Governor vs State Government

লাটসাহেবদের এক্তিয়ার শিক্ষা

সম্পাদকীয় বিভাগ

কথাটা দীর্ঘদিন ধরেই উঠেছিল। শেষপর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টকে সেই শিক্ষা দিতে হলো রাজ্যপালদের। তাঁরা যে নিছক রাজ্যগুলির সাংবিধানিক প্রধান, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত বিধানসভার এক্তিয়ারকে তাঁরা ক্ষুণ্ণ করতে পারেন না, মোদী সরকারের আমলে সে কথাটা তাঁরা ভুলিয়ে দেওয়ার মতো আচরণ করছিলেন। ব্রিটিশরা গেছে, কিন্তু রাজ্যপালদের ফের লাটসাহেবের মতো খবরদারি করতে দেখা যাচ্ছে। তামিলনাডুর রাজ্যপাল আরএন রবি সেখানকার বিধানসভায় পাশ হওয়া ১০টি বিল আটকে রেখেছিলেন। তামিলনাডুর ডিএমকে সরকার এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ রাজ্যপালের এই আচরণকে অবৈধ ও একতরফা বলে কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করেছে এবং বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলগুলিকে আইনে পরিণত করার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলগুলির ক্ষেত্রে রাজ্যপালদের কাজ করার সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছে। বস্তুত, এই রায়ে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর নীতিকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে। 
তামিলনাডু বিধাসভায় দশটি বিল দু’বার পাশ হওয়ার পরও সেগুলি রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য ফেলে রেখে দিয়েছিলেন রাজ্যপাল আরএন রবি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা এই আচরণকে খারিজ করে দিয়ে বলেছেন,সংবিধানের ২০০ নম্বর ধারার আওতায় বিল আটকে রাখার কোনও বিশেষ অধিকার নেই রাজ্যপালের। মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী তাঁকে কাজ করতে হবে। বিধানসভায় বিল পাশের তিন মাসের মধ্যে রাজ্যপালকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কোন বিলে সম্মতি দেবেন, কোন বিল আবার বিধানসভায় পাঠাবেন, কোন বিল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মোদী সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে রাজ্যপালদের ব্যবহার করা হচ্ছে অসাংবিধানিকভাবে। রাজ্যগুলিতে জনসাধারণের নির্বাচিত বিধানসভা ও সরকারের এক্তিয়ার খর্ব করে কেন্দ্র থেকে মোদী সরকার রাজ্যপাল পদকে ব্যবহার করে কলকাঠি নাড়ছে। তামিলনাডুর মতোই কেরালাতেও বিধানসভায় পাশ হওয়া অনেকগুলি বিল আটকে রেখেছিলেন রাজ্যপাল। ভারতের বৈচিত্র, রাজ্যগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং একেক রাজ্যের জনগণের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা মাফিক রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে একেক রকম আইন তৈরির পরিসর কেড়ে নিয়ে অভিন্ন ভারত তৈরির নামে আধিপত্য চাপিয়ে দিচ্ছে মোদী সরকার। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রমাণিত হলো, রাজ্যপাল পদের এমন ব্যবহার অসাংবিধানিক।
দক্ষিণ ভারতের বিজেপি বিরোধীদের শাসিত রাজ্যগুলি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর এমন ধারার আক্রমণের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে, রাজনৈতিক এবং আইনি লড়াই চালাচ্ছে, লক্ষণীয়ভাবে পশ্চিমবঙ্গে তা অনুপস্থিত। অথচ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপরে আঘাতের প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একসময়ে এই পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারই সারা দেশে যৌথ প্রতিবাদে নেতৃত্বদান করেছিল। এখন এরাজ্যে রাজভবন বনাম নবান্নের বিস্তর তরজার নাটক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এতে রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসকদলই লাভবান হয়, মেরুকরণ তীব্র হয়। রাজ্যপালকে ব্যবহার করে বিজেপি এবং তৃণমূলের বহু গোপন অমীমাংসিত বোঝাপড়ার মীমাংসা হয়, সেটিং দৃঢ় হয়। কিন্তু রাজ্য এবং রাজ্যবাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। পশ্চিমবঙ্গেও বিধানসভায় বেশ কিছু বিল রাজভবনে আটকে ছিল, কিন্তু এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজভবনে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকার করে যতটা তরজা করেছেন, রাজভবনের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে ততটুকু সময়ও ব্যয় করেননি। পরে ফের সমঝোতা পাকা হতেই রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং দু’জনে হাসিমুখে ফটো সেশনে অংশ নিয়েছেন, আটকে থাকা বিলগুলিও রাজ্যপালের অনুমোদন পেয়ে গিয়েছে। নিজেদের প্রয়োজনমাফিক ‘গালাগালি এবং গলাগলি’র ধারা তৈরি করেছে নবান্ন এবং রাজভবন। সেই ধারায় বিস্তর ঝগড়ার শেষে এরাজ্যের পূর্ববর্তী রাজ্যপালকে দেশের উপরাষ্ট্রপতি বানাতেও মুখ্যমন্ত্রীকে সক্রিয় হতে দেখা গেছিল। এখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নিঃসন্দেহে রাজ্যপালদের শিক্ষা হওয়া উচিত। কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যগুলির থেকে পশ্চিমবঙ্গ কি কিছুমাত্র শিখলো? 

Comments :0

Login to leave a comment