রাম শংকর চক্রবর্তী
বিদ্যালয়ের পানীয় জলের ট্যাংকে কেঁচো, পোকামাকড়। সেই জলই খাচ্ছে পড়ুয়াড়া। এমনকি মিড ডে মিলে জুটছে আলু সেদ্ধ ভাত, কোনদিন পেঁপে বা ওলকপির তরকারি। তা না থাকলে জুটছে লাউয়ের তরকারি ভাত। ডিম, মাছ বা মাংস অলীক কল্পনা এখানে। এমন অবস্থা চলছে বিগত বছর তিনেক ধরেই।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দকুমার ব্লকের হাটগেছিয়া পান্ডববসান কানাইলাল হাইস্কুলের এমন ঘটনা রীতিমতো আশঙ্কার। এই নিম্নমানের খাবার এবং অস্বাস্থ্যকর পানীয় জলের প্রতিবাদে বিদ্যালয়ের কয়েকশো ছাত্রছাত্রী মঙ্গলবার বিক্ষভে শামিল হল। দীর্ঘ সময় ধরে বিক্ষোভ ও পথ অবরোধ চলার পরে নন্দকুমার থানার পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ছাত্র ছাত্রীদের অভিযোগ আধ সেদ্ধ ভাত এবং ওলকপির তরকারি হয়েছিল এদিনের মিড ডে মিলে। দীর্ঘদিন ধরেই এমন খাবার চলছে।
এদিনের খাবার খেতে পারছে না তা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমিত কুমার মহাপাত্রের কাছে গিয়ে বলে কার্তিক সামন্ত নামে অষ্টম শ্রেণীর এক পড়ুয়া। তার অভিযোগ "প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে একথা বলতে প্রধান শিক্ষক চিৎকার করে উত্তর দেয় আমাদের কথা শুনতে হবে। যা দিচ্ছি তাই খেতে হবে। চিৎকার করছেন কেন? এ কথা জানতে চাইতেই আমার কলার ধরে বুকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়।"
দশম শ্রেণীর ছাত্রী স্নেহা সামন্ত, সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী তনুরিমা জানা প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছে। প্রতিদিনই এমন রান্না হয়। এক তরকারি ভাত তাও স্বাদ, গন্ধহীন। ছাত্র-ছাত্রীরা এমন খাবার খেতে পারে না। বিদ্যালয়ের পুকুরে ফেলে দেয় বলছেন বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকরা। তারাও ছাত্র-ছাত্রীদের পাশেই রয়েছেন। কয়েকজন শিক্ষক বলেন প্রধান শিক্ষক নিজেই এই মিড ডে মিলের দায়িত্ব নিয়েছেন। কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে নিজের মতো করেই মিড ডে মিল পরিচালনা করেন। পড়ুয়াদের সুবিধা ও অসুবিধার বিষয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই প্রধান শিক্ষকের।
গুরুপদ দিন্দা নামে এক অভিভাবক বলেন "অবসরপ্রাপ্ত এক গ্রুপ ডি কর্মীকে সাথে নিয়ে মিড ডে মিল পরিচালনা করছে প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয় ভবন ও পরিকাঠামোর উন্নয়নে জন্য সরকারি অনুদানের টাকা নিজের মতো করে খরচ করছেন। বিগত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন নিম্নমানের মিড ডে মিল চলছে। একাধিকবার এসডিও, বিডিও, স্কুল পরিদর্শকদের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক ভাবে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।"
আরেক অভিভাবক সোনামনি মন্ডল বলেন "দিনের পর দিন আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা দুপুরের খাওয়ার সঠিক পরিমাণে খাচ্ছে না। ফলে অপুষ্টিতে ভুগছে তারা। এমন নিম্নমানের খাবার দিলে যে কোনও বাচ্চাই খেতে চাইবে না। প্রতিবছর ভর্তি ফি বাবদ টাকা নেয় এই স্কুল। কিন্তু কোন পরিকাঠামোই নেই।"
রঘুনন্দন অধিকারী নামে একাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্র বলে "ল্যাবরেটরি, কম্পিউটার নেই এই বিদ্যালয়ে। গরমের সময় পাখা চালাতে বললে প্রধান শিক্ষক বলে বিদ্যুতের বিল ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি থেকে নিয়ে এলে তবেই পাখা চলবে। প্র্যাকটিকাল ক্লাস করার জন্য আমাদের অন্য জায়গায় যেতে হয়। এমন অব্যবস্থা চলছে এখানে।"
মিড ডে মিল রান্না করার দায়িত্বে থাকা সর্বানি সিংহ নামে এক মহিলা বলেন "৫০০ এর মতো ছাত্র ছাত্রীদের খাবার রান্নার জন্য জিরা, হলুদ আর লঙ্কা গুঁড়ো ২৫ গ্রাম, তেল ২০০ গ্রাম, পেঁয়াজ মাত্র ৪টি বরাদ্দ থাকে। আমরাও একাধিকবার প্রধান শিক্ষককে বলেছি এভাবে এতজন ছাত্রছাত্রীর রান্না এই মসলা দিয়ে করা যায় না। প্রধান শিক্ষক ধমক দিয়ে আমাদের বলেন যা দিচ্ছি সেই দিয়েই রান্না করতে হবে।"
এদিন বিদ্যালয়ে গিয়ে ভয়ংকর চিত্র দেখা যায় গেল পানীয় জলের ট্যাঙ্ক খোলা অবস্থায় রয়েছে। তাতে পোকামাকড় গিজগিজ করছে। বিদ্যালয়ের তিনতলার ঘরের জানালা নেই, যে কোনও মুহূর্তে বড় বিপদ ঘটবে। ভবনের অবস্থা জরাজীর্ণ। প্লাস্টার বিহীন অবস্থায় একাধিক দেওয়াল রয়েছে।
এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আগেও একাধিক অভিযোগ উঠেছে। যেমন বিদ্যালয়ের একটি কক্ষের মধ্যে মুরগি চাষ, কম্পিউটার পাচার, বিদ্যালয়ের প্রাচীর তৈরিতে বরাদ্দ সরকারি টাকা আত্মসাৎ, এসব বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ডি কর্মী নারায়ণ চন্দ্র জানা এই প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে এই দুর্নীতিতে যুক্ত রয়েছে। এক গ্রামবাসী বলেন অবসরপ্রাপ্ত ওই গ্রুপ ডি কর্মীর প্রচুর সম্পত্তি হয়েছে এই সময়। দুটি বাস চলে। এমনকি প্রধান শিক্ষকও বেনামে প্রচুর সম্পত্তি কিনেছেন। এইসবের উৎস কি? প্রশ্ন তুলছেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু এতসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসন নীরব কেন? উত্তর পাওয়া যায়নি সে বিষয়ে। এদিনের ঘটনা নিয়ে বিদ্যালয় পরিদর্শক (নন্দকুমার ব্লক) তার কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক শুভাশিস মিত্র এই বিষয় নিয়ে জানান "সমস্ত বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি। বুধবার পরিদর্শনে যাব। তদন্ত করে দেখা হবে সমূহ ঘটনা।"
এসএফআই পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক জাকির হোসেন মল্লিক বলেন "সারা রাজ্যের বিদ্যালয়গুলির দুর্দশার চিত্র কি এই বিদ্যালয়ের ঘটনা তা প্রমাণ করে। দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্র-ছাত্রীদের নিম্নমানের খাবার এবং অস্বাস্থ্যকর পানীয় জল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ ঘটনা চলতে পারে না। বুধবার ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে এ বিষয় নিয়ে ডেপুটেশন দেওয়া হবে।"
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বলেই বিশেষ সূত্র মারফৎ জানা গেছে। আর শাসকদলের ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্যই কি তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ হচ্ছে না প্রশ্ন উঠছে এলাকায়।
Comments :0