Singur

ভোল বদলে মমতা এখন বলছেন, মিডিয়া ঠিকমতো বুঝতে পারেনি

রাজ্য

কলকাতা, ২০ অক্টোবর—শিলিগুড়িতে ‘টাটাকে আমি তাড়াইনি’ বলে কলকাতায় এসে মমতা ব্যানার্জি বললেন, তিনি এইভাবে বলতে চাননি!
বৃহস্পতিবার কলকাতায় তৃণমূল বিধায়কের কালীপুজোর উদ্বোধন করতে এসে মমতা ব্যানার্জি ফের তুলে আনেন সিঙ্গুর ছেড়ে টাটা গোষ্ঠীর চলে যাওয়ার প্রসঙ্গ। এদিন অবশ্য তিনি বলেছেন, ‘‘বিকৃত করে লেখা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। আমি ওদের (সংবাদমাধ্যম) দোষ দিই না। হয়তো ভাষাটা আমি ঠিকমতো বোঝাতে পারিনি। তারা (মিডিয়া) হয়তো ঠিকমতো নিতে পারেনি।’’ 
এদিন মমতা ব্যানার্জির এই মন্তব্য নিয়ে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, মমতা ব্যানার্জি কেন নিজেকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ওঁর চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু সেখানেও সঠিক চিকিৎসা নিয়ে সমস্যা আছে। চিকিৎসকদের ভোটেও তো তৃণমূল লুট করেছে।’’ 
‘‘টাটাকে আমি তাড়ায়নি, সিপিএম তাড়িয়েছে।’’ গত বুধবার বলার পর থেকে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যিনি বলবেন, মমতা ব্যানার্জি সত্য কথা বলেছেন। বরং মুখ্যমন্ত্রীর শিলিগুড়ি এই মন্তব্যের পর থেকে সোসাল মিডিয়া থেকে রাজ্যের সর্বত্র মমতা ব্যানার্জির মন্তব্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। ইতিহাসের নানা ঘটনা নিয়ে এর আগে মমতা ব্যানার্জির একাধিক মন্তব্যকে ঘিরে জলঘোলা কম হয়নি। রাজ্য বিধানসভায় রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা বিরোধী আইন প্রণয়ন থেকে, হাল আমলে বলা স্বাধীনতা সংগ্রামী অরবিন্দকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো অগণিত ঘটনার তথ্য উঠে এসেছে মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে। কিন্তু সিঙ্গুর থেকে টাটা গোষ্ঠীর ফিরে যাওয়া সেই অর্থে ঐতিহাসিক ঘটনা না হলেও মমতা ব্যানার্জির মুখে ‘‘টাটাকে আমি তাড়ায়নি’ বলে দেওয়া প্রায় ঐতিহাসিক মিথ্যাচারের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। গত বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে টাটা প্রসঙ্গ শোনার পর থেকে বিস্মিত রাজ্যবাসীর একটাই প্রশ্ন, কী করে একথা বললেন উনি! আর সেটা বুঝেই এদিন নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে নতুন করে মাঠে নামতে হয়েছে মমতা ব্যানার্জিকে। 


কলকাতার জানবাজারে কালীপুজোর উদ্বোধন করতে এসে মমতা ব্যানার্জিকে ফের বলতে হয়েছে, ‘‘আমরা কখনও কোনও বাছবিছার করি না। আমাদের এখানে ‘এ টু জেড’ যারাই আসবে বিনিয়োগ করতে, শিল্প করতে তাদের সবাইকে আমরা স্বাগত জানাবো।’’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, গত এক দশক রাজ্যে সরকার চালিয়ে এরাজ্যে বিনিয়োগ কোথায়? 
মমতা অবশ্য এদিন এরাজ্যে টাটা গোষ্ঠীর বিনিয়োগ নিয়ে বলেছেন, ‘‘ওরা (বিরোধীরা) জানে না, টাটারা এখানে কতগুলো কারখানা করেছে। যান, একবার খড়্গপুরে ঘুরে আসুন। আইটি সেক্টরটা গিয়ে ঘুরে আসুন। করতে জানতে হয়।’’ এরাজ্যে খড়্গপুরে টাটা গোষ্ঠীর টাটা মেটালিকস, টাটা বিয়ারিং কারখানা আছে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই কারখানা তৈরি হয়েছে। তারপরে সেই কারখানার উৎপাদন বেড়েছে। খড়্গপুরে টাটা গোষ্ঠীর বিনিয়োগের শুরটা হয়েছিল এরাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই। একইভাবে সেক্টর ফাইভে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই বিনিয়োগ করেছে টিসিএস কোম্পানি। বামফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী দেবেশ দাশ জানান, ‘‘টিসিএস সংস্থাকে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই জমি দেওয়া হয়েছিল। জমির দামও তারা মিটিয়ে দেয়। তৃণমূলের আমলে টিসিএস আসেনি।’’ 
টাটা গোষ্ঠী কার জন্য সিঙ্গুর ছেড়ে চলে গিয়েছে, তা নিয়ে কোথাও কোনও সন্দেহ নেই। যেটা আছে, সিঙ্গুরের পড়ে থাকা জমিতে গত এক দশকে মমতা ব্যানার্জির সরকার কিছুই করে উঠতে পারেনি। অথচ প্রতিটি নির্বাচনে আগে সিঙ্গুরে গিয়ে মমতা ব্যানার্জিই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন, সিঙ্গুরে কারখানা গড়বে সরকার। এমনকি গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে সিঙ্গুরে কৃষিভিত্তিক শিল্প পার্ক গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কোনও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি রাজ্য সরকার। সিঙ্গুরেও হয়নি, গোটা রাজ্যের কোথাও হয়নি। তা সবথেকে ভালো জানেন মমতা ব্যানার্জি। তাই সিঙ্গুর প্রসঙ্গ থেকে ফের জমি আন্দোলনের কথাতেই এদিনও তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে তাপসী মালিকের নাম। মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘‘তাপসী মালিকের মতো মেয়েকে পুড়িয়ে মেরেছে। কৃষকদের পুড়িয়ে মেরেছে।’’ চলতি বছরের ৩ জুন মমতা ব্যানার্জি সিঙ্গুর গিয়ে বাজেমেলিয়াতে কামারকুণ্ডু রেল ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করেছিলেন। পুজো দিয়েছিলেন সন্তোষী ঠাকুরের মন্দিরে। যে মাঠে মমতা ব্যানার্জি সভা করেছিলেন তার পাশেই ছিল তৃণমূলের তৈরি করা তাপসী মালিকের মূর্তি। মমতা ব্যানার্জি তার পাশ দিয়ে গেলেও মালা দেননি বলে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন এলাকার মানুষ। এদিন ফের মমতা ব্যানার্জির মুখে শোনা গিয়েছে তাপসী মালিকের নাম। 
দেউচা পাঁচামীতে আদিবাসী মানুষকে বাস্তুহীন করার চক্রান্ত করছে রাজ্য সরকার। তার বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনে শামিল দেওচা পাঁচামীর মানুষ। এদিন মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘‘আবার দেউচা পাঁচামীর সঙ্গে তুলনা করছে। দেউচা পাঁচামী প্রকল্পে ৫ লক্ষ মানুষের কাজ হবে। গর্ব হওয়া উচিত। ওখানে কি কলকাতা থেকে চাকরি করতে যাবো? ওখানে বর্ধমান চাকরি পাবে, বীরভূম পাবে, হাওড়া, হুগলী পাবে। 
রাজনৈতিক মহলের মতে, সামনেই পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে তৃণমূল। নিয়োগ দুর্নীতি সহ একাধিক কেলেঙ্কারিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা দল ও সরকারকে রক্ষা করতে মমতা ব্যানার্জি তাই নতুন করে সিঙ্গুর ও জমি আন্দোলনকে জিইয়ে তুলতে চাইছেন।
আসলে এই মুহূর্তে জমি নয়, রাজ্যের মানুষ কাজ চায়। সেই কর্মসংস্থানের কোনো হদিশ নেই রাজ্যে।  
 

Comments :0

Login to leave a comment