অয়ন্তিকা নাথ
গত ১৮ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজ্য আর্কাইভ অধিদপ্তরের উদ্যোগে, রাজ্য উচ্চশিক্ষা দপ্তরের সহায়তায় প্রদর্শনী সপ্তাহ উদ্যাপন করা হয়। উনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীতে ভারত থেকে যে সমস্ত অভিবাসী শ্রমিকদের মরিশাস, নাটাল, ফিজি, মালয়সহ বিভিন্ন ক্যারাবিয়ান দেশগুলিতে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক হিসাবে নিয়ে যাওয়া হতো, অভিবাসিত হওয়ার পর তাঁদের অর্থনৈতিক বিপন্নতা, আত্মপরিচয় সঙ্কট, এমনকি নাগরিকত্ব লাভ করার পরেও প্রথম বিশ্বে আমদানিকৃত নেটিভ দেশের মানুষ হিসাবে যে মানসিক বিপন্নতার মধ্যে তাঁদের জীবন কাটাতে হতো তার বিস্তারিত আলেখ্য উপস্থাপনাই এই প্রদর্শনীর মূল বিষয় ছিল। ১৮৩৩ সালে ব্রিটেনে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ১৮৩৪ সাল থেকে নয়া স্বরূপ ধারণ করে দাসপ্রথা যা পরিচিত হয় চুক্তিভিত্তিক অভিবাসী শ্রমিক প্রথা হিসাবে। উনিশ শতকে এবং বিশেষত বিশ শতকের দুই মহাযুদ্ধের সময় ভারতে যে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয় সেই সময়ে ভারতীয় শ্রমিকদের একাংশ চলে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে মিত্রপক্ষের হয়ে লড়াই করতে। আরেকটা বড় অংশ চলে যায় মরিশাস, জাভার মতো ক্যারিবিয়ান উপকূলবর্তী দেশগুলিতে চিনি, তন্তু, পাটের মতো অর্থকরী ফসল উৎপাদনের জন্য জমিতে কাজ করতে। ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসাবে ২০০ বছর কাটানোর সুবাদে ভারতের নিজস্ব শিল্প এবং অর্থনীতি যে চূড়ান্ত সঙ্কটমুখীনতার মধ্যে পড়েছিল, ভারত থেকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে ক্রমাগত শ্রমিক অভিবাসিত হওয়ার ফলে সেই সঙ্কট তীব্রতর আকার ধারণ করে।
‘সেইসময়ে অনেক মানুষ ভিন দেশে চলে যাওয়ার পর আর ফিরতেন না। কারণ নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তা ভারতীয় শ্রমিকরা তখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে আরম্ভ করেছেন। কিন্তু সেখানে বসবাসের দীর্ঘ সময় পরে কাগজে-কলমে এদেশের মানুষদের নাগরিকের মর্যাদা দিলেও শ্রেণিগত আধিপত্যবাদ তাঁদের ঔপনিবেশিক পরিচয়কে সচেতনভাবেই ভুলতে দিতো না। ফলত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ক্ষমতায়নের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে থাকতে প্রায় দাস হিসাবেই ভারতীয় শ্রমিকরা নিজেদের স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই দাসত্ব থেকে ভারতীয় চেতনাকে কেবল বাস্তব ক্ষেত্রে নয়, বৌদ্ধিকভাবেও মুক্ত করার জন্যও বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী।’ বললেন প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্যোক্তা মৌমিতা চক্রবর্তী।
ইদানীংকালে, মূলত বাণিজ্যিক উদারীকরণের চাপটুকু মালুম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রগতিশীল বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে একটা বিশেষ পরিভাষা মুখে মুখে ঘুরতে আরম্ভ করেছিল, ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’। যার মোটামুটি বাংলা করলে দাঁড়ায় ঔপনিবেশিক পিছুটান থেকে মুক্ত না হতে পারা এক অবস্থা। বিগত দশকের শেষের দিকেও ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’এর একরকম আবছা ধারণা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে খাপছাড়াভাবে হলেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু এই ধারণা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভারতীয় চেতনাকে কেবল বিচলিত করছে তাই নয়, একধরনের অস্বস্তিকর আত্মপরিচয় সঙ্কটের সম্মুখীনও করছে বটে। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই ভারত পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ভূখণ্ড হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, কিন্তু উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্ব হিসাবে ঔপনিবেশিক দাসত্বের অভ্যাস ভারতীয়ত্বের ধারণার সঙ্গে এযাবৎকাল পর্যন্ত এতটাই একীভূত হয়ে রয়েছে যে সেই ধারণাকে জীবন-যাপনের খুঁটিনাটি থেকে সহজে আলাদা করা যায় না। এই আক্ষেপের মধ্যেও যে একপ্রকার কলোনিয়াল হ্যাংওভার- এর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে থাকে সেকথা জানা সত্ত্বেও অনেকসময়ে এই পরিভাষার যে বৌদ্ধিক ওজন তা বহন করা চলতেই থাকে।
২০২৫ সাল চলছে। দশকের মাঝামাঝি সময়ে দাঁড়িয়েও অভিবাসিত শ্রমিকদের নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনী ঠিক কোথায় গিয়ে আমাদের বিচলিত হতে বাধ্য করে? প্রথম বিশ্ব, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উন্মুক্ত বিশ্ববাজার ভারতীয় অর্থনীতির স্বকীয়তাকে কীভাবে বিধ্বস্ত করেছে সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পরিসর রয়েছে। কিন্তু নয়া উদারনীতির রূপায়ণের সঙ্গে সঙ্গে দেশি বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির কাছে ভারতীয় শ্রমজীবীদের রুজি-রুটি বাঁচানোর দায়বদ্ধতাকে যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে তাতে তাঁরা দাসোচিত আচরণের খুঁটিনাটিকে আত্মস্থ করতে বাধ্য হচ্ছেন, সাম্রাজ্যবাদের পদানত হয়ে চলার পুরানো অভ্যাস খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় চেতনায় আরও দৃঢ়মূল হচ্ছে। যেভাবে এমনকি তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে তাতে পুরানো দাসদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে, আজও অভিবাসন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রত্যেক বছর আমাদের দেশ থেকে কেবল নিরক্ষর মানুষরাই নন, শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের একাংশও বিদেশে চলে যাচ্ছে চুক্তির ভিত্তিতে চাকরি করতে এবং এই চলে যাওয়ার কারণও কিন্তু নগদ অর্থলাভই। অর্থাৎ পরিবর্তিত স্বরূপে হলেও ভারতের শিক্ষিত প্রজন্মকেও এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হচ্ছে যে তারা আদতে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় উন্নত ধরনের শ্রমিকই, সুতরাং এই মুহুর্তে দাঁড়িয়েও কিন্তু এই সমস্যা অত্যন্ত জ্বলন্ত সমস্যা।’ বললেন প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্যোক্তা মৌমিতা চক্রবর্তী।
Comments :0