোনও আফতাব না তৈরি করতে চাইলে, বিজেপি’কে ভোট দিন। আমি জানতে চাই, প্রতিদিন যে গড়ে দেশে ৮৬ জন মহিলার ধর্ষণ হচ্ছেন, সেই ঘটনায় সব ছেলেরাই কি আফতাব? প্রতি বছর ছ’হাজারের বেশি মহিলার মৃত্যু হয় পণের দাবিতে, তারাও সবাই আফতাব?’’
বিলকিস বানোর ধর্ষকদের গুজরাটের বিজেপি সরকার মুক্তি দেওয়ার পরই গ্রেপ্তার করা হয় সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদকে। তাঁর অপরাধ, তিনি বিলকিসের পাশে থেকেছেন, তাঁর হয়ে লড়েছেন। দীর্ঘদিন জেলবন্দি থাকার পর তিস্তা জামিনে মুক্তি পেলেও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আদালতের ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যেও তিস্তা তাঁর আন্দোলনের সাথীদের ডাক ফেরাননি। দেশের নানা প্রান্তের মহিলাদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সবরমতী জেলে যখন বন্দি ছিলাম, প্রথম প্রথম খুব একলা লাগত। কিন্তু আস্তে আস্তে আমার কাছে চিঠি আসতে লাগল। দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা, গ্রাম গঞ্জ থেকে মেয়েরা চিঠি পাঠাতেন। আর একলা লাগত না। আমার সঙ্গে জেলে যে অন্য মহিলারা ছিল, ওরা জিজ্ঞাসা করত, চিঠিতে কী আছে? আমি ওদের আমাদের কথা বলতাম। সিপিআই(এম), এআইডিডব্লিউএ সহ অন্যান্য মহিলা সংগঠন, প্রত্যেকের লড়াই-সংগ্রামের কথা বলতাম।’’
অ্যালাইদা গুয়েভারা এদেশের বামপন্থী মহিলা আন্দোলনকে সংহতি জানিয়ে কিউবার পরিস্থিতি, সংগ্রাম, মহিলা ক্ষমতায়নের পরিসংখ্যান তুলে ধরে সম্মেলনকে আরও উজ্জীবিত করেন।
সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় এদিন সকালে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে, টেগোর থিয়েটার হলে।
(সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সর্বভারতীয় সম্মেলনকে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখছেন অ্যালাইদা গুয়েভারা। মঞ্চে মল্লিকা সারাভাই এবং নেতৃবৃন্দ। ছবি: অচ্যুৎ রায়)
Comments :0