শোনা যায়, স্বৈরশাসকদের আচরণে ভাঁড়ামো নাকি প্রায়শই লক্ষিত হয়। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে রসাত্মক কোনও সমালোচনাই তারা সহ্য করতে পারে না। আমাদের দেশ এবং এরাজ্যের শাসকদলের নেতানেত্রীদের আচরণ সেটাই যেন প্রমাণ করতে লেগেছে। স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান কুণাল কামরা মুম্বাইতে বেশ কিছুদিন আগেই একটি কমেডি শো’তে সরাসরি নাম না করে মহারাষ্ট্রের উপ মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিণ্ডকে ‘গদ্দার’, ‘দলবদলু’ বলে ইঙ্গিত করেছিলেন। সেই কমেডি শো প্রকাশ্যে আসার পরেই বিজেপি সঙ্গী শিণ্ডেপন্থীরা স্টুডিও’তে ভাঙচুর করেছে। মুম্বাই পুলিশকে দিয়ে কুণাল কামরার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মানহানি মামলা দায়ের করা হয়েছে, তদন্ত চলছে এবং দুটি সমনও জারি করা হয়েছে। কুণাল কামরা হাজিরা দেওয়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় চাইলেও তা খারিজ করে দেয় পুলিশ। তবে কুণাল কামরা ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত আগাম জামিন পেয়েছেন মাদ্রাজ হাইকোর্ট থেকে। নিরাপত্তার আশঙ্কা থেকে মুম্বাই ছেড়ে তামিলনাডুতে বেশ কয়েক বছর যাবৎ বসবাস করছেন তিনি। কিন্তু মহারাষ্ট্রের শাসকদলের বিধায়করা আরও তিনটি এফআইআর দায়ের করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে, কারণ তিনি নাকি উপমুখ্যমন্ত্রীর মানহানি করেছেন এবং বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ কমেডিয়ানের মুখবন্ধ করার জন্য ধারাবাহিকভাবে চাপ রাখতে চাইছে শাসকরা। তবে কোনোধরনের চাপের কাছে মাথা নত করবেন না বলে স্পষ্ট করে দিয়েছেন কুণাল কামরা এবং ক্ষমা চাইবেন না, তাও জানিয়ে দিয়েছেন।
কুণাল কামরার কমেডির মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, পছন্দ না হলে সমালোচনাও করতে পারেন। কিন্তু সংবিধান প্রদত্ত বাক্ স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নিয়ে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা, এমনকি দুষ্কৃতীদের দিয়ে হামলা করানো নৈতিক কিংবা আইনগত কোনোদিক থেকেই সম্মত হতে পারে না। বাক্ স্বাধীনতার ওপর আক্রমণের ঘটনা ভারতে এখন আর বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রমী নয়। প্রশ্ন করার কারণে কয়েকদিন আগেই আসামের বিজেপি সরকারের পুলিশ দিলওয়ার হোসেন মজুমদার নামের এক নির্ভীক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা রুজু করে তাঁকে জেলে পুরেছিল। চুরির অভিযোগ থেকে শুরু করে তফসিলি জাতি-জনজাতিদের বিরুদ্ধে অপমান করা ইত্যাদি অভিযোগে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার পাঁচটি ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ। কিন্তু প্রতিটি মামলাই আদালতে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে, দিলওয়ার হোসেন মুক্তি পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র ডিজিটাল মাধ্যমে একটি কার্টুন শেয়ার করায় এরাজ্যের মমতা ব্যানার্জির পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে হয়রানি করেছে দীর্ঘদিন ধরে। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ধারা পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে আরোপ করেছিল, সেই ধারাকেই পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি বিরোধীদের কণ্ঠস্বর দমন করতে কোনও না কোনও বাহানা খুঁজে বের করে চলেছেন। সম্প্রতি বিদেশে গিয়ে মমতা ব্যানার্জি যে ভাষণ দিয়েছেন তাকে শুধু অসত্য নয়, অতি স্থূলমানের ভাঁড়ামো বললেও অত্যুক্তি হয় না। এরজন্য তিনি আগে থেকে সঙ্গে করে বড় সাইজের ছবি প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেই যে ছাত্র গবেষকরা প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে সোশাল মিডিয়াতে হুমকির স্রোত বইয়ে দেওয়া হচ্ছে তৃণমূলের তরফে। কলকাতায় এসএফআই কর্মীদের ওপরে হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, শাসকরা জনগণের মধ্যে থেকে উচ্চারিত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে ভয় পাচ্ছে। তাই এই পালটা আক্রমণ, কখনো পুলিশকে ব্যবহার করে, কখনো দুষ্কৃতীদের ব্যবহার করে। কিন্তু আক্রমণ যতো বাড়বে, প্রতিবাদও ততোই তীব্র হবে এবং আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়বে। কোনোভাবে তা থামানো সম্ভব হবে না।
Comedians and State
শাসকই যখন ভাঁড়

×
Comments :0