ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উচ্ছেদ করে স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠা এবং জমিদারি শোষণ ব্যবস্থা উচ্ছেদ ঘটিয়ে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে কৃষি সমস্যা সমাধান করার স্লোগান উঠেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশের সরকার জমিদারি ব্যবস্থা বিলোপের কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কৃষি অর্থনীতির ভিত পরিবর্তনের প্রাথমিক শর্ত ছিল জমিদারি ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে প্রকৃত কৃষকদের হাতে জমি বণ্টন করা। ১৯৫০ সালের পরবর্তী সময় জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ আইন প্রণয়ন হলেও তা খাতা-কলমে থেকে যায়। বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ নিয়ে জমিদাররা তাদের একাংশ জমি সরকারের হাতে ন্যস্ত করে। প্রশান্ত মহালানবিশের হিসাব অনুযায়ী জমিদার ব্যবস্থা উচ্ছেদ হবার পর সরকারের হাতে ১৮ কোটি ৬০ লক্ষ বিঘা জমি ন্যস্ত হবার কথা। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে যে সমস্ত ভূমিসংস্কার আইন হলো তাতে অনেক ফাঁকফোকর থাকার ফলে মাত্র ২ কোটি ১৯ লক্ষ বিঘা উদ্বৃত্ত জমির সন্ধান পাওয়া যায় এর মধ্যে ৬০ লক্ষ বিঘা জমি মামলায় আটকে যায়। কার্যত সিলিং আইন অকেজো করে খেতমজুর, গরিব চাষি ও ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বণ্টন করতে সরকার ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে স্বনামে বেনামে জমিদারদের জমি নিজেদের অধীনে রাখতে সুযোগ করে দেওয়া হয়।
সারা দেশের ক্ষেত্রে কাশ্মীর, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরা এসমস্ত রাজ্যে সরকারি আইনি চৌহদ্দির মধ্যে অনেকাংশে ভূমিসংস্কার হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর ৬০-৭০ দশকে আমাদের রাজ্যে উদ্বৃত্ত, বেনাম জমি দখলের তীব্র আন্দোলন সংগঠিত হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মূল সংগঠন ছিল সারা ভারত কৃষকসভা। ১৯৬৭, ১৯৬৯ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকার জমি উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭২-৭৭ পর্যন্ত রাজ্যে আধা ফ্যাসিস্ত কংগ্রেস সরকারের সময় কৃষকের অর্জিত অধিকার অনেকাংশে হরণ করা হয়। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হবার পর জমিচ্যুত কৃষক তাদের অর্জিত অধিকার পুনরুদ্ধার করে।
স্বাধীন ভারতে শাসকশ্রেণি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভূমি বিপ্লবের পরিবর্তে সবুজ বিপ্লব সংগঠিত করে। আধাসামন্ততান্ত্রিক জমিদারদের ধনতান্ত্রিক জমিদারে পরিণত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং ধনী কৃষকদের একটি স্তর তৈরি করবার উদ্যোগ গ্রহণ করে যা ছিল শাসকশ্রেণির শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ৬০ দশকে কেন্দ্রীয় সরকার সবুজ বিপ্লবের নামে কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে যার সুফল পায় জমিদার ও ধনী অংশের কৃষকরা। এর ফলে দেশে সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও গরিব কৃষক, খেতমজুর, এমনকি মাঝারি কৃষকদের কোনও লাভ হয়নি। এই হলো রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশের প্রথম পর্যায় (১৯৪৭-১৯৯০)। কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৯১ সাল থেকে যখন আমাদের দেশে উদারবাদী অর্থনীতি চালু হয়। বিশ্ব লগ্নি পুঁজির স্বার্থে বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ-র নির্দেশে কাঠামোগত সংস্কারের নামে কৃষি ব্যবস্থাকে গভীর সঙ্কটে ঠেলে দেবার পথ গ্রহণ করা হয়। ধীরে ধীরে কৃষি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেট স্বার্থবাহী করা হয়। লুটেরা পুঁজির উত্থান এবং ২০০৮ থেকে চলতে থাকা বিশ্ব পুঁজিবাদের সঙ্কটের ফলে আমাদের দেশের কৃষির সঙ্কট আরও গভীরতর হয়েছে। তিন দশক ধরে উদারবাদী অর্থনীতি প্রয়োগের ফলে কৃষক ও কৃষি অর্থনীতির চরিত্র বদলে গেছে এবং প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। ঋণগ্রস্ত হয়ে দরিদ্র কৃষক ও মাঝারি কৃষকের একাংশ জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। যার ফলে ভূমিহীন খেতমজুরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১১ সেন্সাস অনুযায়ী দেশে প্রধান ও প্রান্তিক কৃষক সংখ্যা ১১ কোটি ৮৬ লক্ষ ২৯ হাজার ২৬৪জন। সেক্ষেত্রে প্রধান ও প্রান্তিক খেতমজুরের সংখ্যা ১৪ কোটি ৪৩ লক্ষ ২৯ হাজার ৮৩৩ জন। ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এই ১০ বছরে কৃষকের সংখ্যা ৯০ লক্ষ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে ৩ কোটি খেতমজুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর ৩০ লক্ষ কৃষক জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। জমি হারিয়ে তারা খেতমজুর, গ্রামীণ শ্রমজীবীতে পরিণত হচ্ছে।
কলকারখানা বন্ধ হবার কারণে কর্মচ্যুত বহু শ্রমিক গ্রামে ভিড় জমাচ্ছেন। কৃষকের থেকে খেতমজুরি গ্রামীণ শ্রমজীবী সংখ্যা বৃদ্ধির অর্থ হলো জমির তুলনায় মজুরি শ্রমের উপর বেশি নির্ভরতা। কৃষি উৎপাদনে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে খেতমজুরদের কাজের দিনের সংখ্যা কমেছে। ১৯৯০ সালে কৃষিতে গড়ে ১০০ দিন খেতমজুররা কাজ পেতেন, বর্তমানে ৩৮-৫০ দিন হয়েছে। স্বাভাবিক কারণে সংসার প্রতিপালনের জন্য তারা গ্রামে অন্যান্য অকৃষি কাজে যুক্ত হচ্ছে বা পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। গ্রামের সিংহভাগ কৃষকের অবস্থা খুবই করুণ।
গ্রামীণ খেতমজুর, অ-কৃষি শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কোনও কাজ নেই। কখনও তারা খেতে বা রেগা প্রকল্পে, নির্মাণ কাজ সহ একাধিক ক্ষেত্রে কাজের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। ঠিকমতো কাজ মিলছে না। কৃষি ক্ষেত্রে ফুরন বা মজুরি প্রথা বাড়ছে। ৫০ ঊর্ধ্বে খেতমজুরদের ফুরনে কাজ মিলছে না। সরকারি নীতির জন্য কৃষি অলাভজনক হবার ফলে অনেক জমির মালিক লিজে অন্যদের চাষ করবার জন্য ছেড়ে দিচ্ছে। এখন গ্রামের গরিব অংশের মানুষ লিজে চাষাবাদ করছেন মূলত খোরাকির জন্য। জমির কাগজপত্র না থাকবার জন্য লিজ চাষিরা বন্যা, খরাজনিত কারণে কোনও ক্ষতিপূরণ পায় না। দেশে এবং রাজ্যে মাইক্রোফাইনান্স, সুদখোর, মহাজনি ঋণের রমরমা বাজার চলছে। চড়া সুদের ঋণ শোধ করবার জন্য মাইক্রোফাইনান্সের লোকজন কৃষক, খেতমজুরদের বাড়ি গিয়ে হামলা করছে। এদের চাপের ফলে অনেকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। গ্রামীণ বেরোজগারি সমস্যা কিছুটা লাঘব করবার জন্য মূলত বামপন্থী সাংসদের চাপ ও আন্দোলনের ফলে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প আইনি স্বীকৃতি পায়। বর্তমান কর্পোরেট বান্ধব মোদী সরকার রেগা প্রকল্পে বরাদ্দ সঙ্কুচিত করে চলেছে। আমাদের রাজ্যে এই প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতির জন্য প্রায় ৮ মাস কাজ বন্ধ রয়েছে। বিপুল পরিমাণ মজুরি বকেয়া রয়েছে। বাধ্য হয়ে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রায়শই কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনযন্ত্রণা দেশবাসী উপলব্ধি করেছে। গ্রামে কৃষি ক্ষেত্রে, বিড়ি শিল্প, চর্ম শিল্প, জরি শিল্প, রাস্তা নির্মাণ, পশুপালন, গৃহপরিচিকা, আশা, আইসিডিএস, মিড ডে মিল, মৎস্য উৎপাদন সহ একাধিক ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমজীবীর সংখ্যা বাড়ছে। মহিলাদের মজুরি কম।
উদারবাদী অর্থনীতির কারণে সামাজিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত খেতমজুর, গ্রামের গরিবরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেনশন আবাসন সহ একাধিক ক্ষেত্রে যতটুকু সুযোগ পেয়েছিল তারা এখন সামাজিক প্রকল্পগুলি থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা সহ একাধিক পরিষেবা ব্যাপকভাবে বেসরকারিকরণ হচ্ছে যা সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। অতিমারীর সময় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুণ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। নব্য উদারনীতির কারণে গ্রামের খেতমজুর, দিনমজুর, ভূমিহীন কৃষক, পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা স্ফীত হচ্ছে। তীব্র দারিদ্রের যন্ত্রণার জাঁতাকলে এরা নিম্নস্তর হিসাব বিরাজ করছে। তাদের সঙ্গে ছোট কৃষক, মাঝারি কৃষক, ভাগচাষি, পাট্টাদার, মৎস্যজীবী, গ্রামীণ কারিগর সহ একাধিক পেশায় যুক্ত কোটি কোটি গ্রামীণ মজুর শোষিত হয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে। ধনী কৃষকরাও আজ সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেটের শোষণে বিদ্ধ হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী, সামন্তবাদী শোষণের শিকার এই বিপুল জনসংখ্যা (যারা প্রায় গ্রামীণ জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ) শোষণ থেকে মুক্তি চাইছে। এরা হচ্ছে গ্রামীণ শ্রেণি সংগ্রামের মজুত বাহিনী।
দেশে ও আমাদের রাজ্যে শিল্প বিকাশ বন্ধ হয়ে পড়েছে। স্থায়ী কর্মীর ধারণা পালটে গেছে। যতটুকু নিয়োগ হচ্ছে প্রায় সবটাই ঠিকা ভিত্তিক, মাসিক মজুরি ৬০০০—১০০০ টাকার মধ্যে। ছুটি নেই। পিএফ নেই। মেডিক্যাল লিভ নেই। কাজ করলে পয়সা। শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ ঠিকা কাজে যুক্ত যারা নির্মম শোষণের শিকার।
অন্যদিকে গ্রামে শোষক শ্রেণির সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে পুঁজিবাদী ও ধান্দা পুঁজির শোষণের মাধ্যমে। কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে কৃষি উৎপাদনের সকল সামগ্রী জোগান দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট সংস্থা। কর্পোরেট ও বৃহৎ ব্যবসায়ীরা, সার, বীজ, পোকামারা তেল, পাম্পসেট, ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, ধান বোনা / ঝাড়া মেশিন সহ বিভিন্ন উৎপাদন সামগ্রী থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ লুট করছে। কর্পোরেট লুটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে সামন্ততান্ত্রিক / ধনতান্ত্রিক জমিদার, মাইক্রোফাইনান্স, বড় ব্যবসায়ী, প্রোমোটার, ঠিকাদার, সুদখোর, ধান্দাবাজ সহ গজিয়ে ওঠা নতুন ধনীরা। গ্রামের কৃষক, খেতমজুর, দিনমজুর, গ্রামীণ শ্রমজীবীরা এদের হাতে নির্মম শোষণের শিকার হচ্ছে। গ্রামের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, সমবায় সমিতি, মাছ উৎপাদনের বড় জলাশয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পঞ্চায়েত এরা নিয়ন্ত্রণ করছে। থানা পুলিশ এবং সরকারি আধিকারিকরা এদের কথা মতো চলে। পশ্চিমবঙ্গের চিত্র দেখলে জলের মতো পরিষ্কার শাসক দলের নেতারা রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ও পঞ্চায়েতকে ব্যবহার করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। এই শোষক শ্রেণির মধ্য থেকে অনেকে সাংসদ, বিধায়ক, পঞ্চায়েতের পদাধিকারী হয়ে গ্রামীণ শোষণ ব্যবস্থার একটি স্থায়ী বাহিনীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এরা শুধু গ্রামের অর্থনৈতিক শক্তির নিয়ন্ত্রক নয় এরা গ্রামীণ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় সমস্ত বিষয়ে নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনে এরা দাঙ্গা বাধানোর কাজে লিপ্ত হয়। সেই সঙ্গে সমাজের মানুষকে বিভক্ত করার নানা ষড়যন্ত্র আজ শোষকের এক বড় হাতিয়ার। বর্তমান আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি সরকার গ্রামীণ গরিব ও সামাজিকভাবে নিপীড়িত জাতির মধ্যে পরিচিতি সত্তা ও ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে ঐক্য ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিজেপি শুধু সাম্প্রদায়িকতার রঙ খেলছে না, সামাজিকভাবে নিপীড়িতদের সমাবেশ করবার জন্য পরিচিতি সত্তাকে ব্যবহার করছে। এটা খুব ভয়ঙ্কর, যে দলের নীতি আদর্শ দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে তারা নির্বাচনে এই অংশগুলিকে জয় করেছে। সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশ সমাজের নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট, কিন্তু বিজেপি তাদের হিন্দু হিসাবে সংগঠিত করেছে। তফসিলি জাতি, উপজাতিদের রাজনৈতিক সমীকরণ নিজেদের অনুকূলে আনবার জন্য সোসাল ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করেছে।
এই বিশ্লেষণ থেকে আমরা শোষিত ও শোষকদের বর্তমান অবস্থানের ভিত্তিতে সংগ্রামের রূপরেখা ঠিক করতে পারি যা আজকের সময় অত্যন্ত জরুরিও বটে। শোষিত মানুষের প্রথম সারিতে রয়েছে খেতমজুর, অকৃষি শ্রমিক, শ্রমিক অসংগঠিত শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক যারা সর্বাধিক শোষিত পীড়িত। তাঁদের বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা তীব্র। তাই সংগ্রামের মেরুদণ্ড এরা। শোষিত হবার দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে ছোট কৃষক, মাঝারি কৃষক, ভাগচাষি, কারিগর, সামাজিক প্রকল্প কর্মীবাহিনী। দুই অংশের মানুষের মধ্যে সংগ্রামের ও ঐক্যের সেতুবন্ধন ঘটানো খুব জরুরি। কর্পোরেট শোষণে ধনী কৃষকও আজ আক্রান্ত তাদেরও জোটে শামিল করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। গ্রামীণ শোষকদের আমরা চিহ্নিত করেছি তাদের বড় অংশের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হবে। আর্থিক, প্রশাসনিক, সামাজিক রাজনৈতিক দিক দিয়ে শোষক শ্রেণি খুব শক্তিশালী। তাদের হাতে আছে গুন্ডাবাহিনী এবং প্রশাসনিক বাহিনী তাদের মিলিত আক্রমণ মোকাবিলা করা খুবই কঠিন। এই শ্রেণি শত্রুর পক্ষে দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র। শ্রেণিশত্রু যতই শক্তিশালী হোক না কেন এরা সংখ্যায় শোষিত মানুষের থেকে অনেক কম। শ্রেণিশত্রু সম্পর্কে আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে। তাদের দুর্বলতা খুঁজে ব্যবহার করতে হবে। তাদের জনবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে শোষিত মানুষকে বোঝাতে হবে। এবং তাদের অত্যাচার শোষণের বিরুদ্ধে গ্রামের গরিব জোটের সমাবেশ ঘটাতে হবে।
দেশে কর্পোরেট বান্ধব কৃষি নীতি গ্রহণ করবার ফলে মোদী সরকার কর্পোরেট সংস্থার হাতে জমি তুলে দেবার জন্য জমি অধিগ্রহণ (সংশোধন) আইন কার্যকরি করবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দেশের অসংখ্য কৃষক সংগঠন খেতমজুর সংগঠন এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বাধ্য হয়ে মোদী সরকার পিছু হটেন। কৃষক বা তাদের কোনও সংগঠনের সাথে আলোচনা না করে মোদী সরকার কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী তিনটি কৃষক আইন গায়ের জোরে সংসদে পাশ করে নেন। ডান, বাম, মধ্যপন্থী বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের প্রতিরোধে তিনটি কৃষক বিরোধী কালা আইন বাতিল করতে মোদী সরকার বাধ্য হয়। এই সংগ্রাম শিক্ষা দিয়েছে, শত্রু যত শক্তিশালী হোক না কেন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে তাকে পরাজিত করা সম্ভব। কৃষক, খেতমজুরদের বাঁচাতে গেলে উদারবাদী অর্থনীতি খতম করা দরকার। এর মাঝামাঝি কিছু হতে পারে না। তাই কৃষক, খেতমজুর, গ্রামীণ গরিবের স্থানীয় দাবির চলমান আন্দোলনের পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধ কৃষক গ্রামীণ সর্বহারাদের আন্দোলন হবে ভবিষ্যতের রূপ। কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর এই তিনটি উৎপাদক গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে উদারবাদী অর্থনীতির বিকল্পের জন্য ধারাবাহিক লড়াই করতে হবে।
দেশে কর্পোরেট উগ্র-হিন্দুত্ববাদের ফ্যাসিস্ত কায়দার আক্রমণ চলছে। আমাদের রাজ্যে তৃণমূল সরকারের আমলে চলছে লুটেরাদের রাজত্ব। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, আম্বানি, আদানি, আরএসএস-এর সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর ঘনিষ্ঠতা দিনের আলোর মতো সত্য। জমি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, কৃষি উন্নয়ন, সামাজিক মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্ট ও বামফ্রন্টের সময়কার সাফল্য তা ধ্বংস করে বাংলাকে অধঃপতনে তলিয়ে দিচ্ছে তৃণমূল সরকার। তৃণমূল জামানায় দুর্নীতির সাথে দুষ্কৃতীরাজ কায়েম হয়েছে। এই সরকারকে পরিবর্তন না করতে পারলে বাংলাকে সাম্প্রদায়িকতার বিভাজন থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
নভেম্বর মাস বিপ্লবের মাস। এই মাসেই চলছে গ্রাম জুড়ে পদযাত্রা। পদযাত্রার নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর তিনটি শ্রেণি সংগঠন। মূল স্লোগান ‘‘গ্রাম জাগাও — চোর তাড়াও — বাংলা বাঁচাও’’। সঙ্গে উঠেছে অসংখ্য খণ্ডিত খণ্ডিত গরিবদের প্রতিদিনের জীবন যন্ত্রণা লাঘবের দাবি। বাংলা বাঁচাতেই হবে তার জন্য চাই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সাহস। গ্রামের ভয় ভাঙছে।
Comments :0